রমযান: আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের মাস

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৭-জুন, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১৭ই জুন, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “রমযান: আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের মাস”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

খুতবার শুরুতেই হুযূর সূরা বাকারার ১৮৭ নাম্বার আয়াত পাঠ করেন যার অনুবাদ হলো, অর্থাৎ, আর আমার বান্দারা যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করে তখন (বল), ‘নিশ্চয় আমি (তাদের) নিকটেই আছি। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার উত্তর দেই যখন সে আমার কাছে প্রার্থনা করে। সুতরাং তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে যাতে তারা সুপথ প্রাপ্ত হয়।’

এরপর হুযূর বলেন, রোযা এবং রোযার বিধি-বিধান সম্পর্কিত আয়াতগুলোর মাঝখানে এ আয়াতটি রেখে আল্লাহ্ তা’লা রমযান এবং দোয়া গৃহীত হওয়ার মাঝের গভীর সম্পর্কের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) এ সম্পর্কের ব্যাপারে বলেন, ‘এ আয়াতটিকে এখানে রেখে আল্লাহ্ এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, রোযার মাস তাক্বওয়া শেখা এবং আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের মাস’।

হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, এ মাসে শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করা হয় এবং আল্লাহ্ মানুষের আরও নিকটবর্তী হয়ে যান। কিন্তু মনে রাখা উচিত, শয়তান শুধুমাত্র তাদের জন্য শৃংখলাবদ্ধ হয় যারা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে এবং তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে।

আল্লাহ্ বলেছেন, তিনি আমাদের প্রার্থনার উত্তর দেন এবং তিনি আমাদের নিকটেই রয়েছেন কিন্তু শর্ত হল, ‘বান্দাও যেন তাঁর ডাকে সাড়া দেয় এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনে’।

হুযূর (আই.) বলেন, যারা বলে, আমরা দোয়া করি কিন্তু তা কবুল হয় না তাদের উচিত আত্মজিজ্ঞাসা করা, তারা সত্যিতার অর্থেই আল্লাহ্‌র ডাকে সাড়া দিচ্ছে কি-না? আল্লাহ্‌র নির্দেশ পালনে তারা কতটা সচেষ্ট।

দোয়া গৃহীত হওয়ার লক্ষ্যে যেসব শর্ত রয়েছে সে সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ‘প্রথমতঃ মানুষ যদি নিজেদের মাঝে তাক্বওয়া এবং খোদাভীতি সৃষ্টি করতে পারে তাহলে আল্লাহ্ তাদের দোয়া শোনেন। দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়ের ওপর বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ্ তা’লা মওজুদ আছেন এবং তাঁর সব শক্তির ওপর ঈমান রাখে। সে আল্লাহ্‌র শক্তির প্রমাণ পাক বা না পাক উভয় অবস্থাতেই তাঁর সত্তায় ঈমান রাখতে হবে। অর্থাৎ, অদৃশ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। যদি মানুষের ঈমান এরূপ হয় তাহলে সে তার প্রার্থনার উত্তর পাওয়ার অভিজ্ঞতাও লাভ করবে।

এরপর হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বেশ কিছু উক্তি তুলে ধরে দোয়ার দর্শন এবং দোয়া গৃহীত হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বক্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে, অনেকে মনে করে তারা যা দোয়া করে তাই গৃহীত হওয়া আবশ্যক। কিন্তু এক্ষেত্রে খোদার বিধান হল, আল্লাহ্ আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন নন। অনেক সময় মানুষ এমন কিছু চায় যা তার জন্য ক্ষতিকারক। মানুষের জ্ঞান সীমিত, সে তার পরিণাম সম্পর্কে অনবহিত, সে জানে না সে কি চাচ্ছে কিন্তু আল্লাহ্‌র জ্ঞান পরিপূর্ণ এবং আল্লাহ্ আমাদের পরিণাম সম্পর্কেও জ্ঞাত। যখন কোন দোয়া গ্রহণ করা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয় তখন আল্লাহ্ সে দোয়া তিনি শোনেন না। আর এটি দোয়া গৃহীত হওয়ারই অপর নাম। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যদি কোন সন্তান মায়ের কাছে ধারালো ছুড়ি হাতে নেওয়ার বায়না ধরে বা জ্বলন্ত অঙ্গারে হাত দিতে চায় আর এজন্য সে কান্নাকাটিও করতে থাকে তারপরও কোন মা কি নিজ সন্তানকে এমনটি করতে দিবেন? দোয়ার ফলেও যা মানুষের জন্য কল্যাণকর তাই আল্লাহ্ দেন এবং অকল্যাণকে দূরে সরিয়ে রাখেন।

এরপর হুযূর বলেন, প্রত্যেকের উচিত সে যেন আল্লাহ্‌র ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে এবং দোয়ার পাশাপাশি বাহ্যিক উপায় উপকরণ এবং শক্তি-সামর্থ্য কাজে লাগানোরও চেষ্টা করে। যদি কেউ কোন কাজ করার চেষ্টা না করে শুধু দোয়াই করতে থাকে তাহলে সে আল্লাহ্‌র পরীক্ষা নেয়। এ কারণে প্রথমে নিজের চেষ্টা-প্রচেষ্টা এবং বিশ্বাসকে সঠিক করা আবশ্যক। অনেকে বলে, দোয়া করলে অন্যান্য উপায়-উপকরণ বা চেষ্টা-প্রচেষ্টার প্রয়োজন কি? প্রকৃতপক্ষে দোয়াও এক প্রকার উপকরণ। দোয়ার ফলে আল্লাহ্ এমন উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করেন যা দোয়া গৃহীত হওয়ার কারণ হয়।

দোয়ার দর্শন তিনি বলেন, একটি শিশু ক্ষুধার তাড়নায় যখন চিৎকার করে তখন আপনা-আপনি মায়ের বুকে দুধ এসে যায়। দোয়া সম্পর্কে শিশুটি কোন জ্ঞান না রাখলেও সে মূলতঃ দোয়াই করে। কেননা সে খোদা প্রদত্ত গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগায়। চাওয়া মানুষের বৈশিষ্ট্য আর দেয়া আল্লাহ্‌র বৈশিষ্ট্য। রহমানিয়্যত ও রহীমিয়্যত পৃথক কিছু নয়। অর্থাৎ, রহমান খোদা আমাদেরকে কাজ এবং চেষ্টা করার শক্তি দিয়েছেন। যখন মানুষ রহমান খোদা প্রদত্ত শক্তির মাধ্যমে চেষ্টা করে তখন খোদার রহীম বৈশিষ্ট্য তাকে তার চেষ্টার ফল দেন। যে রহমানীয়্যতকে বাদ দিয়ে রহীমিয়্যত থেকে অংশ পাওয়ার চেষ্টা করবে সে কখনও সফল হবে না।

হুযূর বলেন, প্রকৃতির মাঝেও দোয়া কবুলের নিদর্শন রয়েছে। এ কারণে আল্লাহ্ আমাদের দোয়া শিখিয়েছেন, আমাদের সরল সোজা পথে পরিচালিত কর। কিন্তু এর আগে এই স্বীকারোক্তি, অর্থাৎ আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি রেখে এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, সরল ও সুদৃঢ় পথে পরিচালিত হওয়ার জন্য নিজের সব শক্তি-সামর্থ্যকে কাজে লাগাও, এরপর সাহায্য যাচনা করো।

অনেকে বলে, দোয়া করে কোন লাভ হয় না, তারা একেবারেই ভুল কথা বলে। যদি আল্লাহ্‌র অস্তিত্বে এবং তাঁর শক্তির ওপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকত তবে একথা তারা কখনও বলত না। হুযূর এখানে একটি ফার্সী পঙতি পাঠ করেন যার অর্থ হল, ‘যদি ভালোবাসার মানুষ তার দিকে ফিরেও না তাকায় তাহলে সে আবার কেমন প্রেমিক’। খোদা তা’লা চান, তোমরা যেন তাঁর কাছে যাও। তবে, শর্ত হল তোমাদেরকে নিষ্ঠার সাথে যেতে হবে।

খোদার প্রতি যদি সত্যিকার ভালোবাসা থাকে তবে তিনি অবশ্যই দোয়া শুনবেন। সত্যিকার ভালোবাসা সৃষ্টির পদ্ধতি সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, একথা সত্যি যে, ‘খুলিকাল ইনসানু যাঈফা’ অর্থাৎ, মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষের সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্যকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য আল্লাহ্‌র কৃপা ও দয়ার প্রয়োজন। মানুষ যত বেশি নিজের দুর্বলতা, অপূর্ণতা ও ঘাটতিকে অনুধাবন করতে পারবে তত বেশি তার মধ্যে দোয়া করার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হবে। মানুষ বিপদের সময় তার অসহায়ত্বের কারণে যেভাবে আল্লাহ্‌র দরবারে কেঁদে কেঁদে দোয়া করে তেমনি ভাবে সে যদি তার দুর্বলতা ও ঔদাসীন্যের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে আল্লাহ্‌র দরবারে কেঁদে কেঁদে দোয়া করে তবে আল্লাহ্ তার সব দুর্বলতা দুর করে দিবেন।

এরপর হুযূর বলেন, সবচেয়ে প্রথম মানুষের নিজের ধর্ম রক্ষা ও ধর্মের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য দোয়া করা উচিত। মানুষ যদি সত্যিকার অর্থেই তওবা করে তাহলে আল্লাহ্ও সেসব অঙ্গীকার পূর্ণ করেন যেসব অঙ্গীকার তিনি তওবাকারীদের সাথে করেছেন।

খুতবার শেষে হুযুর (আই.) আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের জন্য হযরত মসিহ্ মাওউদ (আ.) একটি দোয়া উল্লেখ করেন। রোযার মাসের দিনগুলোতে বিশেষ ভাবে এ দোয়াটি করা উচিত। দোয়াটি হল;

হে বিশ্বজগতের প্রভু-প্রতিপালক! আমি তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা জানি না। তুমি পরম দয়ালু ও কৃপালু আর আমার প্রতি তোমার সীমাহীন অনুগ্রহ রয়েছে। আমার অপরাধ ক্ষমা কর যাতে আমি ধ্বংস হয়ে না যাই। আমাদের হৃদয়ে তোমার বিশুদ্ধ ভালোবাসা সৃষ্টি করো যাতে আমি জীবন লাভ করি। আমার দুবর্লতা ঢেকে রাখ। আমাকে দিয়ে এমন কাজ করাও যদ্বারা তুমি সন্তুষ্ট হবে। আমি তোমার দয়ার দোহাই দিয়ে সেই বিষয় থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি যাতে তোমার ক্রোধ আমার ওপর বর্ষিত না হয়। করুণা কর আর ইহ ও পরকালের বিপদাপদ থেকে আমাকে রক্ষা কর। সব ধরনের কৃপা ও দয়া তোমারই হাতে রয়েছে। আমীন সুম্মা আমীন।

আল্লাহ্ তা’লা আমাদের দোয়ার দর্শন বুঝে এই পবিত্র রমযানে বেশি বেশি তাঁর ইবাদত ও দোয়া করার তৌফিক দিন, আমীন।