রমযানের প্রেক্ষাপটে ত্বাকওয়া বা খোদাভীতি অবলম্বনের গুরুত্ব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১০-জুন, ২০১৬

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১০ই জুন, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “রমযানের প্রেক্ষাপটে ত্বাকওয়া বা খোদাভীতি অবলম্বনের গুরুত্ব”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

খুতবার শুরুতেই হুযূর সূরা বাকারার ১৮৪ নাম্বার আয়াত পাঠ করেন যার অনুবাদ হলো, হে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের জন্য সেভাবে রোযা রাখা বিধিবদ্ধ করা হল যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।

এরপর হুযূর বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ্ তা’লা আমাদের দৃষ্টি এমন একটি বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ করেছেন যার মাধ্যমে আমাদের ইহ ও পরকাল উভয়ই সুনিশ্চিত ও সার্থক হবে।

রোযার গুরুত্ব সম্পর্কে হুযূর (আই.) বলেন, রোযা এ কারণে ফরয করা হয় নি যে, এটি পুর্ববর্তী উম্মতদের ওপরও ফরয করা হয়ছিল। বরং এ কারণে আবশ্যক করা হয়েছে যাতে আমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করি। রোযার গুরুত্ব এ বিষয়ের ওপর নিহিত যে, আমরা শুধু অবৈধ নয় বরং বৈধ বিষয়াদি থেকেও রোযার সময় নিজেদের বিরত রাখি শুধুমাত্র খোদার সন্তুষ্টির খাতিরে। হাদীস শরীফে এসেছে, আল্লাহ্ বলেন, যদি তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন না কর তাহলে তোমাদের ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকার প্রতি আল্লাহ্ বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করেন না ।

আর একটি হাদীসে রয়েছে, যদি কেউ তাক্বওয়া বা খোদা ভীতির সাথে রমযান মাস অতিবাহিত করে তবে আল্লাহ্ তার সব গুণাহ্ বা পাপ ক্ষমা করে দিবেন।

আল্লাহ্ বলেন, (ফাত্তাকূল্লাহা ইয়া উলিল আলবাব লাআল্লাকুম তুফলিহূন) অর্থাৎ, অতএব হে বুদ্ধিমানেরা! তোমরা আল্লাহ্‌র তাক্বওয়া অবলম্বন কর যেন তোমরা সফল হতে পারো।

এরপর হুযূর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাবলী হতে বেশ কিছু উক্তি তুলে ধরে তাক্বওয়ার বিষয়টি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন।

মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বক্তব্যের সারাংশ হলো, তাক্বওয়া কোন তুচ্ছ বা সাধারণ বিষয় নয়। এর মাধ্যমে মানুষকে সে সমস্ত জিনিষের মোকাবিলা করতে হয় যা তার মধ্যে নাফ্‌সে আম্মারা বা কুপ্রবৃত্তি স্বরূপ বিরাজমান থাকে। বস্তুতঃ তা তার প্রবৃত্তির শয়তান হয়। এর সংশোধন করা না হলে খোদা প্রদত্ত গুণাবলি যা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের জন্য মানুষকে দেয়া হয়েছে তা খোদা থেকে মানুষকে দুরে নিয়ে যায়। সেই ব্যক্তি মুত্তাকী যে তার সকল শক্তি ও সামর্থ্যকে যথাস্থানে সঠিকভাবে ব্যবহার করে।

তাক্বওয়া অত্যন্ত সুক্ষ্ম একটি বিষয়। যদি কাজে-কর্মে সামান্যতম লোক দেখানো ভাবও থাকে তবে আল্লাহ্ সেই আমলকে আমলকারীর মুখের ওপর ছুড়ে মারেন। তাক্বওয়া একটি কঠিন কাজ, যতক্ষণ মানুষ নিজের ওপর এক প্রকার মৃত্যু আনয়ন না করে ততক্ষণ সে তাক্বওয়া অর্জন করতে পারে না। অলৌকিক নিদর্শন, সত্যস্বপ্ন ইত্যাদি তাক্বওয়ার শাখা মাত্র। কারও পুণ্য এবং তাক্বওয়া তার ইলহাম ও কাশ্‌ফের মাধ্যমে যাচাই করো না, বরং তাক্বওয়া ও পবিত্রতার মাধ্যমে তার ইলহাম ও কাশফকে পরখ করো। সবকিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র তাক্বওয়াতে উন্নতি করার চেষ্টা কর।

পবিত্র কুরআন আমাদের শিখিয়েছে তাক্বওয়া কি এবং কাকে বলে। সব পুণ্যের মূল হলো তাক্বওয়া বা খোদাভীতি। খোদার জন্য সব ধরনের অপকর্মকে পরিত্যাগ করা হল তাক্বওয়া। কোন কাজ সম্পর্কে যদি সামান্যতমও সন্দেহ থাকে তাহলে সেই কাজটি পরিত্যাগ করার নাম তাকওয়া। আল্লাহ্‌র কাছে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে সম্মানিত যে মুত্তাকী বা খোদাভীরু।

দারিদ্রতা ও অসচ্ছলতার মাঝে জীবন অতিবাহিত করা উচিত। অর্থাৎ নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করা উচিত। বড় বড় অলিদেরও শেষ পরীক্ষা অযথা রাগ হয় থাকে। অযথা রাগের কারণ হল, অহংকার বা আত্মশ্লাঘা। অযথা রাগ তখনই হতে পারে যখন মানুষ নিজেকে অন্যদের থেকে বড় মনে করে। অনেকেই রয়েছে যারা সন্মানিত ব্যক্তির সাথে ভদ্রভাবে কথা বলে আর দরিদ্রদের তুচ্ছ জ্ঞান করে। কিন্তু প্রকৃত পুণ্যবান তারা যারা একজন নগণ্য ব্যক্তির কথাও বিনয়ের সাথে শুনে এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করে।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং হযরত ইব্রাহীম (আ.) যে সম্মান লাভ করেছেন তা পিতৃ সূত্রে নয় বরং তাক্বওয়ার মাধ্যমে লাভ করেছেন। আল্লাহ্‌র জন্য তারা হরেক রকমের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন বলেই আল্লাহ্ তাদের সম্মানে ভূষিত করেছেন।

সত্যিকার অন্তঃদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা তাক্বওয়া ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। তাক্বওয়ার ছত্রচ্ছায়ার থেকে জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগান। পবিত্র কুরআনে প্রণিধান করুন। প্রতিদিন পবিত্র কুরআন পাঠের সাথে সাথে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর তফসীর পড়ারও চেষ্টা করুন। চিন্তা চেতনাকে পবিত্র করুন। আর কথা ও কাজের ভেতর সমন্বয় সাধন করুন।

রমযান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাসে পবিত্রতা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। ইসলামের সেবা শুধুমাত্র কথার মাধ্যমে সম্ভব নয়, বরং তাক্বওয়া ও পবিত্রতার মাধ্যমে সম্ভব। যদি তোমরা আকাঙ্খা কর যে, শত্রুর হামলা থেকে ইসলামকে রক্ষা করবে তাহলে তাক্বওয়া ও পবিত্রতা অবলম্বন কর। তোমরা দেখতে পাচ্ছ সব দিক থেকে মুসলমানদের কেমন দৈন্য দশা, সব জাতি মুসলমানদের ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। যদি তোমাদের অবস্থাও এমন হয় তবে সব শেষ হয় যাবে।

এক মুসলমান শরীয়ত বিরোধি কাজ করার ফলে শুধুমাত্র নিজের জন্যই দুর্নাম বয়ে আনে না বরং ইসলামের নামকেও কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে। নিজেদের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এবং কথাবার্তা এমন হওয়া উচিত যাতে শত্রুরাও ইসলামের বিরুদ্ধে কোন প্রকার অপবাদ আরোপ করতে না পারে।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন নিজের জন্য না হলেও যার সাথে তোমরা সম্পর্ক বন্ধনের দাবী কর তাঁর সম্মানের খাতিরে তাক্বওয়া অবলম্বন করো এবং পুণ্যবানদের দলভুক্ত হয়ে যাও।

মনে রাখবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেন, আল্লাহ্ কোন জাতীর অবস্থায় ততক্ষণ পরিবর্তন আনেন না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থায় পবির্তন আনে। এটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে আত্মবিশ্লেষণ করার এবং খোদাভীতি ও খোদাপ্রেমের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে জীবন কাটানোর তৌফিক দিন, আমীন।