সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সত্ বিবেক

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৫-নভেম্বর, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৫শে নভেম্বর, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “সমতা, ন্যায়পরায়ণতা ও সত্ বিবেক”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

তাশাহুদ, তাঊয, তাসমিয়া এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) সূরা নিসার ১৩৬ নং আয়াত তিলাওয়াত করেন,

যার বঙ্গানুবাদ হল: “ হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে দৃঢ়ভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠকারী হও, এমনকি সেই সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের বা পিতামাতার এবং নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গেলেও। সে ধনী হোক অথবা দরিদ্র হোক আল্লাহই উভয়ের অভিভাবক। অতএব তোমরা যাতে ন্যায়বিচার করতে সক্ষম হতে পার সেজন্য তোমরা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তোমরা যদি পেঁচিয়ে কথা বল অথবা সত্যকে এড়িয়ে যাও তাহলে মনে রেখো তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আল্লাহ নিশ্চয় পুরোপুরি অবহিত।”

হুযুর বলেন তাঁর কানাডা সফর চলাকালীন সময়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে ‘ তোমরা সমসাময়িক সমস্যার কী সমাধান দিচ্ছ?’। হুযুর তাকে জবাব দেন যে তোমরা যারা জাগতিক পরাশক্তি রয়েছ তোমরা তোমাদের যাবতীয় চেষ্টা-চরিত্র যা তোমাদের বুদ্ধিতে কুলিয়েছে অশান্তি দূর করার জন্য করে ফেলেছ। কিন্তু তোমরা সফল হওনি, একস্থানে যদি কিছুটা কমিয়েছ তো অন্যখানে আরও বেশি সমস্যা তৈরি করে ফেলেছ। এখন একটি চেষ্টাই বাকি আছে, সেটা হল ইসলামী শিক্ষামালার আলোকে চেষ্টা করা। হুযুর বলেন, যদিও তারা একথা বলেনি যে মুসলমানরা আগে এর উপর আমল করে দেখাক; তা সত্ত্বেও আমি বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাদেরকে একথা বলে দিই যে মুসলমানদের যে এসব শিক্ষার উপর আমল করছে না তা-ও মহানবী (সা.)-এর সত্যতার প্রমাণ। কারণ তিনি (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এমন এক যুগ আসবে যখন মুসলমানরা ইসলামী শিক্ষা ভুলে গিয়ে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত হবে। আর তখন ইমাম মাহদী আগমন করবেন, যাঁর ভবিষ্যদ্বাণী কুরআন শরীফ ও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে এসেছে। আর এখন কেবল আহমদীরাই নয়, বরং অ-আহমদী মুসলমানরাও ধীরে ধীরে তাদের আলেম-উলামাদের অন্যায়াচরণের কথা স্বীকার করছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সৌভাগ্যবান যে আমরা মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে আমরা তাঁর নিষ্ঠাবান সেবক হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-কে মানতে পেরেছি। কিন্তু শুধু এতটুকু কথাই কি আমাদের মূল লক্ষ্য অর্জনের কারণ হয়ে যাবে? হুযুর বলেন, এই প্রশ্নটির প্রতি আমাদের প্রত্যেকের মনোযোগ দেয়া উচিত।

এরপর হুযুর (আই.) খুতবার শুরুতে তিলাওয়াতকৃত আয়াতের কথা উল্লেখ করে বলেন যে বিভিন্ন সময়ে তিনি বক্তৃতায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামী শিক্ষার উল্লেখ করতে গিয়ে এই আয়াত তুলে ধরেন যা অ-আহমদীদের খুবই প্রভাবিত করে। কিন্তু শুধু এই জ্ঞানের কথা বলাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং এগুলো পালন করে এর ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত পৃথিবীর সামনে আমাদেরকে উপস্থাপন করতে হবে। নতুবা অ-আহমদীরা এই আপত্তি তুলবে যে তোমরা এক হাতে বয়াত করার এবং তোমাদের মাঝে এক সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা থাকার দাবি করার পরও তোমরা এই আদর্শ কতটুকু পালন করেছ?

হুযুর (আই.) বলেন, কুরআন অনুসারে ন্যায়বিচারের জন্য নিজ পিতা-মাতা, সন্তান ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গিয়েও সাক্ষ্য বা রায় প্রদানের যে আদর্শ তা হযরত মসীহ মাওউদ (আ.) নিজে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। তিনি (আ.) কুরআনের আলোকে এই শিক্ষা তাঁর জামাতকে দিয়েছেন যে শত্রুর সাথে কেবল সদ্ব্যবহার নয়, বরং শক্রুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হতে হবে- যা এক সুকঠিন কাজ এবং শক্ত ঈমানের পরিচায়ক। এই অনুসারে যদি আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠকারী না হতে পারি তবে আমরা সেই অঙ্গিকার ভঙ্গের দায়ে দায়ী হব, যা হযরত মসীহ মাওউদ (আ.)-এর হাতে বয়াতের সময় আমরা করেছি।

এরপর হুযুর (আই.) জামাতের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী ও কর্মকর্তাদের, বিশেষভাবে যেসব বিভাগ জামাতের জনসাধারণের সাথে সম্পর্কযুক্ত তাদেরকে কুরআনী শিক্ষার আলোকে নসীহত করেন যে তারা যেন সর্বপ্রথম এই মান প্রতিষ্ঠাকারী হয়। এসব বিভাগের মধ্যে হুযুর কাযা বিভাগ, উমুরে আম্মা, তরবিয়ত বিভাগ, ইসলাহ কমিটি ও জি.এস বিভাগের বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। হুযুর বলেন, এসব দায়িত্ব আমানতস্বরূপ, অতএব এসব আমানত সুষ্ঠুরূপে পালনে তাদেরকে অন্য মুমিনদের তুলনায় অনেক উন্নত আদর্শ দেখাতে হবে। সবার বক্তব্য সম্পূর্ণ শুনে, নিজের বিবেক-বুদ্ধি সম্পূর্ণভাবে খাটিয়ে, দোয়ার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কখনো কোন ভুল সিদ্ধান্ত বা কাজ হয়ে গেলে অকপটে ভুল স্বীকার করে তা শুদ্ধ করে নিতে হবে। আর এ সকল বিষয়ে আদর্শ স্থাপন কেবল কর্মকর্তা নয়, বরং প্রত্যেক আহমদীর উপরই দায়িত্ব। যদি এমনটি না হয় তবে অন্যদের সাথে আমাদের পার্থক্য কী? বরং সেক্ষেত্রে আমরা জেনে-শুনে নিজেদের অঙ্গিকার ভঙ্গের দায়ে দায়ী হব।

হুযুর বলেন, আজ আহমদীয়া মুসলিম জামাতই পৃথিবীতে একমাত্র জামাত যারা মুসলমান হিসেবে একনামে পরিচিত এবং মহানবী (সা.) এর উক্তি অনুসারে প্রকৃত মুসলমানদের জামাত। তাই আল্লাহ তা’আলার এই দয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকৃত অর্থে তখন জ্ঞাপন করা হবে যখন জামাতের ব্যবস্থাপনার ও খিলাফতের পূর্ণ আনুগত্য করা হবে। হুযুর (আই.) দোয়া করেন আল্লাহ তা’আলা যেন সব আহমদীকে এই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের তৌফিক দান করেন।

খুতবার শেষদিকে হুযুর কয়েকটি জানাযা গায়েব পড়ানোর কথা বলেন। প্রথম জানাযা জনাব শহীদ আদনান মুহাম্মদ হালাবী সাহেবের, যিনি সিরিয় একজন আহমদী এবং তাঁকে আহমদীয়াতের কারণে ২০ জুন ২০১৩ সালে অপহরণ করা হয় এবং এর আনুমানিক দুই সপ্তাহ পরে শহীদ করা হয়। দ্বিতীয় জানাযা কাদিয়ান নিবাসী দরবেশ চৌধুরী মঞ্জুর আহমদ চিমা সাহেবের স্ত্রী জনাব বশির বেগম সাহেবার, যিনি ছিলেন গত ৭ নভেম্বর ৯৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তৃতীয় জানাযা জনাব রানা মোবারক সাহেবের যিনি গত ৫ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। হুযুর মরহুমদের যিকরে খায়েরও করেন এবং তাঁদের আধ্যাত্মিক পদমর্যাদার উন্নতির জন্যও দোয়া করেন। আল্লাহুম্মা আমীন। সুম্মা আমীন।