মুসলেহ মওউদ হবার ঘোষণার প্রেক্ষাপট

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৭-ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৭ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “মুসলেহ মওউদ হবার ঘোষণার প্রেক্ষাপট”- বর্ণনা করে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

২০ ফেব্রুয়ারি আহমদীয়া জামাত মুসলেহ মওউদ দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। মুসলেহ মওউদ সংক্রান্ত যে ইলহাম রয়েছে তাতে হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-কে এক মহান পুত্রের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল যার অনেকগুলো গুণাবলীর ও বৈশিষ্ট্যের কথা এবং তাঁর খিলাফতকালে জামাতের অসাধারণ উন্নতির কথা এই ইলহামে নিহিত ছিল। আর আহমদীয়া জামাতের ইতিহাস একথার সাক্ষী যে হযরত মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.) আল-মুসলেহুল মওউদ এর ৫২ বছর দীর্ঘ খিলাফতকালে এই সবগুলো ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হয়েছে। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিসম্পন্ন একজন ব্যক্তি ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে দেখলে এই একটি ইলহামই হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এর সত্যতা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবে।

হযরত মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.)-ই যে মুসলেহ মওউদ এবং তাঁর সত্তাতেই যে এ সংক্রান্ত মসীহ মওউদ (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা লাভ করেছে- এ বিষয়টি মুসলেহ মওউদ-এর কয়েকটি উদ্ধৃতির বরাতে হুযুর (আই.) তুলে ধরেন। হুযুর বলেন, হযরত মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.)-কে আল্লাহ তা’লা ১৯১৪ সনে খিলাফতের আসনে বসান। জামাতের উলামারা এবং অধিকাংশ সদস্য তাঁর খিলাফতকালের শুরু থেকেই যেসব ঘটনাবলী ও নিদর্শনাবলী দেখা গিয়েছে তার ভিত্তিতে এটি জানতেন এবং বলতেনও যে তিনিই মুসলেহ মওউদ। কিন্তু তিনি (রা.) স্বয়ং ১৯৪৪ সনের পূর্বে এই দাবী করেন নি বা ঘোষণা দেন নি। এর কারণ হিসেবে তিনি (রা.) নিজেই বলেছেন যে, একমাত্র নবী বা মামূরদের জন্য ঘোষণা দেয়া আবশ্যক, বাকিদের জন্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, উম্মতের যেসব মুজাদ্দেদ গত হয়েছেন তাদের অনেকেই মুজাদ্দেদ হবার দাবী করেন নি, অথচ তারা মুজাদ্দেদ ছিলেন। যদি আল্লাহ নির্দেশ দেন তাহলে ঘোষণা করতে হয়, নতুবা ঘোষণা দেয়া আবশ্যক নয়, আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থনই তার সত্যতার প্রমাণ। অর্থাৎ যে কাজ তার দ্বারা সম্পাদন হবার কথা তা যদি সম্পাদিত হয় তবে তা-ই তার সত্যতার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট, দাবীর আবশ্যকতা নেই। এজন্যই তিনি দাবী করেন নি। কিন্তু যখন স্বয়ং আল্লাহ তা’লা তাঁকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, তারপর তিনি (রা.) এই ঘোষণা দেন যে তিনিই মুসলেহ মওউদ। এর ফলে জামাতের সদস্যরা তো অত্যন্ত আনন্দিত হন, কিন্তু লাহোরীরা, যারা মুসলেহ মওউদ (রা.)-এর হাতে বয়াত করেনি, তারা বিভিন্ন আপত্তি শুরু করে। হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) স্বয়ং এর উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, যখন থেকেই আমি মুসলেহ মওউদ হবার দাবী করেছি, তখন থেকেই মৌলভী মোহাম্মদ আলী সাহেব তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন। আমি আমার দাবীর সমর্থনে ইলহাম আর সত্যস্বপ্ন উপস্থাপন করেছি, কিন্তু তিনি তেমন কিছুই উপস্থাপন করেন নি। যেহেতু তাঁর কাছে ইলহাম হয়নি তাই তিনি তা করেন নি। মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধবাদী ইহুদী ও খ্রীষ্টানরাও ইলহাম থেকে বঞ্চিত ছিল। তারা একথা মানত যে যিনি আল্লাহর পক্ষে থাকেন তাঁর কাছে ইলহাম হয়, কিন্তু মুহাম্মদ (সা.)-এর অজস্র ইলহামের বিপরীতে তারা একটিও ইলহাম উপস্থাপন করতে পারে নি। মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেন, এটি কী করে হতে পারে যে এক ব্যক্তি আল্লাহর নাম নিয়ে মিথ্যা বলে আল্লাহর সৃষ্টিকে পথভ্রষ্ট করবে আর আল্লাহ তা’লার আত্মাভিমান তাকে কিছুই করবে না, ছেড়ে দিবে? আমরা তো আল্লাহ তা’লাকে সাক্ষী রেখে এসব স্বপ্ন ও ইলহাম উপস্থাপন করেছি। আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের সেই সাধ্য হয়নি।

মৌলভী মোহাম্মদ আলীর দাবী ছিল যে মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.) কেবলমাত্র একটি স্বপ্নের ভিত্তিতে নিজেকে মুসলেহ মওউদ দাবী করেছেন, তাই তাঁর এই দাবী ভুল। অথচ তাঁর (রা.) কাছে অনেকগুলো ইলহাম ও স্বপ্ন ছিল যা ইঙ্গিত করত যে তিনিই মুসলেহ মওউদ। এ সংক্রান্ত প্রথম যে ইলহাম হয়েছিল তা হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এর জীবদ্দশাতেই মুসলেহ মওউদ (রা.)-এর উপর হয়েছিল, তিনি (রা.) তা মসীহ মওউদ (আ.)-কে শুনিয়েও ছিলেন এবং হুযুর (আ.) তা নিজের ডায়েরিতে নোট করে নিয়েছিলেন। ইলহামটি ছিল “ইন্নাল্লাযীনাত্ তাবাঊকা ফাউকাল্লাযীনা কাফারূ ইলা ইয়াওমিল কিয়ামা”। এতে যেই সূক্ষ ও গভীর তাৎপর্য বর্ণিত হয়েছে তা যথাসময়ে স্পষ্ট হয়েছে, এর পূর্বে তা বোঝা যায় নি। এতে সেইদিকে ইঙ্গিত ছিল যে তিনি (রা.) খলীফা হবেন, খেলাফতের পর আরও একটি পদমর্যাদা তাঁকে দেয়া হবে, জামাতের অধিকাংশ সদস্য তাঁকে মানবে, কিন্তু কিছু লোক তাঁর বিরোধিতা করবে, এবং পরিণতিতে তাঁর মান্যকারীরাই বিজয়ী বলে স্পষ্টভাবে সাব্যস্ত হবে। বাস্তবিক তা-ই হয়েছে এবং ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই প্রদান করছে।

দ্বিতীয় যে নিদর্শন তা হল, একটি কাশফ বা দিব্যদর্শন এবং হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এর জীবদ্দশাতেই মুসলেহ মওউদ (রা.) তা দেখেন। তিনি (রা.) দেখেন যে তিনি সেই কক্ষ থেকে বের হন যাতে মসীহ মওউদ (আ.) থাকতেন। বাহিরে উঠানে এলে এক ব্যক্তি একটি পার্সেল দিয়ে যায় আর বলে যে এতে যা আছে তার কিছুটা মসীহ মওউদ (আ.)-এর আর কিছুটা তোমার। এতে নাম লেখা ছিল মুহীউদ্দীন ও মুঈনুদ্দীন। এর যা তাৎপর্য তা হল মুহীউদ্দীন মানে ধর্মের সঞ্জীবনকারী, যা মসীহ মাওউদের মর্যাদা। আর মুঈনুদ্দীন মানে ধর্মের সাহায্যকারী, এটি মুসলেহ মাওউদের মর্যাদা ছিল।

তৃতীয় নিদর্শনটি হল, একটি ইলহাম। হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর (রা.) কাছে এই ইলহাম হয়: ‘ই’মালূ আলা দাঊদা শুকরা’ অর্থাৎ ‘হে দাউদের সন্তান! কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ এই ইলহামটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হযরত দাউদ (আ.)-এর পুত্র ছিলেন হযরত সুলায়মান (আ.), আর তিনি দাউদ (আ.)-এর খলীফাও ছিলেন। এটি স্পষ্টভাবে মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.)-এর মুসলেহ মওউদ হবার প্রতি ইঙ্গিত করে।

চতুর্থ নিদর্শনটি ছিল একটি কাশফ। তিনি (রা.) দেখেন যে, তিনি (রা.) বাইতুদ দোয়াতে বসে দোয়া করছেন। হঠাৎ তাঁর কাছে প্রকাশ করা হয় যে হযরত মসীহ মওউদ (আ.) ইব্রাহীম ছিলেন। আল্লাহ তা’লা তাঁর কাছে প্রকাশ করেন- এই উম্মতে অনেক ইব্রাহীম এসেছেন। খলীফা আউয়ালও এক ইব্রাহীম ছিলেন। তুমিও এক ইব্রাহীম।

পঞ্চম নিদর্শন একটি স্বপ্ন ছিল যার মূল বিষয়বস্তু এই ছিল যে তাঁকে (রা.) একজন ফিরিশতা সূরা ফাতেহার তাফসীর শিখান এবং অসাধারণ তাফসীর তাঁকে শিখাতে থাকেন। ঘুম ভাঙার পর যদিও এসব কথার কিছু তাঁর মনে ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তা ভুলে যান। কিন্তু খিলাফতের পর তিনি ক্রমাগতভাবে সূরা ফাতেহা থেকে অসাধারণ ও আশ্চর্য সব তত্ত্ব ও বিষয়াদির আবিষ্কার করতে থাকেন। অর্থাৎ মুসলেহ মওউদের মাঝে আল্লাহ বিশেষভাবে সূরা ফাতেহার ও কুরআনের জ্ঞান প্রোথিত করে দিয়েছেন। এবং তাঁর জীবন এই কথার সাক্ষ্য প্রদান করছে।

হুযুর (আই.) খুতবার শেষদিকে এটি স্মরণ করান যে মুসলেহ মওউদ দিবস উপলক্ষ্যে যেসব জলসা, অনুষ্ঠান ও এমটিএ-র প্রোগ্রাম হবে, জামাতের সদস্যদের সেগুলোতে যোগদান করা ও সেগুলো ভালভাবে শোনা উচিত।