উৎকন্ঠা বা ব্যাকুলতা নিয়ে দোয়া বজায় রাখা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩০-জুন, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৩শে জুন, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “নামায, জুমুআ ও রমযান”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, রমযান অজস্র কল্যাণরাজি নিয়ে আগমন করে এবং যারা এর প্রকৃত তত্ত্ব অনুধাবন করে তারা এত্থেকে কল্যাণও লাভ করে। হুযুর (আই.) তাঁর কাছে আসা বিভিন্ন চিঠির বরাতে জামাতের সদস্যদের কথা তুলে ধরেন; তারা দোয়ার আবেদন করেছেন যে, রমযানে রোযা রাখার সাথে সাথে নফল আদায়, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আদায়, কুরআন সম্পূর্ণ পড়া, দোয়া গৃহীত হবার দৃষ্টান্ত লাভ, আল্লাহ্ তা’লার কৃপা ও দয়া লাভ ইত্যাদির যে সৌভাগ্য তারা লাভ করেছেন, যা একান্তই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে লাভ হয়েছে, তাদের এই অবস্থা যেন পরবর্তীতে কোন অন্যায় বা ভুল-ত্রুটির কারণে পরিবর্তিত হয়ে না যায় এবং তারা যেন আল্লাহ্‌র কৃপা লাভের পর তা থেকে বঞ্চিত হয়ে না যান। হুযুর (আই.) দোয়া করেন, এমনটি যাদের অবস্থা, যারা প্রকৃত অর্থেই রমযান দ্বারা কল্যাণমন্ডিত হবার চেষ্টা করেছেন, তাদের মাঝে যদি কোন ত্রুটি বা দুর্বলতা থেকেও যায়, তবুও যেন আল্লাহ্ তা’লা একান্ত দয়াপরবশ হয়ে তাদের ক্ষমা করেন এবং তাদের চেষ্টাকে সফল করেন ও তারা যেন রমযানের অর্জিত মান থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নতি করতে থাকেন (আমীন)। হুযুর (আই.) বলেন, কিন্তু তাদের নিজেদেরও এই দোয়া করা উচিত যে আমাদের পা যেন এখন আর পিছনে ধাবিত না হয়, বরং সামনে অগ্রসর হয়; আল্লাহ্ ও বান্দার হক আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা যে মান অর্জন করেছি তা যেন আরও উঁচু হয়- এর জন্য চেষ্টা ও দোয়া উভয়টিই করুন।

হুযুর (আই.) দোয়ার প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা যে দোয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং বলেছেন যে তিনি বান্দার নিকটবর্তী হয়ে যান, এটিতে কেবল রমযানের কথা উল্লেখ করেন নি। বরং তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তিই উৎকন্ঠিত হয়ে তাঁর কাছে ধাবিত হয় তিনি তার দোয়া কবুল করেন। হুযুর (আই.) সূরা নমলের ৬৩নং আয়াতের উল্লেখ করে এ বিষয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.) যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তা তুলে ধরেন। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, এমন নয় যে আল্লাহ্ কেবল রমযানেই বান্দার নিকটবর্তী হন অন্য সময় নয়, কিংবা রমযান আসলেই বান্দা ভাল হোক বা মন্দ তিনি তার নিকটবর্তী হবেনই; এগুলো আসলে একটি বিশেষ পরিবেশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বলা হয়েছে। নতুবা ‘ইন্নী কারিব’ ঘোষণাটি স্থায়ী ঘোষণা যে ‘তোমরা আস এবং আমার নৈকট্য থেকে লাভবান হও’। রমযানের বিশেষ কর্মকান্ড ও ইবাদতের কারণে যেহেতু বিশেষ পরিবেশ বিরাজ করে যার ফলে দোয়ার প্রতি বিশেষ মনোযোগ থাকে, তাই রোযার আয়াতগুলোর পরপর এই আয়াত ‘উদঊনী আস্তাজিব লাকুম’ এসেছে।

যিকরে এলাহীর ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর কড়া সতর্কবাণী হুযুর (আই.) উল্লেখ করেন যে, তিনি (সা.) আল্লাহ্ তা’লাকে স্মরণকারী ও যে স্মরণ করে না তাদের উপমা জীবিত ও মৃতের মত বলে বর্ণনা করেছেন। হুযুর (আই.) বলেন, এই উপমা তো সারা বছরের জন্যই প্রযোজ্য; কেবল রমযানের কয়েকটি দিন যদি যিকরে এলাহীতে মনোযোগ থাকে আর বাকি বছর উদাসীনতা থাকে, তবে তা সেই ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিকভাবে মৃত ব্যক্তিতে পরিণত করবে। হাদীসে বর্ণিত উপমা তুলে ধরে হুযুর (আই.) বলেন, শয়তানের হাত থেকে রক্ষা পাবার সুরক্ষিত দুর্গ হল যিকরে এলাহী বা আল্লাহ্‌র স্মরণ, তাই আমাদের উচিত সর্বদা এই সুরক্ষিত দুর্গে যেন আমরা অবস্থান করি।

হুযুর (আই.) বলেন, দোয়া গৃহীত হবার জন্য একটি শর্ত তো হল উৎকন্ঠা বা ব্যাকুলতা, আরেকটি শর্ত হল যার জন্য দোয়া করা হচ্ছে তার জন্য হৃদয়ে সহানুভূতি ও গভীর বেদনা অনুভব করা। মানুষের নিজের জন্য বা আপনজনের জন্য দোয়ার ক্ষেত্রে তো এটি থাকেই, কিন্তু একজন মুমিনের জন্য আবশ্যক হল সে যেন সমগ্র জামাতের জন্য, উম্মতে মুসলিমার জন্য, দেশের লোকদের জন্যও অনুরূপ বেদনা ও সহানুভূতি নিয়ে দোয়া করে, ভাসাভাসা ভাবে নয়। মসীহ্ মওউদ (আ.) তো দোয়ার গন্ডিকে এতটা বিস্তৃত করতে বলেছেন যেন সাধারণভাবে নিজ শত্রুকেও দোয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদি এক্ষেত্রে কার্পণ্য করে তবে সেও খোদার কৃপার গন্ডির বাইরে থাকবে। অন্যের জন্য প্রকৃত বেদনা নিয়ে দোয়া করলে বান্দা সহজেই আল্লাহ্‌র কৃপাভাজন হতে পারে। হুযুর (আই.) বলেন, বর্তমান যুগে মানুষ এই নীতি দ্বারা অনেক লাভবান হতে পারে। প্রত্যেক আহমদীর উচিত নিজের স্থায়ী দোয়াতে জামাতকে অন্তর্ভুক্ত করা। পাকিস্তানের আহমদীদের করুণ ও কষ্টকর অবস্থা তো সবারই জানা, সেখানে নিত্যদিন বিভিন্ন আঙ্গিকে আহমদীদের অত্যাচার তো করা হচ্ছেই, সম্প্রতি রাজনৈতিকভাবে এমন সব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে যেন নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে আহমদীদের উপর অত্যাচারে নতুন মাত্রা যোগ করা যায়। তাদের জন্য দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ্ তা’লা তাদের এসব ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার থেকে নিরাপদ রাখেন এবং শীঘ্র এই পরিস্থিতি বদলে দেন। এছাড়া আলজেরিয়ার আহমদীদের জন্যও একইভাবে দোয়া করা উচিত, তারা আহমদীয়াতের কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের শিকার। আমরা তো কখনোই এসব অত্যাচারের প্রত্যুত্তরে আইন হাতে তুলে নিইনি বা হাতে অস্ত্র তুলে নিইনি, তবে দোয়ার অস্ত্র আমরা অবশ্যই ব্যবহার করব- এটিই আমাদের একমাত্র অস্ত্র ও উপায়। শত্রু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে এবং হবেও (ইনশাআল্লাহ্), কিন্তু আমাদের দায়িত্ব হল দোয়া বজায় রাখা এবং ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি করা।

হুযুর (আই.) বলেন, বাহ্যত যেসব আহমদী কোন বিপদে নিপতিত নন, তাদের একথা ভেবে বসে থাকলে চলবে না যে আমরা তো নিরাপদেই আছি। তাদের ভাবা উচিত- এমন অবস্থা যে কোন মুহূর্তে আমাদের উপরেও আসতে পারে। ইউরোপ ও পাশ্চাত্যে ক্রমবর্ধমান ইসলাম-বিদ্বেষের শিকার আহমদীরাও হতে পারে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে হচ্ছেও। যদিও আমরা শান্তিপূর্ণ ইসলামের ধারক-বাহক, কিন্তু জনসাধারণ সকলে তো আর সেটি জানে না। হুযুর (আই.) একজন আহমদীর এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, এমন ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে যদি এর চিকিৎসা করা না হয়। আর এর চিকিৎসা হল দোয়া ও আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা।

হুযুর (আই.) বলেন, গোটা পৃথিবী আজ তার কর্মকান্ডের কারণে আল্লাহ্ তা’লার অসন্তুষ্টি ও ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সুপার পাওয়ার বা বড় বড় শক্তিগুলো মুসলমানদের মাঝে অন্তর্কলহ সৃষ্টি করছে, আর মুসলমানরাও বোকার মত তাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করছে। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে আমেরিকা তাদের যে দুরভিসন্ধি প্রকাশ করছে তাতে শংকা হচ্ছে যে এতে ইরান ও আমেরিকা প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সৌদি আরব আমেরিকাকে সমর্থন দিচ্ছে। হতে পারে যে এটিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব যুদ্ধই হয়তো লেগে যাবে, কিন্তু দুঃখের বিষয়টি হল বড় বড় পরাশক্তিগুলো চতুর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলমানদের নিজেদের মাঝে লড়াই বাধিয়ে দিচ্ছে, অথচ মুসলমানরা তা বুঝতে পারছে না। আরেকদিকে আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার মাঝেও উত্তাপ বিরাজ করছে এবং শক্তি ও অস্ত্রের প্রদর্শনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হয়ে উঠছে। এগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে সাইবার হামলা, এটিও সশস্ত্র ধ্বংসাত্মক যুদ্ধকে উস্কে দিতে পারে। আমেরিকার স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতার দাপটে ও মুসলমানদের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের কারণে যাচ্ছেতাই ও বেপরোয়া আচরণ করছে, ইসলামের প্রাণকেন্দ্রের বাদশাহও ঈমানহীন আচরণ করে চলেছে। এই যাবতীয় সমস্যার সমাধান প্রকৃতপক্ষে যুগের ইমাম, মসীহ্ ও মাহদীকে মান্য করা। পৃথিবীর রক্ষা পাবার এখন একমাত্র উপায় হল আহমদীদের দোয়া। তাই আহমদীদের জন্য আবশ্যক দায়িত্ব মানবতার বেদনাকে অনুভব করে তাদের রক্ষার জন্য দোয়া করা। বিশ্ব যুদ্ধ বাধলে মানবজাতির একাংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পর সকলে আহমদীয়াতের দিকে ফিরে আসবে- এতে আনন্দিত না হয়ে আমাদের দায়িত্ব হল সকলেই যেন রক্ষা পায় এবং শাস্তি ব্যতিরেকেই আহমদীয়াতের দিকে মনোযোগী হয় সেজন্য হৃদয়-নিংড়ানো দোয়া করা। হুযুর শেষে দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন আমাদের সকলের পরিণাম শুভ করেন এবং আমরা যেন আল্লাহ্‌র রসূল (সা.) ও তাঁর একান্ত দাসের (আ.) শিক্ষানুযায়ী জীবন যাপন করতে পারি। আমীন।