সত্য, মিথ্যা ও অহঙ্কার

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৬-জুন, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৬ই জুন, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “সত্য, মিথ্যা ও অহঙ্কার”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর,

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, গত খুতবাতে বলেছিলাম, যে তাকওয়া অর্জনের জন্য নৈতিক গুণ থাকা আবশ্যক, তাই একজন মুমিনের চেষ্টা করা উচিত সে যেন সকল নৈতিক গুণ অবলম্বন করে, আল্লাহ্ তা’লার সকল আদেশ ও নিষেধ মেনে চলে, তাহলে সে মুত্তাকী হতে পারবে। অতঃপর হুযুর (আই.) বলেন, তবে এমন কিছু কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে তা যদি একজন মুমিনের মাঝে না থাকে তবে তাকওয়া অর্জন তো দূরের কথা, তার ঈমানের মানও নিচে নেমে যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা মুমিন হওয়ার জন্য মৌলিক শর্ত, তা হল সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা ও মিথ্যা থেকে মুক্ত থাকা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা বলেন, ‘ফাজতানিবু রিজসা মিনাল আওসানি ওয়াজতানিবূ কওলায্ যূর’ (সূরা হাজ্জ: ৩১) অর্থাৎ ‘তোমরা প্রতিমাপূজা ও মিথ্যাকথা থেকে বেঁচে থাক’। এস্থলে আল্লাহ্ তা’লা মিথ্যাকে প্রতিমাপূজার সাথে একত্রিত করে এটি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে যদি তোমাদের মাঝে সত্যতা না থাকে, তবে তা এতবড় পাপ যেন তোমরা প্রতিমাপূজা করছ। এটি হতেই পারে না যে, একজন মুমিন বাহ্যত আল্লাহ্‌র একত্ববাদের ঘোষণা দিবে আর একইসাথে বাহ্যিক অথবা গুপ্ত- কোন এক প্রকার প্রতিমাপূজায় লিপ্ত থাকবে।

প্রতিমা কী এবং তা থেকে বাঁচার উপায় কী? সে সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তাঁর বিভিন্ন বই-পুস্তক ও বৈঠকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। নূরুল কুরআন পুস্তকে তিনি (আ.) সূরা হাজ্জের ৩১নং আয়াতের আলোকে লিখেন যে, পবিত্র কুরআন মিথ্যা বলাকে প্রতিমাপূজার নামান্তর আখ্যা দিয়েছে, এই দুটিই নোংরামি ও পাপ। মিথ্যার কারণে মানুষ খোদা তা’লা থেকে দূরে সরে পড়ে, আর যারা মিথ্যা বলে আল্লাহ্ তা’লা তাদের পরিত্যাগ করেন। বস্তুত, মিথ্যাও এক প্রতিমা, এর উপর ভরসাকারী খোদার উপর ভরসা করা ছেড়ে দেয়। আরেকটি বৈঠকে তিনি (আ.) বলেন, আসলে মিথ্যাও একপ্রকার মূর্তিই হয়ে থাকে, নতুবা মানুষ সত্য পরিত্যাগ করে অন্যদিকে কেন যাবে? যেভাবে প্রতিমার ভেতরে কোন সত্য নেই, তেমনিভাবে মিথ্যার মাঝেও অপমান-লাঞ্ছনা ও অন্যায় ছাড়া আর কিছু নেই। যারা মিথ্যা বলে, তারা কখনো সত্য বললেও মানুষ সন্দেহ করে যে তাদের এই কথার মাঝেও হয়তো মিথ্যার মিশ্রণ রয়েছে। মিথ্যা এমন এক বদ-অভ্যাস যা চট করে ছাড়া যায় না, দীর্ঘ ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, পরিশ্রম ও সংগ্রামের পর এত্থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। জগতপূজারীরা বলে, জাগতিক সাফল্য ও উন্নতি অর্জন করতে হলে কিছু না কিছু মিথ্যা বা প্রতারণার আশ্রয় নিতেই হয়, এর কোন বিকল্প নেই। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর খন্ডন করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা মিথ্যাকে প্রতিমাপূজার সাথে একীভূত করেছেন, কারণ যেভাবে এক নির্বোধ মানুষ আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে পাথরের সামনে মাথা নত করে, তেমনিভাবে তারা সাধুতা ও সত্যপথ পরিত্যাগ করে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিথ্যাকে প্রতিমা বানিয়ে নেয়। যেভাবে একজন প্রতিমাপূজারী প্রতিমার সামনে মাথা ঠেকিয়ে মুক্তি চায়, তেমনিভাবে মিথ্যাবাদীও মিথ্যাকে তার মনগড়া প্রতিমা বানিয়ে নেয় এবং ভাবে যে এই প্রতিমার মাধ্যমে সে মুক্তিলাভ করবে। তারা কত দুর্ভাগা যে তারা খোদাকে বাদ দিয়ে মিথ্যাকে তাদের জীবনের আশ্রয় মনে করে। তিনি (আ.) বলেন, নিশ্চিত স্মরণ রেখো- মিথ্যার মত খারাপ আর কিছু নেই। জগতপূজারীরা সাধারণত বলে, যারা সত্য বলে তারা ধরা খায়। কিন্তু আমি একথা কিভাবে মানতে পারি? আমার বিরুদ্ধে সাত-সাতটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্‌র কৃপায় কোন একটি মামলাতেও আমাকে একটি বাক্যও মিথ্যা বলতে হয় নি। আল্লাহ্ তা’লা সর্বদা সত্যবাদীর সহায় হন। এটি কিভাবে হতে পারে যে তিনি সত্যবাদীকে শাস্তি দিবেন? এমনটি হলে তো পৃথিবীতে কেউই সত্য বলার সাহস দেখাবে না, আর পৃথিবী থেকে খোদা তা’লার উপর বিশ্বাসই হারিয়ে যাবে। তিনি (আ.) বলেন, আসল কথা হল- সত্য বলে কেউ যদি শাস্তি পায়, তবে তা সত্য বলার জন্য পায় না। বরং তা তাদের বিভিন্ন গোপন ও প্রচ্ছন্ন পাপের কারণে পায়, ইতোপূর্বে তার যেসব ভুল-ত্রুটি বা অপকর্ম ছিল তার কারণে সে শাস্তি পায়।

হুযুর (আই.) ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার সাম্প্রতিক একটি সংখ্যা যাতে মিথ্যার বিষয়ে গবেষণা সংক্রান্ত প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে তার উল্লেখ করেন। তাতে মানুষের এই ধারণার কথা লেখা হয়েছে যে তারা মনে করে মিথ্যার কারণেই তারা সফলতা লাভ করেছে। এই প্রবন্ধে এটি প্রমাণ করারও চেষ্টা করা হয়েছে যে মানুষের প্রকৃতিই হল মিথ্যা বলা, অথচ প্রকৃতপক্ষে এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি কথা; আসলে পারিপার্শিকতার প্রভাবে মানুষ মিথ্যাবাদী হয়। এই প্রবন্ধে মিথ্যাবাদীতার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরা হয়েছে। স্বার্থপরতা, কাউকে সঠিক পথ না দেখানোর জন্য, ধোঁকা বা প্রতারণার জন্য, নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্য, স্বামী বা স্ত্রী তার অনৈতিক সম্পর্ককে ঢাকার জন্য, অন্যের মনে নিজের সম্পর্কে উঁচু ধারণা সৃষ্টির জন্য, অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য, নিজে ভাল সাজার জন্য, মানুষকে হাসানোর জন্য ইত্যাদি নানা কারণে বা অজুহাতে মানুষ মিথ্যা বলে। মোটকথা এই জরিপে সকল ধরনের মিথ্যাবাদীর কথা তারা বলেছে। হুযুর (আই.) এই প্রবন্ধের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা মনে করেন যে এসব জাতির সত্যের মান অনেক উন্নত, কিন্তু আসলে তাদের সত্যের মান কী তা দেখুন! এদেরকে যদি সত্যের মানদন্ড ধরা হয় তবে তা মুমিনের জন্য সত্যিই চিন্তার বিষয়। এমনিতেই তো তারা সত্য খোদাকে মানে না। হুযুর (আই.) বলেন, আমাদেরকে নিজেদের সত্যের মান কেমন তা দেখতে হবে। হুযুর (আই.) এ প্রসঙ্গে সত্য সাক্ষ্য দেয়া ও শত্রুদেরও অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইসলাম যে নির্দেশ দিয়েছে তা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বাণীর আলোকে তুলে ধরেন বলেন, আমাদের নিজেদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত যে এসব বিভিন্ন পর্যায়ের ও ধরনের মিথ্যার কোনটি আমাদের মাঝে যেন না থাকে।

এরপর হুযুর (আই.) দ্বিতীয় পুণ্যের বিষয়ে বলেন, সেটি হল বিনয় অবলম্বন ও অহংকার প্রদর্শন না করা। পবিত্র কুরআনে আছে যে আল্লাহ্ তা’লা কোন অহংকারী ও দাম্ভিককে ভালবাসেন না। হুযুর (আই.) বলেন, রমযানে দেখা যায় যে ইবাদত-রোযা ইত্যাদি পালনের ফলে কারো কারো মাঝে অহংকার সৃষ্টি হয়, যা নিতান্তই ভুল ও অন্যায় একটি আচরণ। অহংকার শয়তানের বৈশিষ্ট্য, সে অহংকার করেছিল এবং আদম থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিল। আদম (আ.) বিনয়ী হওয়ার কারণে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল এবং তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে নিজেকে শোধরানোর ও ক্ষমা লাভের সুযোগ পেয়েছিল। হুযুর (আই.) বলেন, রমযানের এই দিনগুলোতে আদম (আ.)-এর দোয়া ‘রাব্বান যালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরীন’ বেশি বেশি পড়া উচিত। পবিত্র হবার আবশ্যক রীতি হল কোন প্রকার অহংকার ও গর্ব না করা, তা অর্থ-বিত্তেরই হোক বা বংশ মর্যাদারই হোক বা জ্ঞান-গরিমার হোক বা অন্য কোন বিষয়েই হোক। মসীহ্ মওউদ (আ.) উদাহরণ দিয়েছেন যে মহানবী (সা.) কতটা বিনয়ী ছিলেন যে তিনি (সা.) নিজের সম্পর্কেও একথা বলেন যে, আমিও নিজের কর্মের গুণে জান্নাতে যাব না, বরং আল্লাহ্‌র কৃপায় যাব। যেখানে তিনি (সা.)-ই এতটা বিনয়ী ছিলেন, সেখানে আমাদের কতটা বিনয়ী হওয়া উচিত? তিনি (আ.) আরও বলেন, যার মাঝে অহংকার নামক আধ্যাত্মিক ব্যাধি বাসা বাঁধে, তার আধ্যাত্মিক মৃত্যু অনিবার্য।

হুযুর (আই.) খুতবার শেষদিকে এসে দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে মহানবী (সা.)-এর সুন্নত অনুসরণ করে সবরকম নোংরামি থেকে মুক্ত হয়ে সকল উন্নত নৈতিক গুণাবলী অবলম্বন করার তৌফিক দান করুন; আমাদের সত্যের মান যেন এমন হয় যা খোদার নৈকট্য প্রদানকারী হবে এবং আমাদের বিনয়ের মানও যেন এমন হয় যা খোদা তা’লা পছন্দ করেন এবং আমরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জামাতের এমন সদস্যে পরিণত হই যেমনটি তিনি আমাদের দেখতে চেয়েছেন। আমীন।