সন্তানের তরবিয়ত ও পিতা-মাতার ভূমিকা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৪-জুলাই, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৪ই জুলাই, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “সন্তানের তরবিয়ত ও পিতা-মাতার ভূমিকা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, অনেক নারী-পুরুষ চিঠিতে লিখেন বা সাক্ষাতের সময় বলেন যে আমাদের সন্তান হতে যাচ্ছে, তার জন্য দোয়া করুন; কেউবা জিজ্ঞাসা করেন যে আমরা সন্তানের জন্য কী দোয়া করব; কেউবা বলেন যে আমাদের সন্তানরা শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ করতে যাচ্ছে, তাদের জন্য কী দোয়া করব বা কীভাবে তাদের তরবিয়ত করব যেন তারা সঠিক পথে ও পুণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে? হুযুর বলেন, আল্লাহ্‌র ফযলে জামাতের অধিকাংশ সদস্য এদিক থেকে সচেতন এবং কীভাবে সন্তানদের তরবিয়ত করবে সে বিষয়ে চিন্তা করেন। আমাদের আহমদীদের উপর আল্লাহ্ তা’লার অনেক বড় অনুগ্রহ যে আমরা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মান্য করার কারণে এই জগতপূজার যুগে থেকেও নিজেদের সন্তানদের বেলায় কেবল পার্থিবতা নয় বরং ধর্মের ক্ষেত্রেও তাদের উন্নতির বিষয়ে সচেতন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের উপর এই অনুগ্রহও করেছেন যে কুরআন শরীফে সন্তানের জন্মের পূর্ব থেকে শুরু করে তার তরবিয়তের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ের জন্য দোয়াও শিখিয়েছেন, তরবিয়তের পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন এবং পিতা-মাতার দায়িত্বাবলীর প্রতিও মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। যদি আমরা এসব দোয়া করি, এই পদ্ধতি অনুসারে নিজেদের জীবন যাপন করি ও স্বীয় সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হই, তবে আমরা এক পবিত্র প্রজন্ম পিছনে রেখে যেতে পারি।

হুযুর (আই.) বলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে সন্তানের তরবিয়ত কোন সহজসাধ্য বিষয় নয়, বিশেষভাবে প্রতি পদক্ষেপে বিভিন্ন আঙ্গিকে শয়তানের আক্রমণের এই যুগে তো এই কাজ নিতান্তই কঠিন বিষয়; কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা যে দোয়া ও পদ্ধতি বলে দিয়েছেন তার অর্থ হল যে আমরা যদি চাই তবে এগুলোর মাধ্যমে নিজেদেরও এবং আমাদের সন্তানদেরও শয়তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারি। কিন্তু এর জন্য ক্রমাগত দোয়া, আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা এবং পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা করতে হবে, হতোদ্যম বা ক্লান্ত হয়ে পড়লে চলবে না বা নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার শিকার হলে চলবে না। হুযুর (আই.) নেতিবাচক চিন্তাধারার শিকার হওয়ার উদাহরণ হিসেবে এক ব্যক্তির পত্রের উল্লেখ করেন, যে একথা লিখেছে যে বর্তমান যুগের অবস্থা যা নোংরা ও নৈতিকতা-বিবর্জিত, তাই বিয়ে করলেও এই চেষ্টা করব যেন সন্তান না হয়। হুযুর (আই.) বলেন, এটা তো চরম নৈরাশ্যপূর্ণ কথা। এমনটি করা শয়তানকেই সর্বশক্তিমান মেনে নিয়ে তার কাছে পরাজয় স্বীকারের নামান্তর, যেন (নাউযুবিল্লাহ্) আল্লাহ্‌র কোন শক্তিই নেই যে আমরা যতই চেষ্টা বা দোয়া করি না কেন, তিনি আমাদেরকে ও আমাদের সন্তানদেরকে শয়তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে অক্ষম। কোন আহমদীর তো এমন চিন্তা হতেই পারে না! মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে আল্লাহ্ তা’লা পৃথিবীতে যে বিপ্লব সৃষ্টির জন্য প্রেরণ করেছেন তার অংশ হতে চাইলে আমাদেরকে নিজেদের সম্পূর্ণ শক্তি ও সাধ্য নিয়োগ করতে হবে এবং নিজ বংশধরদের মাঝেও এই স্পৃহা তৈরি করতে হবে, তাদের জন্য দোয়াও করতে হবে আর তরবিয়তও করতে হবে যেন সমাজের এসব নোংরামি সত্ত্বেও আমরা শয়তানকে সফল হতে না দেই (ইনশাআল্লাহ্)। নিরাশ হবার কোন কারণ নেই, বরং এক দৃঢ়-সংকল্পের সাথে আল্লাহ্‌র নির্দেশিত পথে চলার মাধ্যমে পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্ণ চেষ্টা করতে হবে।

হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা পুণ্যবান সন্তান লাভের জন্য পবিত্র কুরআনে দোয়া শিখিয়েছেন। এক স্থানে হযরত যাকারিয়া (আ.)-এর দোয়ার উল্লেখ এসেছে, দোয়াটি হল: ‘রাব্বি হাবলী মিল্লাদুনকা যুর্‌রিয়্যাতান তাইয়্যেবা, ইন্নাকা সামিউদ্দু’আ’ অর্থাৎ ‘হে আমার প্রভু-প্রতিপালক! আমাকে তোমার সন্নিধান থেকে পবিত্র সন্তান দান কর। নিশ্চয়ই তুমি অধিক প্রার্থনা-শ্রবণকারী’। অর্থাৎ পবিত্র সন্তান চাইলে তার জন্য দোয়াও করতে হবে। কিন্তু একইসাথে পিতা-মাতাকেও পবিত্রচেতা ও সৎকর্মশীল হতে হবে, এবং কেবল মা বা কেবল বাবা এমনটি হলে চলবে না, বরং উভয়কেই এমনটি হতে হবে, আর সন্তান জন্ম নেবার অনেক আগে থেকেই স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পুণ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। কুরআন শরীফে হযরত যাকারিয়া (আ.)-এর আরেকটি দোয়ার উল্লেখ আছে: ‘রাব্বি লা তাযারনী ফারদা, ওয়া আনতা খায়রুল ওয়ারিসীন’ অর্থাৎ ‘হে আমার প্রভু! আমাকে নিঃসঙ্গ পরিত্যাগ করো না, আর তুমিই সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী’। এখানে আল্লাহ্ তা’লাকে ‘সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী’ বলা হয়েছে; এত্থেকে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান হওয়ার দোয়া কেবল এজন্য হওয়া উচিত নয় যেন পার্থিব বিষয়াদির জন্য আমাদের কোন উত্তরাধিকারী হয়ে যায়, বরঞ্চ এমন উত্তরাধিকারী হয় যে ধর্মকে জাগতিকতার উপর প্রাধান্য দেবে। এখন এমন দোয়া তো সেই ব্যক্তিই করবে যে স্বয়ং ধর্মকে পার্থিবতার উপর প্রাধান্য দানকারী। যদি নিজেই পার্থিবতায় নিমজ্জিত থাকে, তবে পুণ্যবান উত্তরাধিকারী কীভাবে চাইবে? হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘সন্তানের আকাংখা কেবল উত্তরাধিকারী বানানোর জন্য করো না। বরং পবিত্র, পুণ্যবান ও ধর্মের সেবক উত্তরাধিকারী হবার জন্য দোয়া কর, নতুবা সন্তানও অনেক বড় পরীক্ষায় পরিণত হতে পারে।’ আরেক স্থানে তিনি (আ.) বলেন, সন্তানের পরীক্ষা অনেক ভয়াবহ পরীক্ষা হয়ে থাকে…যদি কেউ নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার অনুগামী করে নেয় তবে সে সন্তানের বিষয়ে প্রশান্তি পেতে পারে, আর সেটি হল ‘ধর্মকে জাগতিকতার উপর প্রাধান্য দাও’। হুযুর (আই.) বলেন, পবিত্র কুরআনে সন্তান ও জীবনসঙ্গীর জন্য এক পূর্ণাঙ্গ দোয়া শেখানো হয়েছে: ‘রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াজেনা ওয়া যুর্‌রিয়্যাতিনা কুর্‌রাতা আ’য়ুনিন ওয়াজ’আলনা লিলমুত্তাকীনা ইমামা’ অর্থাৎ ‘হে প্রভু! আমাদেরকে আমাদের জীবনসঙ্গী ও সন্তানদের মাধ্যমে চোখের স্নিগ্ধতা দান কর, এবং আমাদেরকে মুত্তাকীগণের নেতা বানিয়ে দাও’। প্রত্যেকেরই বেশি বেশি এই দোয়া করা উচিত। এই দোয়ার ব্যাখ্যায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, এতে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, আমরা যেন তাকওয়ার ক্ষেত্রে তাদের জন্য নেতা অর্থাৎ আদর্শ হই। তিনি (আ.) আরও বলেন, সন্তানের আকাংখা কেবল ক্ষুৎ-পিপাসার আকাংখার মত যেন না হয়, বরং এর পেছনে মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যকে দৃষ্টিপটে রাখতে হবে, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র ইবাদত প্রতিষ্ঠার দায়িত্বকে দৃষ্টিতে রাখতে হবে। আর তার জন্য ব্যক্তির নিজেকেও পুণ্যবান হতে হবে, যদি নিজে পুণ্যবান না হয় আর পুণ্যবান সন্তান চায় তবে এমন ব্যক্তির পুণ্যবান সন্তান চাওয়া কেবল দাবীসর্বস্ব, এতে সত্যতার লেশমাত্র নেই। আর যারা এই জন্য সন্তান বা পুত্র চায় যে তাদের যেন কোন ওয়ারিশ হয় এবং তাদের সম্পদ শরিকদের হাতে চলে না যায়, এমন ব্যক্তি আসলে শিরক্ করে; সেই হতভাগা এ-ও জানে না যে, সে মরে গেলে তার জন্য শত্রু-বন্ধু সবাই সমান। তিনি (আ.) বলেন, আমার এমন কোন নামায নেই যাতে আমি জামাতের বন্ধুদের, নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য দোয়া না করি।

হুযুর (আই.) বলেন, ওয়াকেফীনে নওদের পিতা-মাতাদের এ বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া দরকার আর তাদের জন্য এই দোয়া করা দরকার যেন তারা বড় হয়ে ধর্মকে জাগতিকতার উপর প্রাধান্য দেয় ও ‘ওয়াকফ’ করে। কেবল গায়ে ওয়াকফে নও তকমা এঁটে ঘুরবে আর বড় হয়ে নিজের কাজে লেগে যাবে- এমন যেন না হয়। বরং তারা প্রথমে জামাতকে জিজ্ঞাসা করবে যে জামাতের তাদের প্রয়োজন রয়েছে কি-না; যদি জামাত তাদের অনুমতি দেয় তবে নিজের কাজ করুক, নতুবা জামাতের চাহিদা পূরণের জন্য নিজেদের ও বাবা-মার ওয়াকফের প্রতিজ্ঞা পূরণার্থে জামাতের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে।

হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রত্যেককে সন্তানের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হওয়ার, ধর্মকে জাগতিকতার উপর প্রাধান্য দেয়ার অঙ্গিকারকে পূর্ণকারী হওয়ার, অন্যদের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার পরিবর্তে নিজের সংশোধনের প্রতি যত্নবান হওয়ার, তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, সন্তান যেন চোখের স্নিগ্ধতার কারণ হয় এবং বংশানুক্রমে এই ধারা অব্যাহত থাকে- নিজ সন্তানদের জন্য সর্বদা এই দোয়া করার তৌফিক দান করুন। আমীন।