খেলাফত: মুমিনদের জন্য ঐশী ব্যবস্থাপনা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৬-মে, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৬শে মে, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্‌ মসজিদ থেকে “খেলাফত: মুমিনদেরর জন্য ঐশী ব্যবস্থপনা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) সূরা নূরের ৫৬নং আয়াত তেলাওয়াত করেন যার অনুবাদ হল-‘‘তোমাদের মাঝে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ্ তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে তাদের খলীফা বানাবেন যেভাবে তিনি তাদের পূর্ববর্তীদের খলীফা বানিয়েছিলেন। আর অবশ্যই তিনি তাদের জন্য তাদের ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দিবেন যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়ভীতির অবস্থার পর অবশ্যই তিনি তা নিরাপত্তায় বদলে দিবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার সাথে কাউকে শরীক সাব্যস্ত করবে না। আর এরপরও যারা অকৃতজ্ঞতা করবে তারাই দুষ্কৃতকারী।”

অতঃপর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, এই আয়াতের বিষয়বস্তু স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে যে ইসলামে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত থাকবে। হ্যাঁ, রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে মুসলমানদের কর্মকান্ডের ফলে একসময় তাদের কাছ থেকে এই নেয়ামত কেড়েও নেয়া হবে, কিন্তু ঈমান ও সৎকর্মের দাবী পূর্ণকারীদের এবং সর্বশেষ শরীয়ত ইসলামের অনুসরণকারীদের মাঝে নবুয়তের পদ্ধতিতে খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু মুসলমানদের অধিকাংশ আজ কুরআনের শিক্ষা এবং মহানবী (সা.)-এর বাণীকে সঠিকভাবে না বোঝার কারণে এটি জানে না যে এই খেলাফত কিভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, আর তাদের এক বিরাট অংশ একথা ঘোষণা দিয়ে থাকে যে মুসলমানদের মাঝে খেলাফতের কোন আবশ্যকতা নেই। মুসলমানদের একাংশ এই আয়াতটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে এখানে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীরা সম্বোধিত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনদের মাধ্যমেই এটি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, এখন কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন খেলাফত হবে না। এদের বিবেক একথা কিভাবে সায় দেয় যে মূসা (আ.)-এর পর তো চোদ্দশ’ বছর পর্যন্ত খেলাফত থাকল, কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল (সা.)-এর উম্মতে তা মাত্র ত্রিশ বছরের জন্যই নির্ধারিত ছিল? কিছু মুসলমান ভেবেছিল তাদের চেষ্টা-চরিত্রের মাধ্যমেই তারা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে, অথচ তারা এই আয়াতের দিকে দৃষ্টিই দেয় নি যে এটি ঈমান ও সৎকর্মের সাথে শর্তযুক্ত। আবার ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো ইসলামকে দুর্নাম করার জন্য এমন সংগঠনকে দাঁড় করিয়েছে যা খেলাফতের নামে পৃথিবীতে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির পর বর্তমানে বিলুপ্তির পথে রয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে হুযুর (আই.) যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে এই নৈরাজ্যবাদীদের করা সাম্প্রতিক হামলার উল্লেখ করে আক্রান্তদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, এদের এহেন কাজের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। এরপর হুযুর (আই.) বলেন, ইসলামের নামে এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে ইসলামকে যে এভাবে দুর্নাম করা হচ্ছে, এতে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হয় আহমদীরা। খেলাফতের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণে ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ আহমদীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি এবং আমরাই সমগ্র পৃথিবীতে মুসলমানদের প্রকৃত সমব্যথী, আর পৃথিবীতে ঈমান ও ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠার কাজ আজ মহানবী (সা.)-এর খাঁটি প্রেমিক মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর এই জামাতই করে চলেছে। বিভিন্ন কনফারেন্স ইত্যাদিতে যখন আমরা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা তুলে ধরি তখন বিধর্মীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে একথা স্বীকার করে যে ‘এটি যদি ইসলামের শিক্ষা হয়ে থাকে তবে এর সাথে আমাদের বিন্দুমাত্র বিরোধ নেই’।

হুযুর (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মান্যকারীদেরকে চরম অত্যাচার ও কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আজকাল আলজেরিয়াতে চরম কষ্টকর অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, সেখানে আহমদীদেরকে কারাগারে অন্তরীন রাখা হচ্ছে। সেটি একটি নতুন ও ছোট জামাত হওয়া সত্ত্বেও তাদের ঈমান অত্যন্ত দৃঢ় এবং অবিচল। হুযুর (আই.) সেখানকার দু’জন আহমদীর চিঠির উল্লেখ করেন যা থেকে তাদের দৃঢ়তা ও অবিচলতা প্রতিভাত হয়। বিরোধিরা বিভিন্নভাবে তাদেরকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে, আর আল্লাহ্ তা’লা উল্টো তা তাদের হৃদয়ের প্রশান্তির কারণে পরিণত করেছেন। আয়াতে ইস্তেখলাফে আল্লাহ্ তা’লা এটিই প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন যে তাদের ভয়ভীতির অবস্থাকে শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে দিবেন। হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন শীঘ্র তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেন। হুযুর (আই.) বলেন, খেলাফতে আহমদীয়ার প্রত্যেক খলীফার সময়েই ভয়ভীতির অবস্থার শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে যাবার আল্লাহ্ তা’লার এই প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়েছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আল-ওসীয়্যত পুস্তিকা থেকে ‘কুদরতে সানীয়া’ তথা খেলাফতের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বলিত অংশগুলো থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করে খেলাফতে আহমদীয়ার ক্ষেত্রে কিভাবে তা পূর্ণ হয়েছে তা-ও সংক্ষেপে উল্লেখ করেন, সাথে এটিও বলে দেন যে বিরুদ্ধবাদীরা যতদূর সাধ্যে কুলায় খেলাফতের ক্ষতি করার চেষ্টা করুক, তারা সর্বদা বিফলই হবে এবং খেলাফতে আহমদীয়া ক্রমাগত উন্নতিই করতে থাকবে। হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা প্রত্যেক আহমদীকে ঈমানে দৃঢ় হওয়ার, সৎকর্ম সম্পাদনকারী হবার এবং ইবাদতের মানকে উন্নত করার তৌফিক দান করুন, যেন তারা সেই উন্নতি অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আমীন।

খুতবার শেষে এসে হুযুর (আই.) একটি জানাযা হাযেরের উল্লেখ করেন যা মোকাররম চৌধুরী হামিদ আহমদ সাহেবের। তিনি সাত-আট বছর ধরে যুক্তরাজ্যেরই বাসিন্দা ছিলেন এবং গত ২০ মে তারিখে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। হুযুর (আই.) মরহুমের সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন এবং তার পদমর্যাদা উন্নত হবার জন্য দোয়া করেন।