বাৎসরিক জলসার উদ্দেশ্য: বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিওন জামাতের বাৎসরিক জলসা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৩-ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৩রা ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “বাৎসরিক জলসার উদ্দেশ্য: বাংলাদেশ ও সিয়েরা লিওন জামাতের বাৎসরিক জলসা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

আজ থেকে বাংলাদেশ জামাতের বার্ষিক জলসা শুরু হচ্ছে। যেহেতু এবার আমি সেই জলসায় বক্তব্য প্রদান করছি না, তাই তারা খুতবাতে এ প্রসঙ্গে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেছে। আল্লাহ তা’আলার কৃপায় বাংলাদেশ জামাতও খুব নিষ্ঠাবান জামাত। এই জামাতের আহমদীরা প্রাণেরও কুরবানী প্রদান করেছেন এবং বার-তেরজন সেখানে শহীদ হয়েছেন। বিরোধিতা ও অত্যাচার সত্ত্বেও তারা ঈমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত। হুযুর দোয়া করেন যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের ঈমান ও একীন সর্বদা বৃদ্ধি করতে থাকুন। হুযুর (আই.) বলেন, একইভাবে সিয়েরা লিওনেও আজ থেকে জলসা শুরু হচ্ছে। সেখানকার আবহাওয়া ও নিরাপত্তার সমস্যার কারণে তারা চিন্তিত থাকায় তারা দোয়ার জন্য আবেদন করেছেন। হুযুর তাদের জলসার সার্বিক সফলতার জন্যও দোয়া করেন।

এরপর হুযুর (আই.) বলেন, আমাদের সবসময় জলসার মূল উদ্দেশ্য ও চেতনা বুঝতে ও তা অর্জন করতে চেষ্টা করতে হবে, কেননা হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) জলসার যে মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন তা আমাদের জীবনেরই মূল উদ্দেশ্য। আর সেই উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি হল মানুষের মাঝে যেন তাকওয়া বা খোদাভীতি সৃষ্টি হয়। আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হওয়া মানে ভীত-ত্রস্ত হওয়া নয়, বরং তা নিজের প্রিয়ভাজনের অসন্তুষ্টির ভয়। আরেকটি উদ্দেশ্য হল জলসার আধ্যাত্মিক পরিবেশের মাধ্যমে পারস্পরিক নম্রতা, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন যেন দৃঢ় করা হয়, যেন তা বিশ্ববাসীকে একথা বোঝাতে পারে যে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা এখানেই রয়েছে। অহংকার এবং আত্মশ্লাঘা যেন তারা নিজেদের মধ্য থেকে দূর করে, নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির পরম মানে যেন তারা উন্নীত হয়, ইসলামের অনিন্দ্যসুন্দর শিক্ষাকে যেন তারা বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করে। বিশ্ববাসী যেন একথা বলে যে ইসলামী শিক্ষা অনুসারে ইবাদতের উন্নত মান ও বান্দার প্রাপ্য অধিকার প্রদানের উন্নত মান দেখতে হলে আহমদীদের দেখ। অন্যান্য মুসলমানরা তো ইসলামকে দুর্নাম করছে, তাই এখন বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। আর এটি আমাদেরকে করতে হবে দোয়ার মাধ্যমে এবং নিজেদের উন্নত আদর্শ প্রদর্শনের মাধ্যমে। সুতরাং এই যে উদ্দেশ্য- এটি কেবল তিনদিনের উদ্দেশ্য নয়; বরং তা এই তিনদিনের বিশেষ আধ্যাত্মিক পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভেতরের জং ধুয়ে-মুছে সবসময়ের জন্য একে আত্মস্থ করা হল আসল উদ্দেশ্য। আমরা যেন নিজেদের ব্যবহারিক অবস্থাকেও উন্নত মানে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হই; আল্লাহ তা’আলার বর্ণিত নির্দেশনা অনুযায়ী নামায পড়া ও এ বিষয়ে নিজেদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা, নিজেদের যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য প্রয়োগ করে আল্লাহর বান্দাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদান করা ইত্যাদিতে সক্ষম হই।

তাকওয়া কী? এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন, বিদ্রোহের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ম পথকেও এড়িয়ে চলা হল তাকওয়া। অনেকে ভাবে যে চুরি, ব্যভিচার, হত্যা, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি পাপকাজ এড়িয়ে চলাই বুঝি পুণ্য। তিনি (আ.) কুরআনের আলোকে ব্যাখ্যা করেন যে, শুধু পাপ পরিত্যাগ করাই প্রশংসার যোগ্য করে তুলে না; বরং যে এমনটি ভাবে সে আসলে অজ্ঞ। এক্ষেত্রে ন্যূনতম স্তর হল তাকওয়া, আর এর উদাহরণ হল পরিষ্কার প্লেটের ন্যায়; কিন্তু এই পরিষ্কার খালি প্লেট ক্ষুধা নিবারণ করে না। ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে হলে খাবারস্বরূপ নেকী বা পুণ্যকর্ম করতে হবে।

দোয়া ও ইবাদত কেমন হওয়া উচিত সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন, দোয়া এমন এক মহৌষধ যা এক মুঠো মাটিকেও মহামূল্য রত্নে পরিণত করে। কিন্তু তা যেই-সেই দোয়া নয়, বরং এমন দোয়া যা কিনা হৃদয়কে বিগলিত করে পানির মত খোদা তা’আলার প্রতি প্রবাহিত করে। নামাযের রুকু-সিজদা-কিয়াম ইত্যাদির সাথে সাথে হৃদয়েও যেন বিনত অবস্থা তৈরি হয়। আর আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে তা অর্জন করতে হয়।

হুযুর (আই.) বলেন, তাকওয়ার দুটি দিক- একটি হল আল্লাহর অধিকার প্রদান, দ্বিতীয়টি বান্দার অধিকার প্রদান। মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন, সবচেয়ে কঠিন কাজ হল বান্দাদের অধিকার প্রদান। মানুষ নামাযও পড়ে, মসজিদেও আসে, চাঁদাও দেয়, অনেক সময় জীবনও উৎসর্গ করে; কিন্তু অন্যের অধিকার প্রদান করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যায়। তাই এক্ষেত্রে খুব সাবধানতার সাথে চলতে হবে। তিনি (আ.) বলেন, শত্রুর সাথে খুব কঠোর হওয়া যাবে না, এতে বাড়াবাড়ি করে অন্যায় কাজ করা যাবে না। কেননা এর ফলে একটি পাপ থেকে আরও অজস্র পাপ সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিগত কারণে কারও সাথে শত্রুরা রাখতে মসীহ মাওউদ (আ.) বারণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা.)-এর একটি অনন্য সুন্দর ঘটনা উল্লেখ করেন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর (আই.) দোয়া করেন, আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদেরকে তাকওয়ার প্রকৃত মর্ম বোঝার তৌফিক দান করেন, তাঁর কৃপারাজি আমাদের উপর বর্ষণ করেন, আল্লাহর বান্দাদের অধিকার প্রদানের সূক্ষ্ম বিষয়টি আমাদেরকে বোঝার তৌফিক দান করুন; আমাদের প্রতিটি কাজ যেন এই উদ্দেশ্যে হয় যে আমরা যেকোন মূল্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করব ও একে অগ্রাধিকার দিব-এই তৌফিক আল্লাহ তা’আলা আমাদের দান করুন। আল্লাহুম্মা আমীন। সুম্মা আমীন।