দোয়া, ইস্তেগফার ও সদকা-খয়রাত

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৪-ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৪শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “দোয়া, ইস্তেগফার ও সদকা-খয়রাত”-এর গুরুত্ব বর্ণনা করে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

আজকাল পৃথিবীর সর্বত্র নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান, আর ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো এর দায় মুসলমানদের উপর চাপায়। যদিও একথা ঠিক যে কতিপয় মুসলমান সংগঠন বিভিন্ন দেশে নানারকম নৈরাজ্যমূলক ও বর্বরোচিত কর্মকান্ড করছে, কিন্তু ইসলামের শিক্ষার সাথে এর দূরতম সম্পর্ক নেই। আর এর পেছনে ইসলামবিরোধিদেরই এক গভীর ষড়যন্ত্র কার্যকর রয়েছে, তারাই তাদের নীলনকশা অনুসারে মুসলমানদের মাঝে এরূপ অবস্থা সৃষ্টি করছে। কতিপয় স্বার্থপর মুসলমান ও মুনাফেকদের কারণে ইসলামের এই অবস্থা হয়েছে। মুসলমানদের ভুল কাজের কারণে তারা ইসলামকে দুর্নাম করার সুযোগ পাচ্ছে, আর এর পরিণামে আহমদীরাও মুসলমান হিসেবে এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। যদিও যারা আহমদীদেরকে চেনে, তারা ভালভাবেই জানে যে আহমদীয়াত শান্তি-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কাজই করে যাচ্ছে; কিন্তু সাধারণ মানুষ আমাদেরকেও তেমনই মনে করে যেমনটি মিডিয়ার অপপ্রচারের জন্য তারা অন্য মুসলমানদেরকে মনে করে। ফলে পাশ্চাত্যেও আমরা মুসলমান হিসেবে এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, আর আহমদী হিসেবে মুসলমান দেশগুলোতেও আমরা বিভিন্ন অত্যাচার ও আক্রমণের শিকার। পাকিস্তানে তো পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ যে মৌলভীদের হুমকিতে ভীত হয়ে আদালতও অন্যায় রায় প্রদান করে, আজকাল আলজেরিয়াতেও এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে; বর্তমানে সেখানে ১৬জন আহমদী মোল্লাদের মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে কারাভোগ করছেন। আমাদের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা বা অঢেল সম্পদ- এমন কোন জাগতিক উপকরণই নেই। হ্যাঁ, একটি উপায় আমাদের কাছে আছে, আর তা হল ইবাদত, সদকা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তা’লার নৈকট্য অর্জন করা; এটি অর্জিত হলে আল্লাহ্‌র দয়ায় আমরা তাঁর নিরাপত্তায় আশ্রয় লাভ করব। হুযুর (আই.) বলেন, ইবাদতের মধ্যে প্রধান হল নামায; এটি সম্পর্কে আমি বিগত কিছু খুতবায় বলেছি, আজ সদকা ও ইস্তেগফার সম্পর্কে কিছু বলব যে এগুলো কিভাবে আল্লাহ্‌ তা’লার দয়া লাভের মাধ্যম হয়।

হুযুর (আই.) বলেন, মানুষের মাঝে অসংখ্য দুর্বলতা থাকে, কখনো পার্থিব কাজের ব্যস্ততার কারণে ইবাদত তথা নামায পড়ার দায়িত্ব পালন করা হয় না, বিপদাপদে না পড়লে সদকার প্রতিও মনোযোগ থাকে না, ইস্তেগফারের প্রতি যতটা মনোযোগ থাকা উচিত ততটা থাকে না। যদি আল্লাহ্‌র কৃপা লাভ করতে হয়, তাঁর দয়া ও করুণাকে উদ্বেলিত করতে হয় এবং শত্রু ও বিরুদ্ধবাদীদের অপচেষ্টাকে বিফল করতে হয়, তাহলে আমাদের অবশ্যই এসব কাজের প্রতি মনোযোগী হতে হবে যা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও ক্ষমা লাভের মাধ্যম। হুযুর (আই.) সূরা তাওবার ১০৪নং আয়াত উল্লেখ করেন যেখানে আল্লাহ্‌ তা’লা বলেন: ‘আলাম ইয়া’লামূ আন্নাল্লাহা হুয়া ইয়াকবালুত্তাওবাতা ’আন ’ইবাদিহী ওয়া ইয়া’খুযুস্সাকাতি ওয়া আন্নাল্লাহা হুয়াত্তাওয়াবুর রাহীম’ অর্থাৎ ‘তারা কি জানে না যে নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং সদকা-খয়রাত ও আর্থিক কুরবানীকে গ্রহণযোগ্যতা দান করেন, আর আল্লাহ্ই তওবা গ্রহণকারী ও বারবার কৃপাকারী’। এ বিষয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একবার বলেন, সদকা ‘সিদক’ শব্দ থেকে উদ্ভূত; যখন কেউ সদকা করে তখন বোঝা যায় যে আল্লাহ্‌র প্রতি তার নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা রয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হল দোয়া, এর ফলে হৃদয় বিগলিত হয়; এর মাঝেও এক কুরবানী অন্তর্নিহিত আছে। যদি কেউ ‘সিদক’ এবং দোয়া দুটিই লাভ করে, তবে তা যাবতীয় সমস্যার এক মোক্ষম চিকিৎসা হিসেবে কাজ করে। ইস্তেগফারও এক প্রকার দোয়া; যদি বিগলিত হৃদয় নিয়ে তা পড়া না হয় আর মন অন্যকোথাও পড়ে থাকে, তবে শুধু মুখে অজস্রবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ্’ বললেও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না। আল্লাহ্ তা’লা দোয়া গ্রহণ করেন, সদকা-খয়রাতকেও গ্রহণযোগ্যতার মর্যাদা দান করেন, বিশেষভাবে বান্দা যখন এর সাথে তওবাও করে অর্থাৎ ভবিষ্যতে পাপ থেকে বেঁচে থাকার পূর্ণ প্রচেষ্টা করার প্রতিজ্ঞাও করে। যদি এসব কাজ নিষ্ঠার সাথে করা হয় তাহলে মহানবী (সা.) আমাদের আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে জানিয়েছেন যে বান্দা আল্লাহ্‌র দিকে একপা অগ্রসর হলে আল্লাহ্ তার দিকে দুই পা এগিয়ে আসেন, বান্দা দ্রুত তাঁর দিকে অগ্রসর হলে তিনি তার কাছে ছুটে আসেন। মহানবী (সা.) এ-ও বলেছেন যে আল্লাহ্ তা’লা অত্যন্ত লজ্জাশীল, উদার ও দানশীল; যখন বান্দা তাঁর কাছে প্রার্থনার হাত উঠায় তিনি তাকে খালিহাতে ফেরত পাঠাতে লজ্জা বোধ করেন। অতএব আমাদের এগুলোর উপর বিশ্বাস রাখতে হবে যে এরূপ করলে আল্লাহ্ অবশ্যই আমাদের সমস্যা ও বিপদ দূর করে দিবেন; কিন্তু এর পিছনে শর্ত হল এগুলো যেন লোকদেখানো কাজ না হয়, বরং নিষ্ঠাপূর্ণ হয়। আল্লাহ্ বান্দার প্রতি কতটা দয়াশীল তা হাদীস থেকে জানা যায়। মহানবী (সা.) বলেন, কেউ যদি গরীব ও সদকা-খয়রাত করতে অসমর্থ হয়, আর সে যদি পুণ্যকথা মেনে চলে এবং পাপকাজ এড়িয়ে চলে, তাহলে তার এরূপ কাজই স্বচ্ছল ব্যক্তির সদকা-খয়রাতের মত পুণ্যের কারণ হবে। মোটকথা, নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্‌র ইবাদত ও দোয়া করা এবং একক ও দলগতভাবে সদকা-খয়রাত করা বিপদাপদ থেকে মুক্তি দেয়।

ইস্তেগফার কী এ বিষয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, পাপ এমন এক কীট যে কেবলমাত্র ইস্তেগফারের মাধ্যমে তা থেকে বাঁচা সম্ভব। ইস্তেগফার হল কৃত পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়া যেন আল্লাহ্ এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করেন এবং ক্ষমা করেন; একইসাথে ভবিষ্যতে যেন তারা দ্বারা পাপ সংঘটিত না হয় তার জন্যও আল্লাহ্ তা’লার কাছে শক্তি যাচনা করা। মানুষ সবসময় আল্লাহ্‌র সাহায্যের মুখাপেক্ষী। পাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে শক্তি প্রার্থনা করাই ইস্তেগফার। তিনি (আ.) বলেন, যে মানুষ হয়েও ইস্তেগফারের আবশ্যকতা মানে না সে অশিষ্ট, বেয়াদব ও নাস্তিক। তিনি (আ.) আরও বলেন, মানুষের কাজ হল আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি। কিন্তু যখন এর সময় আসে তখন যদি সে এই কাজ না করে তাহলে আল্লাহ্ই তাকে নিঃশেষ করে দেন। তিনি (আ.) আরও বলেন, সদকা-খয়রাতের মাধ্যমে যে খোদার শাস্তি ও ক্রোধ প্রশমিত হয় তা সব ধর্মেই স্বীকৃত একটি বিষয়। হযরত ইউনুস (আ.)-এর সময়ে তা-ই হয়েছিল। তবে এর শর্ত হল এগুলো নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করার জন্য হতে হবে।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ্‌ তা’লা আমাদেরকে দোয়ার মর্ম অনুধাবন করার তৌফিক দিন, আমরা যেন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পিত হই, ইস্তেগফারের প্রতি যেন আমরা মনোযোগ নিবদ্ধ করি, তওবাকারী হই, বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য এমন সদকা প্রদান করতে পারি যা আল্লাহ্‌র কাছে গৃহীত হবে। আমীন।