রমযান, ত্বাকওয়া ও ধৈর্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০২-জুন, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২রা জুন, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “রমযান, ত্বাকওয়া ও ধৈর্য”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) সূরা বাকারার ১৮৪নং আয়াত তেলাওয়াত করেন যার অর্থ হল: “হে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের উপর সেভাবে রোযা বিধিবদ্ধ করা হল যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর তা বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল, যেন তোমরা ত্বাকওয়া অবলম্বন করতে পার।”

অতঃপর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আলহামদুলিল্লাহ যে আমরা আমাদের জীবনে আরও একটি রমযান মাস অতিক্রম করার সৌভাগ্য লাভ করছি। রসূলুল্লাহ (সা.) রমযান সম্পর্কে বলেন, ‘মানুষ যদি রমযানের কল্যাণ সম্পর্কে জানতো তাহলে চাইতো যেন সারা বছরই রমযান হয়।’ তিনি এই কল্যাণ কী সে সম্পর্কে বলেন যে জান্নাতকে সারা বছর রমযানের জন্য সুসজ্জিত করা হয়। আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে রমযানে রোযা রাখে তার পূর্বকৃত সব পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়। হুযুর (আই.) উল্লিখিত কুরআনের আয়াত ও এই হাদীসগুলোর আলোকে বলেন, রমযানের কল্যাণ শুধু এই মাসের কারণে বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার পরিত্যাগের কারণে লাভ হয় না, বরং ঈমানের সাথে, আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে রোযা পালনে, নিজের কর্মের প্রতি দৃষ্টি প্রদানের মাধ্যমে, আল্লাহ্ ও বান্দার অধিকার প্রদানে সচেতনতার মাধ্যমে ও ত্বাকওয়া অবলম্বন করার ফলে এই কল্যাণ লাভ হয়; আর কুরআনের আয়াতও এদিকেই ইঙ্গিত করছে যে রমযানের উদ্দেশ্য হল মানুষ যেন ত্বাকওয়া অর্জন করতে পারে। নতুবা শয়তান তো সবসময়ের জন্য এই চ্যালেঞ্জ দিয়ে রেখেছে যে মানুষ যখনই আল্লাহ্‌র কাছ থেকে সামান্য দূরে সরে পড়বে, তখনই সে তাকে নিজের করায়ত্ত করে নেবে। প্রতিটি কাজ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করার নামই হল ত্বাকওয়া।

হুযুর (আই.) এরপর ঈমানের অবস্থা ও ত্বাকওয়ার মান কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কতিপয় উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেন। তাঁর (আ.) ভাষ্যমতে ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত লাভ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা’লার পরিচয় লাভ না হয়। আর খোদা তা’লার পরিচয় তাঁর রহীমিয়্যত গুণের মাধ্যমে লাভ হওয়া সম্ভব। তিনি (আ.) বলেন, যে আল্লাহ্ তা’লার রহীমিয়্যত, ফযল ও কুদরতে বিশ্বাসী, তার কাছে ইহকাল কখনোই পরকালের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। মানুষের ঈমান দুই প্রকারের হয়ে থাকে; এক প্রকার ঈমান হল মৌখিক বা বুলিসর্বস্ব, মুখে আল্লাহ্ বা ঈশ্বরে বিশ্বাসের দাবী করা হয়, কিন্তু কর্মের মাধ্যমে এর প্রকাশ দেখা যায় না। দ্বিতীয় প্রকার ঈমান হল সেটি, যার প্রকাশ ব্যক্তির কর্মের মাধ্যমে দেখা যায়। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আমি বুঝি না এক ব্যক্তি আল্লাহ্‌র অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখার পর পাপ কীভাবে করে? প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ মানুষের ঈমান সেই প্রথম প্রকারের ঈমান, অর্থাৎ কেবলমাত্র মৌখিক ঈমান। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকে না, ব্যভিচারী দুষ্কর্ম করার সময় মুমিন থাকে না। অর্থাৎ যখন আল্লাহ্‌র বিশ্বাস মানুষের মনে থাকে তখন সে পাপ করতে পারে না। মানুষ পাপ তখনই করে যখন সে নিজেকে নির্জন বা একা মনে করে, আর এমন ব্যক্তি সেই মুহূর্তে মুমিন থাকে না, বরং নাস্তিক হয়ে যায়। যার মনে আল্লাহ্‌র ভয় থাকে যে তিনি সবকিছু দেখছেন এবং তাঁর কাছে সবকিছুর হিসাব দিতে হবে, সে কীভাবে কোন পাপে লিপ্ত হতে পারে?

হুযুর (আই.) বলেন, রমযানে ইবাদত ইত্যাদির মাধ্যমে একটি বিশেষ পুণ্যময় পরিবেশ তৈরি হয়, এই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে আত্মবিশ্লেষণ ও কর্মের সংশোধনের মাধ্যমে এই চেষ্টা করতে হবে যেন আমরা ত্বাকওয়া অর্জন করতে পারি; এটিই রমযানের উদ্দেশ্য। যখন ত্বাকওয়ায় মানুষ উন্নতি লাভ করে তখন তার ঈমানও উন্নত হয়। কুরআন ও ইসলামী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হল ত্বাকওয়া সৃষ্টি করা, অথচ আজ আমরা এটিরই শূন্যতা দেখতে পাই। হুযুর (আই.) আফগানিস্তানে সংঘটিত সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, এরা এই রমযান থেকে কীভাবে উপকৃত হতে পারে? ঈমানের মূল হল তাকওয়া ও পবিত্রতা, ত্বাকওয়া ছাড়া প্রকৃত ঈমান সৃষ্টি হতেই পারে না। ত্বাকওয়ার মাধ্যমে যে নিজের আত্মবিশ্লেষণ করতে থাকে, সে রিপুর তাড়না থেকে নিরাপদ থাকে, আর এটিই খোদার নৈকট্য লাভের উপায়। সূরা হা-মীম আস-সাজদার ৩১নং আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.) বর্ণনা করেন যে যারা ত্বাকওয়ার ভিত্তিতে ঈমানে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের উপর বিপদাপদ ও পরীক্ষার পাহাড় নেমে আসে, কিন্তু তারা এতদসত্ত্বেও ঈমানে অবিচল থাকে। তাদের এই নিষ্ঠার প্রতিদানে তাদের উপর আল্লাহ্‌র ফেরেশতারা নাযিল হন এবং তাদেরকে সাহস যোগান এবং এই পৃথিবীতেই একপ্রকার জান্নাতের সুসংবাদ তাদেরকে প্রদান করেন। তিনি (আ.) আরেক স্থানে ৩ ও ৪নং আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে সত্যিকার মুসলমানকে প্রথমদিকে ধৈর্য ধরতে হয়, কিন্তু ত্বাকওয়া অবলম্বনের ফলে আল্লাহ্ তার উদ্ধার পাবার কোন না কোন পথ অবশ্যই খুলে দেন, আর তাকে এমন স্থান থেকে রিযক দান করেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না। যদি ত্বাকওয়া না থাকে তবে শুকনো নামায-রোযা ইত্যাদি কোন মূল্যই রাখে না। আর ত্বাকওয়া অর্জন করতে হলে কেবল পাপ পরিহার করলেই চলবে না, বরং সাথে সাথে ভাল ও পুণ্য গুণাবলীও আত্মস্থ করতে হবে, আল্লাহ্ তা’লার সাথে প্রকৃত নিষ্ঠা এবং মানুষের প্রতি কোমল ও দয়ার্দ্র আচরণ ইত্যাদি সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। তিনি (আ.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা এই জামাতকে তাকওয়া প্রতিষ্ঠার জন্যই সৃষ্টি করেছেন, কেননা ত্বাকওয়ার ময়দান এখন একেবারেই শূন্য।

হুযুর (আই.) বলেন, অতএব আমাদের জীবনে আরেকটি রমযানের আগমন এবং আল্লাহ্ তা’লার একথা বলা যে রমযান আগমনের উদ্দেশ্যই হল তোমাদের মাঝে ত্বাকওয়া সৃষ্টি করা, আর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই কথা যে আল্লাহ্ তা’লা এই জামাতকে ত্বাকওয়া প্রতিষ্ঠার জন্যই সৃষ্টি করেছেন- এই সবগুলো বিষয় আমাদের উপর অনেক বড় দায়িত্ব ন্যস্ত করে। তা হল: আমরা যেন সবসময় আত্মবিশ্লেষণ করতে থাকি, এই দিনগুলোতে নিজেদের মাঝে যেন এমন পরিবর্তন সৃষ্টি করি এবং ত্বাকওয়ার এমন মানে অধিষ্ঠিত হবার চেষ্টা করি যা আল্লাহ্ তা’লা আমাদের কাছে চান; আর কেবল রমযানেই নয়, বরং রমযানের পরও যেন এই চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে আমরা নিজেদের জীবনের অংশ বানিয়ে নিই। হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন আমাদের সবাইকে এর তৌফিক দান করেন। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) কাদিয়ানের দরবেশ মোকাররম খাজা আহমদ হোসেন সাহেবের গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন যিনি গত ৩০শে মে ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। হুযুর (আই.) মরহুম বুযুর্গের সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন এবং তার পদমর্যাদায় উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন।