আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরোধিতায় আমাদের করণীয়: ধৈর্য্য ও দোয়া

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৩-ডিসেম্বর, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৩শে ডিসেম্বর, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরোধিতায় আমাদের করণীয়: ধৈর্য্য ও দোয়া”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরোধিতা ও জামাতের সদস্যদের উপর অত্যাচার কোন নতুন বিষয় নয়। সব যুগেই নবীদের জামাতের সাথে এমনটি হয়ে এসেছে। পবিত্র কুরআনেও আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে এটি বলে দিয়েছেন যে এমন কোন নবী-রাসূল আসেন নি যার বিরোধিতা হয় নি। আর আজও এটি সত্য বলে সাব্যস্ত হচ্ছে। হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-এর বা তাঁর জামাতের বিরুদ্ধে উলামারা ডাহা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে জনসাধারণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তাদের এরকম আচরণের কথা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করাটি একজন সত্যবাদী আহমদীর জন্য ঈমান বৃদ্ধির কারণ হয়ে থাকে। কিন্তু কিছু মানুষ বলে বসে যে এখন তো অত্যাচার-নিপীড়ন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে, তাই আমাদেরও এখন অন্যায়ের প্রত্যুত্তরে অন্যায় করা উচিত; কতদিন আর আমরা অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করব? আর তারা এসব কথা বলে যুবকদের মন-মস্তিষ্ক বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করে। তারা বলে যে আমাদের নিজেদের অধিকার ও দাবী আদায়ের জন্য পার্থিব উপকরণ ও পন্থা অবলম্বন করা উচিত। হুযুর (আই.) বলেন, এগুলো অজ্ঞতাপ্রসূত কথাবার্তা এবং একেবারেই ভুল চিন্তা-ভাবনা। এরা আবেগপ্রবণ হয়ে ভুলে বসেছে যে আমাদের মূল শিক্ষা কী? হুযুর (আই.) বলেন, হয়তো এটি জামাতের বিরুদ্ধবাদীদেরই কোন ষড়যন্ত্র যে তারা জামাতের কোন কোন সদস্যের মাথায় এ ধরণের চিন্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

হুযুর (আই.) বলেন, আল্লাহ তা’আলা হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-এর জামাতকে বিজয় ও উন্নতির প্রতিশ্রুতি দান করেছেন, কিন্তু তা কঠোরতার উত্তর কঠোরতার মাধ্যমে দেয়ার মধ্য দিয়ে নয়; বরং প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা ও দোয়ার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করার মাধ্যমে। হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-ও বারবার আমাদেরকে বুঝিয়েছেন যে জামাতের উন্নতি ও শত্রুর বিনাশ দোয়ার মাধ্যমেই হবে, নিজেদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে। তিনি (আ.) একেবারে প্রথম দিন থেকেই নিজ জামাতকে বলে এসেছেন যে তার এই পথটি কোন সহজ পথ নয়, বরং তা অত্যন্ত বন্ধুর ও কষ্টের পথ; এ পথে নিজেদের আবেগ-অনুভূতিকেও সামলাতে হবে এবং প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতিও সহ্য করতে হবে। আল্লাহ তা’আলার ফযলে জামাতের সদস্যরা এ পথে সব ধরণের ত্যাগ স্বীকার করে আসছেন এবং শত্রুর আক্রমণ তাদের আরও ঈমান বৃদ্ধির কারণ হয়ে এসেছে। কিন্তু জামাতের এই শিক্ষা ও আদর্শের পরিপন্থী কথা যদি এক-দুইজন সদস্যও বলে তবে তা মানুষের মাঝে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণ হবে এবং বিরুদ্ধবাদীদেরকে আরও বিরোধিতা করতে উৎসাহিত করবে। হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) তাঁর জামাতকে শত্রুদের যুলুম ও বর্বরতার উত্তর ধৈর্য্য ও দোয়ার মাধ্যমে দেয়ার শিক্ষা দিয়েছেন আর এভাবেই জামাত সফলতা লাভ করে আসছে ও করবে।

হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন যে মৌলভীরা জনগণের মাথায় একথা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে আহমদীয়াতের বিরোধিতা করা অনেক বড় ইসলাম-সেবা আর জনগণও তাদের বুদ্ধির স্বল্পতার কারণে জামাতের বিরোধিতা করাকে ইসলাম-সেবা বলে মনে করে। কিন্তু আমরা যদি তাদের গালির উত্তরে গালি দেই তাহলে আমাদের হৃদয় কঠোর হয়ে যাবে এবং আমরাও বুলিসর্বস্ব হয়ে যাব যা আল্লাহ অত্যন্ত অপছন্দ করেন। সেক্ষেত্রে আমরা দুটো অভিশাপকে আমন্ত্রণ জানাব। একদিকে সৃষ্টির অভিশাপ, যা তারা আমাদেরকে এমনিতেই দিচ্ছে; উপরন্তু আল্লাহ তা’আলার অভিশাপও তখন আপতিত হবে। তাই দুটো অভিশাপকে ডাকবে না।

হুযুর (আই.) বলেন, অনেক সময় আইনও আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় আর আমরা অত্যাচারিত হলেও তারা আমাদের পাশে দাঁড়ায় না। তাই আমাদের জন্য একটিই রাস্তা আছে- আল্লাহর দরবারে ধর্ণা দেয়া এবং দোয়াকে পরম মার্গে পৌঁছানো। হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) বলেন, দোয়া ও তা কবুল হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে অনেক সময় একের পর এক পরীক্ষা আসতে থাকে। এসব পরীক্ষা আসার কারণ হল সেগুলো দোয়া করার জন্য হৃদয়ে এক আবেগ ও বিগলিতচিত্ততা সৃষ্টি করে যা দোয়া কবুল হওয়ার মাধ্যমগুলোর একটি। আসলে খোদা নিজেই এই ব্যবস্থা করেন, তাই বিপদে বিচলিত ও ব্যাকুল হওয়া উচিত নয়। বরং আমাদের নিজেদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত যে আমরা কি নিজ দোয়াকে সেই মানে উন্নীত করেছি যা দোয়া কবুল হওয়ার জন্য আবশ্যক।

হুযুর (আই.) বলেন, পাকিস্তানের আহমদীরা যারা যুলুম-নির্যাতন সহ্য করছেন তাদের অধিকাংশ তো ধৈর্য্য ধারণ ও দোয়া করছেন, কিন্তু যারা দূরে বসে আছে তারাই হা-হুতাশ বেশি করে। যদি নিজ ভাইদের জন্য প্রকৃতই সহানুভূতি থাকে তবে খোদার আঁচলকে দৃঢ়ভাবে ধর।

হুযুর (আই.) বলেন, মুমিন-মুত্তাকী অন্যের কাছ থেকে কষ্ট পেলেও তার অনিষ্ট চায় না। আর প্রকৃত তাকওয়া সম্পর্কে হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) পবিত্র কুরআনের বরাতে বলেন যে তার ফলে এমন এক জ্যোতি প্রদান করা হয় যা মুমিন-মুত্তাকীর প্রতিটি কথা, কাজ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আলোকিত করে দেয়। যদি আমাদের কথায় অন্যদের মত বিবেক-বহির্ভূত আবেগ থাকে তাহলে আমরা সেই জ্যোতি থেকে ছিটকে পড়ব। আল্লাহ তা’আলা তো পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ইন্না আকরামাকুম ইনদাল্লাহি আতক্বাকুম অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে সম্মানিত হল সেই ব্যক্তি যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী। আল্লাহ তা’আলার এই কথা কি মিথ্যা? এটি কিভাবে হতে পারে যে তিনি দুনিয়ার কীটদেরকে মুত্তাকীদের উপর বিজয় দান করবেন? শতবর্ষ ধরে আহমদীয়া জামাত আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হতে দেখে আসছে যে বিরুদ্ধবাদীদের সর্বপ্রকার অত্যাচার ও ষড়যন্ত্র জামাতকে আরও উন্নতি ও প্রসারতা দান করেছে। আজ কি তিনি এই জামাতকে ছেড়ে দেবেন?

হুযুর (আই.) দোয়া করেন আমরা যেন হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) নিজ জামাতের কাছে যে প্রত্যাশা রাখতেন তা পূর্ণকারী হই, তাকওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যেন ক্রমশ উন্নতি করি, ধৈর্য্য ও দোয়ার সাথে শত্রুর প্রতিটি আক্রমণকে আমরা যেন ব্যর্থ ও নিষ্ফল করতে পারি। আল্লাহুম্মা আমীন।

খুতবার শেষদিকে এসে হুযুর মরহুম মালেক খালেদ জাভেদ সাহেবের যিকরে খায়ের করেন যিনি গত ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের দোলমিয়ালে আমাদের মসজিদে মীলাদুন্নবীর দিন হামলার সময়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মরহুম যদিও কখনো হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন না, কিন্তু হামলাকারীরা হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)কে যে নোংরা ভাষায় গালি দিচ্ছিল তা সহ্য করতে না পেরে তিনি হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন এবং যেহেতু তখন বিরুদ্ধবাদীদের ডিঙিয়ে তাকে হাসপাতালে নেয়া যায় নি তাই তিনি সেখানেই ইন্তেকাল করেন। হুযুর (আই.) মরহুমের পদমর্যাদর উন্নীত হবার ও তার সন্তানদের মাঝেও তার পুণ্যের ধারা বহমান থাকার জন্য দোয়া করেন। আমীন। সুম্মা আমীন।