আহমদীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও সহিংসতা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৭-মার্চ, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৭ই মার্চ, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “আহমদীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও সহিংসতা”- বর্ণনা করে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

আজকাল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মুসলমানদের অভিবাসন নীতিতে কঠোরতা দেখাচ্ছে। তারা কারণ হিসেবে বলছে যে মুসলমানরা আমাদের সাথে মিলেমিশে থাকতে পারে না, কারণ ইসলাম উগ্রতা ও সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয়; এখানে যদি তারা থাকতে চায় তাহলে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় রীতি-নীতি ছেড়ে দিয়ে আমাদের মত হয়ে থাকতে হবে, যদি তারা তা না করে তবে তারা আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। আবার তারা একথাও বলে যে মুসলমান দেশগুলোতে উগ্রতা ও বে-আইনী কর্মকান্ড করার প্রবণতা রয়েছে এবং তাদের কারণেই আমাদের এখানেও সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে। হুযুর তাদের প্রথম দাবীটিকে নিতান্তই অযৌক্তিক ও অবান্তর আখ্যা দিলেও দ্বিতীয় দাবী প্রসঙ্গে বলেন, দুঃখজনক হলেও তাদের এই দাবীটি সঠিক। কিন্তু একথাও খতিয়ে দেখতে হবে যে মুসলমান দেশগুলোর এই অবস্থা পশ্চিমাদেরই সৃষ্ট; তারাই একদিকে অস্ত্র ও অর্থ দ্বারা সাহায্য করে সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহীদের সংগঠিত করছে, অন্যদিকে সরকারকেও একইভাবে সাহায্য করে যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলাকে দীর্ঘায়িত করছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যখনই মুসলমানদের ক্ষতি হয়েছে তা মুসলমানদের নিজেদের কর্মকান্ড, ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধি, পরস্পরের অধিকার প্রদান না করা, ব্যক্তি স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের উপর প্রাধান্য প্রদান, ইসলামী শিক্ষামালাকে ভুলে যাওয়া, আধ্যাত্মিকতা অর্জনের পরিবর্তে জাগতিকতার লালসায় মত্ত হওয়া, আলেম-উলামা কর্তৃক উম্মতকে পথ-প্রদর্শনের পরিবর্তে পথভ্রষ্ট করা ইত্যাদি কারণে হয়েছে। হুযুর (আই.) বলেন, এসব পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে মুসলমানদের উচিত ছিল এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতির দিকে লক্ষ্য করা যে এমন পরিস্থিতিতে হারানো ঈমানকে পুনরুদ্ধার করার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে ইমাম মাহ্‌দী আসবেন। সেটিতো তারা করেই নি, বরং নিজেদের দেশেও যুগ ইমামের বিরোধিতা করেছে, আর অমুসলিম দেশগুলোতেও গিয়ে তাঁর (আ.) জামাতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছে ও বিষ-বাষ্প ছড়িয়েছে। পাকিস্তানে তো সরকারিভাবে আহমদীদের অত্যাচার করা হয়েছে ও হচ্ছে, আজকাল আলজেরিয়াতেও এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এবং বর্তমানে সেখানে দুই শতাধিক আহমদী জেলে আটক রয়েছেন। আহমদীরা তো শত অত্যাচার সত্ত্বেও ঈমান থেকে এবং আল্লাহ্ ও রসূল (সা.)-এর নির্দেশ পালনে পিছপা হবার নয়, কিন্তু যারা আল্লাহ্ ও রসূলের নামে এসব অত্যাচার চালাচ্ছে তাদের ভাবা উচিত যে এই মযলুমদের দোয়া আল্লাহ্‌র দরবার পর্যন্ত পেীঁছাচ্ছে এবং যখন আল্লাহ্‌র শাস্তি তাদের উপর নেমে আসবে তখন তাদের ইহকাল ও পরকাল উভয়কেই ধ্বংস করে ছাড়বে। হুযুর বলেন, তাদের ভেবে দেখা উচিত যে ইসলামের অনিন্দ্য-সুন্দর শিক্ষাকে যে তারা দুর্নাম করছে- এটিই কি তাদের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল? ইসলামের কি সুন্দর যুক্তি-প্রমাণ নেই? অন্য ধর্মের নারী-শিশুদের রক্তপাতের মাধ্যমেই কি ইসলামের বিজয় অর্জিত হবে? আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন যে ইসলাম সারা বিশ্বে জয়ী হবে ও সম্মান লাভ করবে, কিন্তু তাদের কারণে তো ইসলাম কেবলই দুর্নাম হচ্ছে। আরেকদল মুসলমানের অবস্থা হল যে তারা মোল্লাদের আচরণ দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বা উন্নত বিশ্বে এসে এখানকার চাকচিক্য দেখে ইসলামী শিক্ষা ও রীতি-নীতিকেই ছেড়ে দিয়েছে ও ইসলামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এককথায় মুসলমানদের এমন প্রত্যেক শ্রেণীই ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়েছে, এরা সবাই নামমাত্র মুসলমান। হুযুর (আই.) বলেন, এমন অবস্থায় আহমদীদের উপর অনেক গুরুভার ন্যস্ত হয়। একদিকে ধর্ম-ব্যবসায়ী মোল্লারা আমাদের বিরোধিতা করছে, আর জাগতিকতার পূজারী ও নাস্তিকরাও করবে। প্রশ্ন হল, এসব পরিস্থিতিতে কি আমরা ভীত হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেব, বা তাদের কথায় সায় দেব? যদি এমনটিই করি, তাহলে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করে লাভ কী?

মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন যে নিজেদের ঈমানকেও বিনষ্ট হতে দেয়া যাবে না, আর নৈরাজ্যও সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না; আর ইসলামের শিক্ষা ও তওহীদকেও পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ বিষয়ে কুরআনের এই শিক্ষাকে অনুসরণ করতে হবে যে ‘উদ্’উ ইলা সাবীলি রাব্বিকা বিল হিকমাতি ওয়াল মাওইযাতিল হাসানাতি ওয়া জাদিলহুম বিল্লাতি হিয়া আহসান’ অর্থাৎ ‘তোমার প্রভুর পথের দিকে প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে ডাক, এমন যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে তাদের সাথে তর্ক কর যা হবে সর্বোত্তম।’ অতএব, ইসলামী শিক্ষার প্রচারের জন্য উত্তম যুক্তি প্রয়োজন, তরবারির মাধ্যমে ইসলাম প্রচারিত হবে না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে বস্তুবাদী জগতের চরিত্রবিধ্বংসী আইন-কানুনের বিপক্ষেও কিছু বলা যাবে না; তাদের সাথেও যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে লড়তে হবে। মুমিনকে ভীরুতা ও প্রজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য করা জানতে হবে। কুরআন তো বলেছে যে ধর্মে বলপ্রয়োগ নেই, কিন্তু একইসাথে প্রজ্ঞা ও যুক্তির মাধ্যমে অন্যায়ের সাথে লড়াই করারও নির্দেশ দিয়েছে। অতএব, বস্তুবাদীদের অনাচার ও দুরাচারকে অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে আমাদেরই প্রতিহত করতে হবে।

হুযুর (আই.) বলেন, ইসলাম বিরোধীরা যখন আহমদীদের কাছে ইসলামের সুন্দর শিক্ষা শোনে তখন তারা ইসলামের বিরোধিতা করার জন্য এই যুক্তি দাঁড় করায় যে যেহেতু তোমরা অধিকাংশ মুসলমানদের দৃষ্টিতে মুসলমান নও, তাই তোমরা যা উপস্থাপন করছ তাকে আমরা সঠিক ইসলাম বলে মেনে নেব না এবং ইসলামের বিরোধিতা করতেই থাকব। আর মোল্লারাও এক দল যদিও অন্য দলের রক্তপিপাসু, কিন্তু আহমদীদের বিরুদ্ধে এরা ঐক্যবদ্ধ। অতএব, এই যাবতীয় বাধা-বিঘ্ন ডিঙিয়ে আমাদের প্রকৃত ইসলাম প্রচার করতে হবে। এসব দেশে সঠিক ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব না মোল্লারা করতে পারবে, না হীনম্মন্যতার শিকার ধর্মীয় শিক্ষাত্যাগকারী ভীরু মুসলমানরা করতে পারবে। এই কাজ কেবল আহমদী জামাতের অদৃষ্টেই লেখা আছে। তাই আমাদের অনেক সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে। মসীহ্ মওউদ (আ.) এটি করার যে পন্থা আমাদের বলে দিয়েছেন তা হল প্রথমত আমাদেরকে প্রকৃত মুসলমানের ব্যবহারিক দৃষ্টান্তে পরিণত হতে হবে, দ্বিতীয়ত ইসলামের সৌন্দর্য ও উৎকৃষ্ট দিকগুলো পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে তা প্রচার করা। হুযুর (আই.) দোয়া করেন যে আল্লাহ্ তা’লা যেন আমাদেরকে এই তৌফিক দান করেন। আমীন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) তিনটি গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন। প্রথমটি মোকাররম মাওলানা হাকীম মোহাম্মদ দীন সাহেবের যিনি কাদিয়ান নিবাসী ছিলেন এবং গত ১৫ মার্চ ৯৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দ্বিতীয় জানাযা মোকাররম ফযলে এলাহী আনোয়ার সাহেবের যিনি গত ৪ মার্চ ৯০ বছর বয়সে জার্মানিতে ইন্তেকাল করেন। তৃতীয় জন মোকাররম ইব্রাহীম বিন আব্দুল্লাহ সাহেব, যিনি মরক্কোতে গত ১০ মার্চ ৮১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হুযুর (আই.) মরহুমদের যিকরে খায়েরও করেন এবং তাদের আধ্যাত্মিক পদমর্যাদায় উন্নীত হবার জন্য দোয়া করেন।