ইসলামে পুরুষের দায়িত্বাবলী ও এগুলো পালনের গুরুত্ব
হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)
১৯-মে, ২০১৭
মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন
ডাউনলোড
জুমুআর খুতবার সারমর্ম
এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।
নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৯শে মে, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ্ মসজিদ থেকে “ইসলামে পুরুষের দায়িত্বাবলী ও এগুলো পালনের গুরুত্ব”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।
তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,
ইসলামের শিক্ষামালা যা মহানবী (সা.)-এর উপর নাযিল হয়েছে তা সর্বক্ষেত্রে আমাদের পথপ্রদর্শন করে। যদি আমাদের প্রত্যেকেই এই পথনির্দেশনা পালনকারী হয়, তবে এক সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর অমুসলিমরাও ইসলামের উপর আপত্তি উঠানোর পরিবর্তে মুসলমানদের সুন্দর আচরণের উদাহরণ দিত এবং ইসলামের মান্যকারী হয়ে যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল মুসলমানদের অধিকাংশ ইসলামের এসব শিক্ষাকে পড়েও, অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখেও, কিন্তু পালন করার বেলায় এগুলোকে উপেক্ষা করে যায়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাঝে উত্তম আদর্শ রয়েছে”। মহানবী (সা.)-এর জীবন পারিবারিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সামাজিক- সর্বক্ষেত্রে কুরআনের শিক্ষা পালনকারী ছিল। অতএব প্রকৃত সফলতা আমরা তখন অর্জন করতে পারব যখন সর্বক্ষেত্রে আমরা এই আদর্শকে সামনে রাখব। হুযুর (আই.) বলেন, কখনো কখনো দেখা যায় যে বড় বড় বিষয়ে তো ইসলামী শিক্ষা মেনে চলা হয়, কিন্তু বাহ্যত ছোট ছোট কিছু বিষয়কে উপেক্ষা করা হয়। অথচ মহানবী (সা.) এসব বিষয়ের প্রতি তাঁর কথার মাধ্যমেও এবং কাজের মাধ্যমেও অনেক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই আমরা যদি শান্তি চাই ও সফল হতে চাই এবং আল্লাহ্ তা’লার ফযলের অধিকারী হতে চাই তবে আমাদেরকে সেই আদর্শ অনুসরণ করতে হবে যা আমাদের নেতা ও মনিব মহানবী (সা.) সর্বক্ষেত্রে প্রদান করেছেন এবং এ যুগে মসীহ্ মওউদ (আ.) আরও স্পষ্টভাবে তা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
হুযুর (আই.) পুরুষদের বিভিন্ন অবস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের উপর যেসব দায়িত্ব ন্যস্ত হয় সেগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পরিবারের প্রধান হিসেবে কিছু দায়িত্ব আছে, স্বামী হিসেবেও কিছু দায়িত্ব আছে, পিতা বা পুত্র হিসেবেও কিছু দায়িত্ব আছে। যদি প্রত্যেক পুরুষ নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তা পালনের চেষ্টা করে, তবে এটি সমাজের অধিকাংশ ক্ষেত্রে শান্তি, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণ হতে পারে এবং সন্তানদের তরবিয়তেরও কারণ হতে পারে।
হুযুর (আই.) বলেন, আজকাল কতক পুরুষ পরিবারের প্রধান হবার দম্ভে স্ত্রীদের সাথেও সদ্ব্যবহার করে না, সন্তানদের তরবিয়তের দায়িত্বও পালন করে না, অথচ মুখে প্রধান হবার দাবী ঠিকই আছে; বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা স্ত্রীদের উপর স্বামীদের এবং সন্তানদের উপর পিতাদের অত্যাচারের অভিযোগের কথা বলেন। হুযুর (আই.) বলেন, যদি মসীহ্ মওউদ (আ:)-কে মানার পরও সেসব মূর্খ লোকদের মতই জীবন যাপন করে যাদের সাথে ধর্ম-কর্মের কোন সম্পর্ক নেই, তবে তাঁর হাতে বয়আত করা বৃথা। হুযুর (আই.) প্রশ্ন তোলেন যে পুরুষরা কি আল্লাহ্র অধিকার আদায় এবং উন্নত আদর্শ প্রদর্শনের দায়িত্ব পালন করছে? যদি তা করে তবে তো এমনটি হওয়ারই কথা নয়। মহানবী (সা.)-এর আদর্শ উল্লেখ করেন, যে কিভাবে তিনি (সা.) নম্রতার সাথে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এসব বিষয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি (সা.) নিজে অনেক আগেই তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন, আর ভোর হবার কিছু পূর্বে তাঁর স্ত্রীদেরও জাগাতেন যেন তারাও নফল পড়তে পারেন, যতক্ষণ ঘরে থাকতেন ঘরের কাজ করতেন ও তাদের সাহায্য করতেন, ছোট ছোট কাজ যা স্ত্রীদের দায়িত্ব সেগুলোও নিজে করতেন। হুযুর (আই.) বলেন, এই আদর্শ সামনে রেখে পুরুষদের আত্মজিজ্ঞাসা করা দরকার যে তারা এমন করছে কি-না। মহানবী (সা.) বলেন যে ‘তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে যে তার স্ত্রীর সাথে উত্তম আচরণ করে’। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, পুরুষ হয়ে নারীদের সাথে যুদ্ধ করা তো নিতান্ত লজ্জার কথা; পুরুষ হওয়াটা আমাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ, এর প্রতিদানে নারীদের সাথে নম্র আচরণ করা আমাদের কর্তব্য। মহানবী (সা.)-ও বলেছেন, যারা স্ত্রীর উপর হাত তোলে, তাদের ঈমান পরিপূর্ণ নয়। হুযুর (আই.) বলেন, এসব বিষয় বাহ্যত তুচ্ছ মনে হলেও এগুলো প্রকৃতপক্ষে অনেক বড় বিষয়। হুযুর (আই.) বলেন, কেউ কেউ বলেন যে স্ত্রীর অমুক অপরাধের জন্য তার সাথে একটু কঠোরতা করতে হয়েছে। এদের জন্য হুযুর (আই.) মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বরাতে বলেন, আগে পুরুষদের নিজেদের পুণ্যবান হতে হবে, তাহলে স্ত্রীও পুণ্যবতী হবে। মুখের কথা দিয়ে নয় বরং নিজের আচরণ দিয়ে তাদের তরবিয়ত করতে হবে। যদি স্বামী নিজে রাতে উঠে কেঁদে কেঁদে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করে, তবে স্ত্রী কয়েকদিন দেখার পর নিজেই প্রভাবিত হবে। মসীহ্ মওউদ (আ.) এ-ও বলেন যে পুরুষ ঘরের ইমাম, যদি তার মাঝে কোন ত্রুটি থাকে তবে তা ঘরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। হুযুর (আই.) ভারত ও পাকিস্তানসহ সব দেশের ব্যবস্থাপনাকে এসব বিষয়ে ফলপ্রসূ তরবিয়তি প্রোগ্রাম গ্রহণের নির্দেশ দেন এবং বলেন যে এটি ঠিক না হলে তবলীগ ইত্যাদি কাজে কোনই প্রভাব সৃষ্টি হবে না। নারীদের অধিকার প্রসঙ্গেও ইসলামী শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্ব হুযুর (আই.) তুলে ধরেন। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভাষ্য হুযুর (আই.) তুলে ধরেন যে তাদের সম্পর্ক অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হওয়া উচিত, প্রভু-ভৃত্যের মত নয়।
সন্তানদের তরবিয়তের ক্ষেত্রেও পিতাদের ভূমিকার কথা হুযুর (আই.) তুলে ধরে বলেন, তরবিয়ত যদিও মূলত মায়েরাই করে থাকেন, কিন্তু পিতাদেরও এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে। ছেলেরা তাদের পিতাদের আদর্শ অনুকরণ করে থাকে। বাবাদের একদিকে যেমন সন্তানদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করতে হবে, একইসাথে তাদের প্রতি গভীর লক্ষ্যও রাখতে হবে। তাদের তরবিয়তের জন্য অনেক দোয়াও করতে হবে, কারণ প্রকৃত তরবিয়ত তো আল্লাহ্র কাজ, তিনিই হেদায়েত দান করেন। মসীহ্ মওউদ (আ:) বলেন, অনেক পিতা সন্তানের জন্য সম্পদ রেখে যাওয়াকে জরুরী মনে করে, কিন্তু সন্তান পুণ্যবান হবার জন্য দোয়া করে না। এটা ভাবে না যে যদি সন্তান পুণ্যবান হয় তবে আল্লাহ্ স্বয়ং তার অভিভাবক হয়ে যান। তাই সন্তানের জন্য দোয়া করা এক অত্যাবশ্যক দায়িত্ব।
হুযুর (আই.) বলেন, পিতা-মাতার দায়িত্ব উল্লেখের সাথে সাথে ইসলাম সন্তানদের উপরও কিছু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। পিতা-মাতার সেবা করা, তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা চাওয়া, তাদের প্রতিশ্রুতিসমূহ পূর্ণ করা, তাদের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সদাচরণ ইত্যাদি সন্তানদের কর্তব্য। ধর্মীয় কারণে মতবিরোধ থাকলেও তাদের জন্য অনেক অনেক দোয়া করা সন্তানের দায়িত্ব, এ প্রসঙ্গে ইব্রাহীম (আ.)-এর আদর্শও হুযুর (আই.) তুলে ধরেন।
হুযুর (আই.) বলেন, বিভিন্ন অবস্থান থেকে একজন পুরুষের যেসব দায়িত্ব রয়েছে তার তা পালন করার চেষ্টা করা উচিত, নিজের ঘরকে এমন দৃষ্টান্ত বানানো উচিত যেখানে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় থাকে। স্বামী, পিতা ও পুত্র-এই তিন দৃষ্টিকোণ থেকে একজন পুরুষের নিজ দায়িত্বাবলী বিশেষভাবে পালনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন সবাইকে সেই তৌফিক প্রদান করেন। আমীন।