ইসলামের সেবায় আহ্‌মদীদের আর্থিক কুরবানী ও ওয়াকফে জাদীদের নতুন বছরের ঘোষণা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৬-জানুয়ারি, ২০১৭

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৬ই জানুয়ারী, ২০১৭ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “ইসলামের সেবায় আহ্‌মদীদের আর্থিক কুরবানী ও ওয়াকফে জাদীদের নতুন বছরের ঘোষণা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

পৃথিবীতে আজ আহমদীয়া মুসলিম জামাত ছাড়া আর একটিও এমন দল বা গোষ্ঠী নেই যার সদস্যগণ বিশ্বের প্রতিটি শহরে এবং প্রত্যেক দেশে ধর্মের প্রচার ও মানবসেবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক হাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের ধন-সম্পদ খরচ করার জন্য উপস্থাপন করে। আর আহমদীয়া জামাত হল সেই জামাত যাকে আল্লাহ তা’আলা এই উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠা করেছেন, কারণ তা প্রতিশ্রুত মসীহ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর জামাত, যার উপর পুরো বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। জামাতে আহমদীয়া বিগত ১২৮ বছর ইসলাম প্রচার ও মানবসেবার জন্য আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে আসছে; এর কারণ হল হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) এই জামাতকে পবিত্র কুরআনের শিক্ষার আলোকে ধন-সম্পদ ব্যয়ের সঠিক উপায় এবং আর্থিক কুরবানীর প্রকৃত জ্ঞান ও মর্মার্থ শিখিয়েছেন। হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) আল্লাহর নির্দেশেই তাঁর জামাতকে বারংবার এরূপ আর্থিক কুরবানীর নির্দেশ প্রদান করেছেন, কারণ এই যুগে ইসলাম ভেতর ও বাহির উভয় দিক থেকেই শত্রুর আক্রমণের শিকার। এজন্যই আল্লাহ তা’আলা ইসলামের উন্নতির জন্য এই জামাতকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাই জামাতের উন্নতির জন্য খরচ করা আল্লাহ তা’আলারই নির্দেশ। আর এই উদ্দেশ্যে আর্থিক কুরবানী প্রদানকারীদের জন্য আল্লাহ তা’আলাই এই সুসংবাদ প্রদান করেছেন যে তারা কয়েকগুন বর্ধিত হারে এর পুরস্কার লাভ করবে, কিছু ইহকালেই লাভ করবে আর মৃত্যুর পরও সে প্রশান্তি লাভ করবে।

হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-এর সাহাবীগণ তাঁর এই কথার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন এবং তারা এই কাজে অগ্রগামীও ছিলেন যার উল্লেখ হুযুর (আ.) বিভিন্ন সময় তাঁর লেখনীতে করেছেন। অনেক সাহাবী যারা নিজেরা দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু তারা আর্থিক কুরবানীর ক্ষেত্রে নিজেদের সামর্থ্যরে অনেক উর্ধ্বে উঠে কুরবানী করেছেন, নিজেদের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে ধর্মের সেবায় অর্থব্যয় করেছেন। হুযুর (আই.) মসীহ মাওউদ (আ.)-এর লেখনী থেকে মুন্সী আব্দুল আযীয সাহেব (রা.) ও শাদি খান সাহেব (রা.) এর উল্লেখ করেন। আল্লাহ তা’আলা মসীহ মাওউদ (আ.)-এর জামাতের সদস্যদের মাঝে কুরবানীর এই চেতনা ও প্রেরণা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। আর কুরবানীর ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা দেখা যায় আর তারা বিস্ময়কর সব উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। এরকম বিস্ময়কর কুরবানীর ক্ষেত্রে ধনীদের তুলনায় মধ্যবিত্তরা এগিয়ে থেকেছেন; তারা এটি ভাবেন নি যে তাদের এসব কুরবানী কি-ই বা পার্থক্য তৈরি করবে, বরং তারা কুরআনের শিক্ষা খুব ভালভাবে বুঝতেন যেখানে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন যে সামান্য শিশির বিন্দুও সেই বিশেষ বাগানে অগণিত ফল উৎপন্ন করে। আজ আমরা একটি দরিদ্র জামাত হওয়া সত্ত্বেও সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রচারের যে কাজ করি তা সামান্য হলেও আল্লাহ তা’আলা তাতে এত বরকত প্রদান করেন যে বিশ্ব এটি দেখে আশ্চর্যাণ্বিত হয়।

হুযুর (আই.) এরপর বিগত বছরে ওয়াকফে জাদীদের চাঁদা আদায়ের ঈমানোদ্দীপক অজস্র ঘটনাবলীর মধ্য থেকে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেন। এসব ঘটনায় একদিকে যেমন চাঁদাদাতার ঈমান বৃদ্ধি পায়, একইসাথে তাদের কুরবানী অন্যদেরও ঈমান লাভের কারণ হয়। আর কেবল পুরাতন আহমদীরাই নন, বরং সদ্য বয়াতকৃত আহমদীরা কুরবানীর ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছেন তা ঈর্ষণীয়। হুযুর (আই.) বলেন, এটি সেসব আহমদীর জন্য চিন্তার কারণ হওয়ার উচিত যারা আর্থিক স্বাচ্ছ্বন্দ্যের মাঝে থেকেও এই তাহরিকে যৎসামান্য চাঁদা প্রদানকেই যথেষ্ট মনে করে আর এরকম সৎকর্মে প্রতিযোগিতার মনোভাব রাখে না।

অতঃপর হুযুর ওয়াকফে জাদীদের ৬০তম বছর সূচনার ঘোষণা দেন এবং ৫৯তম বছরের বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। আল্লাহ তা’আলার ফযলে বিগত বছর তাহরিকে জাদীদ খাতে ৮০ লক্ষ ২০ হাজার পাউন্ড চাঁদা আদায় হয়েছে যা গত বছরের তুলনায় ১১ লক্ষ ২৯ হাজার পাউন্ড বেশি। আর এতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ১৩ লক্ষ ৪০ হাজার জন যা গত বছরের তুলনায় ১ লক্ষ ৫ হাজার জন বেশি। বরাবরের মতই পাকিস্তান তালিকার শীর্ষে রয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার নিরিখে যে সমস্ত দেশে উল্লেখযোগ্যভাবে চাঁদায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ঘানা, এরপর যথাক্রমে জার্মানী, পাকিস্তান ও কানাডা। উল্লেখযোগ্য হারে যেসব দেশ কুরবানী করেছে সেগুলো হল মালি, বুর্কিনাফাসো, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিয়েরা লিওন ও বেনিন। মোট আদায়ের হিসেবে পাকিস্তান বাদে যেসব দেশ রয়েছে তার মধ্যে ১ম হল যুক্তরাজ্য, ২য় জার্মানী, ৩য় যুক্তরাষ্ট্র, ৪র্থ কানাডা, ৫ম ভারত, ৬ষ্ঠ অস্ট্রেলিয়া, ৭ম মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ, ৮ম ইন্দোনেশিয়া, ৯ম মধ্য প্রাচ্যের আরেকটি দেশ, ১০ম ঘানা, এরপর বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ড। হুযুর (আই.) নাইজেরিয়ার জামাতকে স্মরণ করান যে তাদের চাঁদাদাতার সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় কমে গিয়েছে। হুযুর বলেন, এটি সেক্রেটারী ও কর্মীদের দুর্বলতার কারণে হয়েছে, নতুবা জামাতের সাধারণ সদস্যদের মাঝে দুর্বলতা নেই; তাদেরকে স্মরণ করানো হলে ও বোঝানো হলে তারা সর্বদা সব তাহরিকে উৎসাহের সাথে অংশ নেন। একইভাবে হুযুর আমেরিকাতেও সংখ্যা হ্রাসের উল্লেখ করেন। তবে আমেরিকা মাথাপিছু আদায়ের ক্ষেত্রে জোর দিয়েছে এবং এদিক থেকে তারা শীর্ষে রয়েছে।

হুযুর (আই.) দোয়া করেন আল্লাহ তা’আলা যেন সব কুরবানীকারীদের ধন-সম্পদ ও জনসম্পদে অশেষ বরকত দান করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মীদেরও ভবিষ্যতে সক্রিয় হয়ে কাজ করার ও যে ঘাটতি রয়েছে তা পূরণের তৌফিক দান করেন। হুযুর বলেন, সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করা উচিত, সামান্য অংক প্রদান করে হলেও সবারই এতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত।

খুতবার শেষদিকে হুযুর দু’টি গায়েবানা জানাযার উল্লেখ ও মরহুমদের যিকরে খায়ের করেন। প্রথম জানাযা শ্রদ্ধেয়া আসমা তাহেরা সাহেবার, যিনি মির্যা খলীল আহমদ সাহেবের স্ত্রী ছিলেন; গত ২৩ ডিসেম্বর ৭৯ বছর বয়সে কানাডায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজিউন)। মির্যা খলীল আহমদ সাহেব হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রা.)-এর পুত্র এবং খলীফাতুল মসীহ আউয়াল (রা.)-এর দৌহিত্র ছিলেন। হুযুর বলেন যে মরহুমা তাঁর মামী ছিলেন এবং হুযুর ব্যক্তিগতভাবে তাকে চিনতেন। মরহুমার বিভিন্ন গুণের কথা হুযুর উল্লেখ করেন ও তার জন্য দোয়া করেন। দ্বিতীয় জানাযা শ্রদ্ধেয় চৌধুরী হামিদ নাসরুল্লাহ খান সাহেবের যিনি গত ৪ জানুয়ারি লাহোরে ৮৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজিউন)। তিনি চৌধুরী হামিদুল্লাহ সাহেবের পুত্র এবং স্যার চৌধুরী জাফরুল্লাহ খান সাহেবের ভাতিজা ও জামাতা ছিলেন। মরহুম জামাতের একজন অসাধারণ ও একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। ১৯৭৫ সনে হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস তাকে লাহোরের আমীর নিযুক্ত করেন যে দায়িত্ব তিনি ৩৪ বছর পর্যন্ত সুচারুরূপে পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টানা ৩২ বছর ধরে তিনি ফযলে উমর ফাউন্ডেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে (রাহে.)-এর হিজরতের সময় তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য পান। মরহুমের অজস্র গুণাবলীর মধ্যে হুযুর যেগুলোর উল্লেখ করেন তার মাঝে খেলাফতের প্রতি বিশেষ আনুগত্য ও ভালবাসার কথাটি বারবার উঠে আসে। হুযুর মরহুমের আধ্যাত্মিক পদমর্যাদা বৃদ্ধির ও তার সন্তানদের মাঝে তার গুণের ধারা অব্যহত থাকার জন্য দোয়া করেন। আল্লাহুম্মা আমীন। সুম্মা আমীন।