আল্লাহ্ তা’লার সাত্তার ও গাফ্‌ফার গুণাবলী

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

৩১-মার্চ, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৩১শে মার্চ, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “আল্লাহ্ তা’লার সাত্তার ও গাফ্‌ফার গুণাবলী”- বর্ণনা করে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যে সবদিক থেকে সকল দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে। আল্লাহ্ তা’লার একটি গুণ হল তিনি সাত্তার, যিনি আমাদের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখেন। যদি তিনি এরূপ না করতেন, তবে আমাদের কেউই মুখ দেখাতে পারতো না। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে নিজ করুণার বশে এটি শিখিয়েছেন যে, তোমরা নিজ দোষ-ত্রুটি, আলস্য থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা কর, এবং একইসাথে ইস্তেগফার কর, তাহলে আমি তোমাদের দুর্বলতা ঢেকে রাখব ও তোমাদের দোয়া গ্রহণ করব। ‘গাফ্‌ফার’ মানে ঢেকে রাখা বা লুকিয়ে রাখা, আর আল্লাহ্ হলেন গাফ্‌ফার, সাত্তার শব্দের মানেও এর অনুরূপ। আল্লাহ্ তাঁর বান্দার তওবা গ্রহণ করেন, তার পাপ ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের বৈশিষ্ট্য হল- যখন একজন আরেকজনের কোন অপরাধ দেখতে পায়, তা সে নিজ ভাই-ই হোক বা অন্য কোন নিকটাত্মীয়ই হোক, আর সেই অপরাধী ব্যক্তি যদি সেই অপরাধ ছেড়েও দিয়ে থাকে, তবুও সেই প্রথম ব্যক্তি তাকে অপরাধীই মনে করে ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। অথচ আল্লাহ্ তা’লা বান্দাকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষমা করে দেন ও তার দুর্বলতা ঢেকে রাখেন। আল্লাহ্ তা’লা যদি মানুষের অপরাধ ধরতে আরম্ভ করেন তাহলে সবাইকে ধ্বংস করে দিতে পারেন, কিন্তু তাঁর দয়া ও কৃপা সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে। অতএব আমরাও যদি আল্লাহ্‌র রঙে রঙিন হবার চেষ্টা করি, যদি অন্যদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে না বেড়াই, তাহলে শান্তি-সম্প্রীতি ও ভালবাসাপূর্ণ এক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

হুযুর (আই.) বলেন, এমন অনেক ব্যক্তি আছে যারা অন্যের দোষ-ত্রুটি ঢেকে তো রাখেই না, বরং তা খুঁজে বেড়ায় ও অন্যের কাছে তা বলে বেড়ায়। যখন তাদেরকে এর জন্য জিজ্ঞাসা করা হয় তখন বলে যে এটা তো সামান্য একটি বিষয়, আমরা তো এমনিই এমনিই তা বলেছি। অথচ যখন তাদের এমন কোন দোষ-ত্রুটি কেউ প্রকাশ করে তখন রেগে গিয়ে তাকে মারতে উদ্যত হয়। অতএব এ বিষয়ে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর শিক্ষা অনুসরণ করা উচিত যে ‘নিজের জন্য যা পছন্দ কর, তোমার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ কর।’

হুযুর (আই.) বলেন, কেউ কেউ বলে যে যদি আমরা কারো দোষ-ত্রুটি না-ই বলি তাহলে তার সংশোধন কিভাবে হবে? সবসময় মনে রাখা উচিত যে যদি কারো কোন দুর্বলতা জামাতের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে বা সমাজের এক শ্রেণিকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাহলে যাদের উপর জামাতের সংশোধনের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে অর্থাৎ আমীর বা প্রেসিডেন্ট, তাদের কাছে এই কথা পৌঁছে দিন, অথবা আমাকে লিখে পাঠান; যাতে করে সংশোধনের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করা যায়। আল্লাহ্ তা’লাও চান না যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামাতের ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যাক বা সমাজের নোংরামি এতে বাসা বাঁধুক। আল্লাহ্ তা’লাও ততক্ষণ বান্দার দুর্বলতা ঢেকে রাখেন যতক্ষণ সে নিজে তা প্রকাশ না করে বা সীমাতিক্রম না করে, কিন্তু যখন সে পাপে হঠকারি হয়ে যায় তখন আল্লাহ্ও তার পাপ প্রকাশ করে দেন। কিন্তু কারো অন্যায় দেখে তা মানুষের মাঝে প্রচার করে বেড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, কারণ এতে করে নোংরামি দূর হবার পরিবর্তে তা আরও প্রসার লাভ করে। এ বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর বাণীকে সামনে রাখতে হবে। তিনি (সা.) বলেন, যদি তুমি মানুষের দুর্বলতা খুঁজে বেড়াতে আরম্ভ কর তবে তুমি তাদেরকে ধ্বংস করবে, অর্থাৎ বিভিন্ন জায়গায় তাদের দুর্বলতা বলে বেড়ানো এবং অনুসন্ধান করে তাদের দুর্বলতা খোঁজা। যদি এমনটি করা হয় তাহলে মানুষ সংশোধনের পরিবর্তে পাপে আরও জেদি বা হঠকারি হয়ে ওঠে, তাদের মধ্যে পর্দা বা লজ্জা আর থাকে না; আর যখন পর্দা বা লজ্জা থাকে না তখন সংশোধন হওয়াই আর সম্ভব থাকে না।

হুযুর (আই.) বিশেষভাবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যাদের উপর জামাতের সংশোধনের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে, বিশেষভাবে ইসলাহ কমিটি, তারা যেন অত্যন্ত সাবধানতার সাথে সংশোধনের দায়িত্ব পালন করেন। কোন ব্যক্তির মাঝে কখনো যেন এই অনুভূতি সৃষ্টি না হয় যে অমুক কর্মকর্তার কারণে মানুষের মাঝে আমার দুর্বলতার কথা ছড়িয়ে পড়েছে। এমনটি হলে এর প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে থাকে। এমন কর্মকর্তারা একদিকে যেমন দুর্বলতার কথা প্রচার করার কারণে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে, অন্যদিকে তারা আল্লাহ্‌র অসন্তুষ্টিও অর্জন করে বসে। আল্লাহ্ তাদেরকে বলবেন যে আমি তো তোমাদেরকে এজন্য জামাতের দায়িত্বে বসিয়েছিলাম যেন তোমরা আমার রঙে রঙিন হও, কিন্তু তোমরা তো আমার সাত্তার বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে গিয়ে আমার বান্দাদের মাঝে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছ।

হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা সাত্তারিয়্যতকে কতটা পছন্দ করেন তা বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের দোষ ঢেকে রাখে আল্লাহ্ তা’লা কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন, আর যে তার মুসলমান ভাইয়ের দোষ প্রকাশ করে দেয় কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ও তার দোষ প্রকাশ করে দিবেন।’ অতএব একদিকে ইস্তেগফার করা উচিত, অন্যদিকে অন্যের দোষ-ত্রুটিও ঢেকে রাখা উচিত, আর ভাবা উচিত যে আমি নিজে কী অবস্থায় রয়েছি। আল্লাহ্ তা’লা যেমন আমার দুর্বলতা ঢেকে রেখেছেন, আমারও তেমনই করা উচিত। সার্বিকভাবে ‘তাখাল্লাকু বিআখলাকিল্লাহ’ অবলম্বন করা উচিত অর্থাৎ আল্লাহ্‌র রঙে রঙিন হওয়ার চেষ্টা করা উচিত, ক্ষমা-দয়া-সাত্তারি ইত্যাদি সব বিষয় অবলম্বন করা উচিত।

হুযুর (আই.) বলেন, মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের সময় আমরা এই ওয়াদা করেছি যে হাত বা জিহ্বা দ্বারা কাউকে কোন কষ্ট প্রদান করব না। মনে রাখতে হবে, জিহ্বা বা কথা দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত অনেক বেশিদিন স্থায়ী হয়। হুযুর (আই.) বলেন, সহানুভূতির আরেকটি দাবী হল- নিজ ভাইয়ের সংশোধনের চেষ্টা করা যেন তার মাঝ থেকে সেই দোষ দূরীভূত হয় এবং সমাজ সেই নোংরামি থেকে মুক্ত থাকে। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, এজন্য তাকে গোপনে ও লোকচক্ষুর আড়ালে নসীহত করা উচিত। সে যদি তা না মানে, তবে তার জন্য দোয়া কর। এতেও যদি কাজ না হয়, তবে এটিকে খোদার তকদীর হিসেবে মেনে নাও। এমন ক্ষেত্রে রাগ দেখানো উচিত নয়। যেহেতু সে মসীহ্ মওউদের হাতে বয়আত করেছে, তাই বুঝতে হবে আল্লাহ্ কোন এক কারণে তাকে কবুল করেছেন; হতে পারে যে পরে কোন এক সময় তার সংশোধন হয়ে যাবে।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আমার কথার মানে এই নয় যে দোষ-ত্রুটি বা পাপকে সমর্থন কর, অমুকের মাঝে অমুক-অমুক দোষ আছে- এটি খুব ভাল কথা; বরং এর অর্থ হল তার দোষ দেখে সেটি প্রচার করে বেড়াবে না, সামনেও না, পিছনেও না। কেননা আল্লাহ্‌র কিতাব অনুসারে এটি একটি পাপ, অর্থাৎ এটি গীবত যা কুরআনে পাপ হিসেবে আখ্যায়িত।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আমাদের জামাতের উচিত কোন ভাইয়ের দুর্বলতা দেখে তার জন্য দোয়া করা, কিন্তু যদি সে দোয়া না করে তা প্রচার করে বেড়ায় তবে সে পাপ করে। হুযুর (আই.) বলেন, এমন কোন্ দোষ রয়েছে যা দূর হতে পারে না? তাই সবসময় দোয়ার মাধ্যমে অন্য ভাইয়ের সাহায্য করা উচিত। যদি আমরা কোন ভাইয়ের দোষ খুঁজে বের না করি, আর যে দোষ জেনে ফেলেছি তা প্রচার না করে তার জন্য দোয়া করি, তবেই আমরা সেই প্রকৃত ঐশী জামাতে পরিণত হতে পারব যা মসীহ্ মওউদ (আ.) গঠন করতে চেয়েছেন। আর এটিই আমাদের ক্ষমা লাভেরও কারণ হবে। হুযুর (আই.) আল্লাহ্ তা’লার ক্ষমা ও মার্জনা লাভের জন্য মহানবী (সা.) যে দোয়া শিখিয়েছেন তা উল্লেখ করেন এবং দোয়া করেন যে আমরা যেন আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনকারী হতে পারি। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) একটি গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন। জানাযাটি মোকাররম মালেক সালিম লতীফ সাহেব, যিনি নানকানা সাহেবের বাসিন্দা ছিলেন এবং পেশায় এডভোকেট ছিলেন, তাকে গত ৩০শে মার্চ ২০১৭ তারিখে গুলি করে শহীদ করা হয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজিউন। হুযুর (আই.) শহীদ মরহুমের সংক্ষিপ্ত যিকরে খায়ের করেন এবং তার আধ্যাত্মিক পদমর্যাদা উন্নত হবার জন্য দোয়া করেন।