অভিযোগ করার সঠিক নিয়ম

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০২-ডিসেম্বর, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২রা ডিসেম্বর, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “অভিযোগ করার সঠিক নিয়ম”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,

যে কিছু মানুষ জামাতের পদধারী ব্যক্তিদের বা সাধারণ কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের দোষারোপ করে বা শরীয়তবিরোধী কাজের অভিযোগ করে চিঠি লিখে বলে যে এদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া দরকার, কারণ এরা জামাতের দুর্নাম করছে। কিন্তু এরকম অধিকাংশ অভিযোগকারী চিঠিতে নিজের নাম লিখে না বা কাল্পনিক কোন নাম-ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দেয়। স্বাভাবিক কারণেই তাদের অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না। কিছুদিন পর তারা আবার চিঠি লিখে যে আমি অভিযোগ করেছিলাম, কিন্তু এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি; কোন ব্যবস্থা নেয়া না হলে অনেক বড় অন্যায় হবে। হুযুর (আই.) বলেন, এ ধরণের প্রবণতা পাক-ভারত উপমহাদেশের লোকদের মাঝেই বেশি দেখা যায়, অন্যান্য স্থানের লোকদের মাঝে এটি অত্যন্ত বিরল। আর এটি কোন নতুন বিষয় নয়, বরং সব যুগেই এমন মানুষ ছিল। আর এ ধরণের একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে হযরত মুসলেহ মাওউদ (রা.) একবার একটি খুতবা দেন যা এই ধরণের অভিযোগকারীদের মুখ বন্ধ করার খুব কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গ একটি খুতবা ছিল। এরপর হুযুর (আই.) সেই খুতবার আলোকে খুতবা প্রদান করেন।

হুযুর (আই.) হযরত মুসলেহ মাওউদ (রা.) এর বরাতে বলেন, বেনামি চিঠি পাঠানো বা চিঠিতে কাল্পনিক নাম-ঠিকানা ব্যবহার- এ কাজটি হয় মুনাফেকী নতুবা মিথ্যাবাদীতা। যদি তাদের মাঝে সৎসাহস থাকত আর তারা সত্যবাদী হতো তাহলে তাদের তো কোন কিছুর পরোয়া থাকার কথা না, কারণ তারা ধর্মের জন্য প্রাণ-মান-সম্পদ সবকিছু কুরবানী করার প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে। কিন্তু তাদের কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে তাদের মান-সম্মানের হানি ঘটবে এই ভয়ে তারা উড়োচিঠি পাঠায়। অথচ কুরআন শরীফের নির্দেশ হল যখন কোন খবর বা অভিযোগ আসে তখন প্রথমে ভালভাবে তদন্ত করে নাও; আর তদন্ত তো দ্রুত হতে পারে না। যে ব্যক্তি কোন খবর পৌঁছায় তখন প্রথমে অভিযোগকারীর ব্যাপারে তদন্ত করে কাজ শুরু করতে হয় যে সে নিজে কেমন? সে নিজে ভুল-ত্রুটি ও অপরাধে লিপ্ত বা ঈমানে দুর্বল নয়তো? কুরআন শরীফে এ ধরণের পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে ‘ফাসেক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর ‘ফাসেক’ শব্দের অর্থ কেবল পাপী ও দুষ্কৃতিকারী নয়। ঝগড়াটে বা কথায় কথায় রেগে যায় বা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়েও চরমপন্থা অবলম্বনকারী- অভিধানে এমন ব্যক্তিকেও ফাসেক বলা হয়েছে। অর্থাৎ অভিযোগকারীর আপত্তি তার এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে হয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। আর যদি অভিযোগকারী নিষ্ঠাবান এবং সৎও হয়ে থাকে, তাহলেও তার সম্পর্কে আগে তদন্ত করতে হয়। হুযুর বলেন, আসল বিষয় হল কুরআন ও সুন্নতের নির্দেশ মেনে চলা। যদি চিঠিতে নাম-ঠিকানা না লেখা থাকে তাহলে কুরআনের নির্দেশানুসারে তদন্ত কিভাবে হবে? সেক্ষেত্রে অভিযোগকারী নিজেই তো শরীয়তের নির্দেশ অমান্যকারী সাব্যস্ত হয়।

এরপর হুযুর (আই.) হযরত মুসলেহ মাওউদ (রা.)-এর বরাতে হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) ও রসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী থেকে দুটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বলেন, যে অনেক সময় আপত্তিকারীরা বৃথা আপত্তি তুলে থাকে। হুযুর (আই.) বলেন, কুরআনের নির্দেশানুসারে ক্ষেত্রবিশেষে অভিযোগ উত্থাপনকারীকে চারজন বা দুইজন সাক্ষী উপস্থাপন করতে হয়, অন্যথায় মিথ্যা অভিযোগ করার দায়ে তাদেরকে ৮০টি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বেনামি চিঠিতে অভিযোগ তো এক অপরাধ রয়েছেই, অধিকন্তু যদি সেরকম অভিযোগ হয়ে থাকে তবে সাক্ষী উত্থাপন না করার কারণে উল্টো শাস্তিযোগ্য হয়েছে। যদি তারা প্রকৃতই সংশোধন চাইত তাহলে প্রথমে নিজেদের উপরে কুরআনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করত।

হুযুর (আই.) উল্লেখ করেন যে, অনেক সময় এই আপত্তিও করা হয় অমুক মিথ্যা কসম খেয়ে শাস্তি থেকে বেঁচেছে। একবার যখন রসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এরকম এক বিতন্ডা আসে এবং একজন অপর পক্ষ সম্বন্ধে আপত্তি করে যে ‘সে তো মিথ্যা কসম খাবে’; তখন রসূলুল্লাহ (সা.) জবাব দেন, “আমি তো খোদার নির্দেশ অনুসারে সিদ্ধান্ত করব। সে যদি মিথ্যা কসম খায় তবে তার শাস্তি খোদা স্বয়ং দিবেন।” অতএব অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযোগকারীর নীতি গৃহীত হবে না, বরং আল্লাহর নির্ধারিত নিয়মানুসারে মীমাংসা করা হবে। আর এতেই আমাদের সফলতা নিহিত। হুযুর (আই.) দোয়া করেন আমরা যেন এভাবেই নিজেদের বিষয়সমূহের মীমাংসা নিষ্পত্তিকারী হতে পারি এবং নিজেদের আমিত্ব, অহমিকা, নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে যেন খলীফাকে বা জামাতের ব্যবস্থাপনাকে নিজেদের পছন্দমত বিচার করতে বাধ্য করতে না চাই। হুযুর এটিও বলেন যে, আমাদের কেউ যখন জামাতের ব্যবস্থাপনায় সত্যিই কোন ত্রুটি দেখে তখন সাহসিকতার সাথে সেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা উচিত এবং বীরত্বের সাথে পুরো পদ্ধতি সম্পন্ন করা উচিত।

খুতবার শেষদিকে এসে হুযুর গায়েবানা জানাযার উল্লেখ করেন এবং মরহুমদের যিকরে খায়ের করেন। প্রথম জানাযা শেখ সাজিদ মাহমুদ সাহেবের (৫৫), যাকে গত ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাযের সময় মোটরসাইকেল আরোহীরা গুলি করে করাচিতে শহীদ করে। দ্বিতীয় জানাযা জনাব শেখ আব্দুল কাদীর সাহেবের, যিনি কাদিয়ানের দরবেশ ছিলেন এবং গত ২৬ নভেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। তৃতীয় জানাযা নাসেরাবাদ, কাশ্মীরের অধিবাসী তানভীর আহমদ লোন সাহেবের। তিনি পুলিশ বিভাগে ছিলেন। ২৫ নভেম্বর জেলা হেডকোয়ার্রটারে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় বন্দুকধারী সন্ত্রাসীদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্ন ইলায়হে রাজিউন। হুযুর (আই.) মরহুমদের পদমর্যাদার উন্নতির জন্য ও তাদের আত্মীয়দেরকে তাদের আদর্শে চলার সৌভাগ্য পাবার জন্য দোয়া করেন। আল্লাহুম্মা আমীন, সুম্মা আমীন।