সালানা জলসা যুক্তরাজ্য ২০১৭ এবং অতিথিদের দ্বায়িত্ব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৮-জুলাই, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৮শে জুলাই, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার হাদীকাতুল মাহদী, আল্টন, যুক্তরাজ্য থেকে “সালানা জলসা যুক্তরাজ্য ২০১৭ এবং অতিথিদের দ্বায়িত্ব”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় যুক্তরাজ্যের বার্ষিক জলসা আজ থেকে শুরু হতে যাচ্ছে। এই দিনগুলোতে দোয়ার উপর অনেক বেশি জোর দিন এবং যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা সদকাও করুন যেন আল্লাহ্ তা’লা জলসাকে সবদিক থেকে সফল ও কল্যাণমন্ডিত করেন। আর যারা এখানে জলসায় এসেছেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী আহমদীরা, যারা এমটিএ-র মাধ্যমে এই সম্প্রচার শুনছেন, প্রত্যেকে সার্বিকভাবে জলসার সফলতার জন্য ও শত্রুদের সবধরনের ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকার জন্য দোয়া করুন। এরপর হুযুর (আই.) বলেন, গত খুতবায় আমি আতিথেয়তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের আতিথেয়তার দায়িত্ব পালনের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলাম, আজ সংক্ষেপে অতিথিদের এদিকে মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই যে অতিথিদেরও কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে যা তাদের পালন করতে হবে। ইসলামে অতিথিদের আতিথেয়তার ব্যাপারে অবশ্যই অনেক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, কিন্তু ইসলাম এমন এক সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষা দানকারী ধর্ম যা কেবল এক পক্ষকেই দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয় না, বরং অপর পক্ষকেও তার নিজ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ প্রদান করে। কেননা এটিই ভালবাসা, প্রেম ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এক সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল।

হুযুর (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যে, একবার অসন্তুষ্টির কারণে এক বছর জলসা অনুষ্ঠিত হতে দেন নি, এরও কারণ ছিল জলসায় অংশগ্রহণকারীদের ভ্রান্ত আচরণ। তিনি (আ.) তো এজন্য অসন্তুষ্ট হন নি যে কেউ সরাসরি তাঁর সাথে অসদাচরণ করেছিল, বরং এর কারণ হিসেবে তিনি (আ.) অংশগ্রহণকারীদের একে অপরের অধিকার আদায় না করা, স্বার্থপরতা ও অন্যের আরামের উপর নিজের আরামকে প্রাধান্য দেয়া ইত্যাদি উল্লেখ করেন। তিনি (আ.) বলেন, জলসার মূল উদ্দেশ্য হল তাকওয়ায় উন্নতি করা, খোদা তা’লার সাথে সম্পর্কে উন্নতি করা, পরস্পরের অধিকার আদায় করা ও অন্যের জন্য নিজের কুরবানীর উৎসাহকে বৃদ্ধি করা। হুযুর (আই.) বলেন, জলসায় আগত অতিথি কেবল এক অতিথিই নন যিনি কেবল নিজের সাথে উত্তম আচরণ ও স্বাচ্ছন্দ্য কামনা করবেন, বরং কুরবানী ও ত্যাগের উন্নত মানেও তাকে অধিষ্ঠিত হতে হবে, আর জলসার মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি, আধ্যাত্মিকতায় উন্নতি ও অন্যের অধিকার প্রদানের ব্যাপারে অধিক সচেতন হওয়া ইত্যাদি পূরণকারী হতে হবে। হুযুর (আই.) বলেন, অ-আহমদী অতিথি, বিশেষভাবে সেসব ব্যক্তি যারা কোন জাতির নেতা হিসেবে এসেছেন, তাদের যথাযথ ও যথাসম্ভব সম্মান ও আতিথেয়তা করতে হবে, কেননা এ বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ রয়েছে। একইভাবে যারা সত্যের সন্ধানে এখানে এসেছেন, তা সে যে-ই হোক না কেন, তাদেরও বিশেষভাবে সেবা করতে হবে, কারণ মসীহ্ মওউদ (আ.) স্বয়ং এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু একজন আহমদী যখন জলসায় অংশ নেবে তখন তার নিজেকে মেহমান ও মেজবান উভয়ই মনে করতে হবে, তাহলেই আত্মত্যাগ ও কুরবানীর উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে এবং জলসার পরিবেশ সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ হবে।

হুযুর (আই.) বলেন, অতিথির দায়িত্ব হল সে যেন সর্বদা এই চেষ্টা করে যে তার কারণে নিমন্ত্রণকর্তা যেন সমস্যায় না পড়ে, বরং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে- এটিই মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ। যেহেতু এখানে জলসার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা সাময়িক একটি ব্যবস্থা, তাই এতে অনেক অসঙ্গতি থাকতে পারে। যদি কেউ মনে করে যে জলসার বিভিন্ন বিভাগ ও কর্মীদের যেহেতু আমাদের সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে, তাই তাদের কাজে যদি কোন খুঁত থাকে তবে তাদেরকে যা ইচ্ছে তাই বলার আমাদের অধিকার আছে- তবে এমন চিন্তা অত্যন্ত ভ্রান্ত। এখানে যেসব কর্মী কাজ করে তারা আমাদের কর্মচারী নয়, বরং তাদের বিনয় ও মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর অতিথিদের সেবা করার আগ্রহের কারণে তারা এখানে কাজ করে থাকে, আর তাদের অনেকেই জাগতিকভাবে অনেক উচ্চপদস্থও হয়ে থাকে যারা এখানে অত্যন্ত সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করে। তাই অতিথিদের দায়িত্ব হল তাদের সাথে সদাচরণ ও সহযোগিতা করা, যদি তারা কোন ক্ষেত্রে অপারগতার কারণে মার্জনা চায় তবে তাদের কথা মেনে নেয়া। জলসায় অনেক তরুণ-তরুণীও সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে, অতিথিদের উচিত তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করা; তুচ্ছ কারণে তাদের সাথে রূঢ় ব্যবহার করলে তা তাদের উপর অত্যন্ত নেতিবাচক ফেলে। হুযুর (আই.) বলেন, প্রত্যেক আহমদীর উচিত নিজেকে কেবল অতিথি না ভাবা, বরং এই উদ্দেশ্যে জলসায় অংশগ্রহণ করা উচিত যে আমাকে জলসার মাধ্যমে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দোয়ার উত্তরাধিকারী হতে হবে, জলসার কল্যাণ থেকে উপকৃত হতে হবে এবং আধ্যাত্মিকতায় উন্নতি করতে হবে। হুযুর (আই.) বলেন, কিন্তু একইসাথে আমি কর্মীদেরও পুনরায় স্মরণ করাচ্ছি, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আপনাদেরকে ধৈর্য ও সদ্ব্যবহার প্রদর্শন করতে হবে।

এরপর হুযুর (আই.) বিভিন্ন বিভাগকে খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন এবং একইসাথে অতিথিদের কর্তব্যও উল্লেখ করেন। নিরাপত্তা বিভাগকে হুযুর বিশেষভাবে নির্দেশনা প্রদান করেন যে চেকিং-এর ক্ষেত্রে কাউকেই যেন ছাড় না দেয়া হয়, সাধারণ অতিথি থেকে শুরু করে বড় বড় কর্মকর্তাদেরকেও একইভাবে চেকিং করতে হবে, এর মাধ্যমে সকলের জন্যই দৃষ্টান্তও প্রতিষ্ঠিত হবে। হুযুর (আই.) বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হল- এই দিনগুলোতে দোয়ার উপর অনেক বেশি জোর দিন যেন আল্লাহ্ তা’লা সার্বিকভাবে জলসাকে কল্যাণমন্ডিত করেন। জলসার প্রোগ্রাম শোনার ব্যাপারেও হুযুর (আই.) অনেক জোরালো নির্দেশনা প্রদান করেন। কর্মীদেরকেও এবং বিভিন্ন স্টলসমূহ বা প্রদর্শনীসমূহের দায়িত্বে নিয়োজিতদেরকেও জলসা শোনার এবং জলসার সময় দোকান ও স্টলসমূহ বন্ধ রাখার ব্যাপারে হুযুর (আই.) কড়া নির্দেশ প্রদান করেন। এছাড়া হুযুর (আই.) প্রত্যেক বক্তার বক্তৃতাই মনোযোগ দিয়ে শোনার ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করেন, কেবলমাত্র পছন্দের বক্তার বক্তৃতা শোনা ও অন্যদের বক্তৃতায় মনোযোগ না দেয়ার রীতি যে একটি ভ্রান্ত রীতি সে বিষয়েও হুযুর (আই.) স্পষ্টভাবে বলে দেন, এবং সবকিছুই যে আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করে এবং আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যেই করা উচিত সে বিষয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর উদ্ধৃতিও তুলে ধরেন। হুযুর (আই.) বলেন, প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর উচিত নিষ্ঠার সাথে জলসায় অংশগ্রহণ করা, বক্তৃতাসমূহ শোনা এবং এই নিয়্যতের সাথে শোনা যে আমরা সাধ্যমত এগুলো পালনের চেষ্টা করব। হুযুর (আই.) খুতবার শেষদিকে এসে দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন প্রত্যেক্ অংশগ্রহণকারীকে জলসার উদ্দেশ্যাবলী পূরণের তৌফিক প্রদান করেন। আমীন।