বরকত মন্ডিত সালানা জলসা যুক্তরাজ্য ২০১৭

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৪-আগস্ট, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৪ই আগস্ট, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদ থেকে “বরকত মন্ডিত সালানা জলসা যুক্তরাজ্য ২০১৭”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার অশেষ ফযলে যুক্তরাজ্য জামাতের সালানা জলসা গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জলসার তিন দিনই আমরা আল্লাহ্‌র ফযলের দৃশ্যাবলী দেখেছি। কতিপয় পরিস্থিতি ও আবহাওয়ার কারণে কিছুটা দুশ্চিন্তাও ছিল, কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা নিজ করুণায় এসব অবস্থার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জলসাকে রক্ষা করেছেন। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীও এটি দেখেছেন যে আল্লাহ্‌র করুণা ও কৃপা প্রতি মুহূর্তে বর্ষিত হতে থেকেছে। এর জন্য আমরা আল্লাহ্ তা’লার যতই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না কেন তা কমই হবে। আর প্রকৃত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন তখনই হবে যখন আমরা প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায় রত থাকব। এই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর্মীদের পক্ষ থেকেও হওয়া উচিত, কেননা তা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে; আর অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকেও হওয়া উচিত যেন তা আল্লাহ্ তা’লার কৃপাসমূহকে অধিক মাত্রায় অর্জন করার এবং নিজেদের জীবনে পবিত্র পরিবর্তন সাধন করার কারণ হয়। একইভাবে জলসায় অংশগ্রহণকারীদের উচিত কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, আর কর্মীদেরও উচিত আল্লাহ্‌র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যে তিনি তাদেরকে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অতিথিদের সেবা করার সৌভাগ্য দান করেছেন। হুযুর (আই.) বলেন, জলসার উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে একটি হল এমন ভ্রাতৃত্ব ও পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রেরণা সৃষ্টি করা যা আদর্শস্থানীয় হবে। আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় এই ভালবাসা, প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের আবেগ যা আমরা নিজেদের মধ্যে প্রদর্শন করে থাকি, এটি অ-আহমদী অতিথিদের অত্যন্ত প্রভাবিত করে এবং তারা তাদের কথায় এটি তুলেও ধরে যে ‘জলসায় আমরা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার ব্যবহারিক নমুনা দেখেছি’। একইভাবে অংশগ্রহণকারীদের নিশ্চিন্তে ও শান্তিপূর্ণভাবে জলসার অনুষ্ঠান শোনা- এটিও অ-আহমদীদের জন্য এক আশ্চর্য দৃশ্য।

এরপর হুযুর (আই.) কিছু অ-আহমদী অতিথির ব্যক্ত করা অভিব্যক্তির উল্লেখ করেন যা তারা জলসার পরিস্থিতি দেখে প্রকাশ করেছেন এবং প্রকাশ্যে এই ঘোষণা দিয়েছেন যে ‘এটি যদি ইসলামের আসল শিক্ষা হয়ে থাকে তবে তা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন’। বেনিনের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী মরিয়ম বনি জেলো সাহেবা বলেন, এই জলসার মাধ্যমে আমি আহমদীয়া জামাতকে গভীরভাবে চেনার সুযোগ পেয়েছি। জলসার ব্যবস্থাপনা দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছি। কর্মীদের নিষ্ঠা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। প্রত্যেকটি বিভাগকে আমি সমালোচকসুলভ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছি, কিন্তু কোথাও কোন ত্রুটি দেখি নি। প্রত্যেকেই অন্যের জন্য স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টির চেষ্টায় রত ছিল, নিজের আরাম বাদ দিয়ে অন্যের আরামের জন্য সচেষ্ট ছিল। তিনি আরও বলেন, আহমদী জামাত ইসলামের যে শিক্ষা উপস্থাপন করে সেটি-ই পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করতে পারে ও পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তিনি মহিলাদের উদ্দেশ্যে হুযুর (আই.)-এর ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা করেন যে এর মাধ্যমে ইসলাম যে নারীদের অসাধারণ মর্যাদা প্রদান করে তা তুলে ধরা হয়েছে। একইভাবে অন্যান্য অতিথিরাও যেসব প্রশংসাসূচক কথা বলেছেন তার মধ্য থেকে হুযুর (আই.) কিছু কিছু উল্লেখ করেন। ইসলামের খাঁটি শিক্ষার প্রচার, নারী অধিকার, মহিলাদের পৃথক ব্যবস্থা যে তাদের জন্য অধিক স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের কারণ, সবার জন্য ভালবাসার নীতি, শত্রুদের জন্যও দোয়া করা এবং এভাবে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি বিষয়ের তারা ভূয়সী প্রশংসা করেন। একজন অতিথি এই মন্তব্যও করেন যে যদিও আমি ধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু জলসায় অংশ নিয়ে ও জামাতে আহমদীয়ার ইমামের সাথে সাক্ষাতের পর আমার মন বলছে যে যদি কোন সত্যধর্ম থেকে থাকে তবে তা ইসলাম ও আহমদীয়া জামাত। একজন ভদ্রমহিলা যিনি ইতোপূর্বে নান ছিলেন ও বর্তমানে সত্যের সন্ধানে রয়েছেন; তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে আমার এই অনুসন্ধান হয়তো শেষ হতে যাচ্ছে, অর্থাৎ সত্য ধর্মের সন্ধান এখন আমি পেয়ে গিয়েছি। কেউ একারণে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেছেন যে আহমদীয়া জামাতের কারণে আজ আমি ইসলাম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার প্রেরণা পাচ্ছি। মোটকথা অমুসলিমদের সকলেই জলসার কল্যাণে খাঁটি ইসলামী শিক্ষা জানার ও এর উপর আমলকারী মানুষদের দেখার সুযোগ পেয়ে অকপটে একথা ঘোষণা করেছেন যে এটি যদি প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা হয়ে থাকে, তবে তা অবশ্যই পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন।

হুযুর (আই.) কতিপয় অ-আহমদী মুসলমান অতিথির অভিব্যক্তিও তুলে ধরেন। গিনি কোনাকরির ডেপুটি স্পিকার, যিনি একজন হাজীও বটে, তিনি বিপুল সংখ্যক অংশগ্রহণকারী সত্ত্বেও জলসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, আমি হজ্জ্বও করেছি এবং বিভিন্ন ইসলামী দেশের অনেক অনুষ্ঠানেও গিয়েছি, কিন্তু কোথাও এত সুশৃঙ্খল ও সুন্দর ব্যবস্থাপনা দেখি নি। এটিই প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা যা আমি এখানে দেখেছি। আপনারাই সঠিক পথে রয়েছেন এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আপনাদের পেছনে খোদা তা’লার হাত রয়েছে। অনুরূপ মন্তব্য আরও কোন কোন অ-আহমদী মুসলিম অতিথি করেছেন, কেউ কেউ আহমদীয়াত গ্রহণও করেছেন। আন্তর্জাতিক বয়আতের সময় সেই পরিবেশের প্রভাবে আহমদী না হয়েও কেউ কেউ আবেগে আপনা থেকেই তওবা-ইস্তেগফারে অংশ নিয়েছেন, এমনকি অমুসলিম ব্যক্তিও এতে অংশগ্রহণ করেছে।

হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা সকল কর্মীকে প্রতিদান দান করুন, আর অংশগ্রহণকারীদেরও প্রতিদান দিন যারা নিজেদের ব্যবহারিক আদর্শের মাধ্যমে ইসলামের নীরব তবলীগের কাজ করেছেন। হুযুর (আই.) বলেন, আমাদের বিশেষভাবে এই হাজার হাজার কর্মীদের, যাদের মধ্যে নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সকলেই রয়েছে, তাদের জন্য দোয়া করা উচিত; এবার বৃষ্টির কারণে ব্যবস্থাপনায় কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কর্মীদের সতর্কতা ও পরিশ্রমের কারণে সেসব সমস্যা টের পাওয়া যায় নি। অধিকাংশ মন্তব্য যদিও ইতিবাচক, তবুও কিছু নেতিবাচক মন্তব্যও কেউ কেউ করেছেন, এগুলো লাল খাতায় লিপিবদ্ধ করার জন্য হুযুর (আই.) নির্দেশনা প্রদান করেন।

প্রেস ও মিডিয়া কাভারেজ প্রসঙ্গে হুযুর (আই.) বলেন, এখন পর্যন্ত ৩৫৮টি খবর জলসা প্রসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে এবং আরও হচ্ছে। অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে ৩৬ মিলিয়ন, টিভি ও রেডিওর প্রচারিত খবরের মাধ্যমে ৩১ মিলিয়নের অধিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে ২ মিলিয়ন লোকের কাছে খবর পৌঁচেছে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ৫৮ মিলিয়নের অধিক লোকের কাছে খবর পৌঁচেছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে ১২৮ মিলিয়ন লোকের কাছে সংবাদ পৌঁচেছে। আফ্রিকায় এমটিএ ছাড়াও দশটি টিভি চ্যানেলে জলসার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে। বিভিন্ন আফ্রিকান মিডিয়ার মাধ্যমে ৩৫ মিলিয়ন লোকের কাছে আহমদীয়াতের সংবাদ পৌঁচেছে। হুযুর (আই.) বলেন, এগুলো সব আল্লাহ্ তা’লার কৃপা যে আমাদের তুচ্ছ প্রচেষ্টায় তিনি অঢেল বরকত প্রদান করেন এবং এত বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেন। একইসাথে হুযুর (আই.) যুক্তরাজ্য জামাতের ও অন্যান্য দেশের সংশ্লিষ্ট প্রেস ও মিডিয়া বিভাগের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন তাদের সকলকে প্রতিদান প্রদান করেন। হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা করুন যেন আমরা সবাই সর্বদা নিজেদের দায়িত্ব পালনকারী হই এবং আল্লাহ্ তা’লার কৃপাকে আকর্ষণ করার জন্য সর্বদা ধর্মকে পার্থিবতার উপর অগ্রগণ্য করে নিজেদের কর্তব্য পালন করি। (আমীন)। হুযুর (আই.) কানাডা থেকে চার্টার্ড বিমানে করে আসা প্রায় সাড়ে তিনশ’ খোদ্দামেরও উল্লেখ করেন যারা ওয়াকারে আমলে অংশ নিয়েছে এবং তাদের জন্যও দোয়া করেন। একইসাথে এটিও বলে দেন যে তারা যদি জলসা না শুনে থাকে তবে তারা ভুল করেছে, ভবিষ্যতে আসলে তারা জলসার তিন দিন জলসা শুনবে এবং এরপর ওয়াকারে আমলে অংশ নেবে। পুনরায় কর্মীদের উত্তম প্রতিদানের জন্য হুযুর (আই.) দোয়া করেন এবং এই দোয়াও করেন যে জলসায় আমরা যা শিখেছি তা নিজেদের জীবনের অংশে পরিণত করার তৌফিক আল্লাহ্ আমাদের দান করুন। আমীন।