মাহে রমযান এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়াদী

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৩-জুন, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৩রা জুন, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “মাহে রমযান এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়াদী”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, আগামী ৩-৪দিনের মধ্যে রমযান মাস আরম্ভ হতে যাচ্ছে। এই মাস অত্যন্ত বরকত ও কল্যাণের মাস। প্রত্যেক সুস্থ ও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের এ মাসে রোযা আবশ্যক। এখানে আজকাল দিন অনেক বড় যার ফলে প্রায় ১৮ বা ১৯ ঘন্টা রোযা রাখতে হবে। কিন্তু যেসব দেশে দিনের দৈর্ঘ ২২-২৩ ঘন্টা বা যেখানে নামেমাত্র সুর্র্য অস্ত গেলেও বাইরে দিনের মতই পরিস্কার থাকে সেখানকার আহমদীদের ঘড়ির কাঁটা দেখে নামায ও রোযা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারা পাশ্ববর্তী কোন দেশের সময় অনুসারে ১৮-১৯ঘন্টার হিসেব করে সেহেরী ও ইফতারী করবে।

এরপর হুযূর বলেন, ছোট-বড় অনেকেইে রমযান সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং তাদের সেসব প্রশ্নের উত্তরও দেওয়া হয়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এ যুগের ন্যায়বিচারক ও মিমাংসাকারী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি ইসলামী শিক্ষার ভিত্তিতে যেসব সিদ্ধান্ত ও মিমাংসা প্রদান করেছেন তা আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা, সেগুলো মান্য করা আবশ্যক।

এখানে আহমদী সন্তানরা প্রশ্ন করেন যে, আমাদের রোযা ও ঈদের দিন অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে ভিন্ন কেন? হুযূর বলেন, অ-আহমদীদের সাথে ভিন্ন হতে হবে এমন কোন কথা নেই। অনেক সময় তাদের সঙ্গে একই দিনে আমাদের রোযা ও ঈদ করা হয়। আসল বিষয় হলো, চাঁদ দেখে রোযা রাখা বা চাঁদ দেখে ঈদ করা। এসব দেশে যেহেতু আবহাওয়ার কারণে সব সময় চাঁদ দেখা সম্ভব হয় না তাই আমরা বিজ্ঞানের সহযোহিতা নিয়ে থাকি। তবে, কোথাও যদি ভুল হয়ে যায় অর্থাৎ, আমরা যদি আসলেই একদিন পরে রোযা রাখতে আরম্ভ করি তাহলে সেক্ষেত্রে মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেছেন, ঈদের পর একটি রোযা রাখতে হবে।

প্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলমান দেশে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি থাকে তারা বিচার-বিশ্লেষণ করে চাঁদ দেখার ঘোষণা দেয় কিন্তু পাশ্চাত্বের এসব দেশে এমন কোন নিয়ম নেই তাই ব্যক্তিগত ভাবে চাঁদ দেখার সুযোগ না পেলে বিজ্ঞানের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে কেননা; তারা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে অনেক দূরের বিষয়ও সহজেই দেখতে পারে বা অবগত হতে পারে।

রোযার জন্য সেহেরী খাওয়া আবশ্যক। মহানবী (সা.) বলেছেন, রোযার মাসে সেহেরী খাবে কেননা; এর মধ্যে কল্যাণ আছে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) স্বয়ং এর ওপর আমল করতেন এবং জামাতের বন্ধুদেরও এর ওপর আমল করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি কাদিয়ানে আগত অতিথিদের জন্য উপাদেয় সেহেরীর আয়োজন করতেন। তিনি অতিথিদের জন্য নিজ হাতে কাশ্মীরি পরোটা নিয়ে আসতেন। তাদের পেটপুরে ভালো খাবার খাওয়াতেন এবং খাওয়ানোর নির্দেশ দিতেন।

হুযূল বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কুরআনের শিক্ষামালার ওপর যথারীতি অনুশীলন করতেন। সেহেরীর সময় সম্পর্কে তাঁর নীতি ছিল মহানবী আদর্শ সম্মত। যেভাবে মহানবী (সা.) বলতেন বেলালের আযান শুনে তোমরা সেহেরী খাওয়া বন্ধ করবে না বরং ইবনে উম্মে মকতুমের আযান শুনলে সেহেরী খাওয়া বন্ধ করো। আযানের সাথে সেহেরীর কোন সম্পর্ক নেই। সুবেহ সাদেকের সাথে সেহেরীর সম্পর্ক তাই কেউ যদি আগে-ভাগে আযান দিয়ে দেয় তাহলে বিচলিত না হয়ে সেহেরী শেষ করা উচিত। এবং সুবহে সাদেকের আগ পযৃন্ত সেহেরী খাওয়া যেতে পারে।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) রোগী ও মুসাফিরকে রোযা রাখতে বারণ করতেন কেননা, এটি কুরআনের নির্দেশ। বরং অনেক সময় তিনি একেবারে দিনের শেষ প্রান্তে গিয়েও তাঁর সাহাবীদের রোযা ভাঙ্গিয়েছেন। একবার রমযান মাসে আসরের সময় মির্যা আইউব বেগ সাহেব কাদিয়ান আসেন। তিনি রোযা রেখেছেন জেনে মসীহ্ মওউদ (আ.) তাকে রোযা ভাঙ্গতে বলেন। আবার কোন কোন মুসাফির সাহাবীকে তিনি শরবত পান করিয়ে রোযা ভাঙ্গিয়েছেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলতেন, রোযা রাখা যেমন খোদার নির্দেশ অনুরূপভাবে অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে রোযা না রাখাও তাঁরই নির্দেশ। তাই যথাস্থানে রোযা রাখা বা না রাখা উভয়ই খোদার নির্দেশ আর তা পালন সওয়াবের কারণ।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, কেউ কোন জায়গায় তিন দিন অবস্থানের নিয়্যত করলে তাকে রোযা রাখতে হবে। কিন্তু কাদিয়ানের কথা ভিন্ন কেননা; কাদিয়ান আহমদীদের দ্বিতীয় মাতৃভূমি তাই কাদিয়ানে অবস্থানের সময় রোযা রাখতে হবে। তবে, কাদিয়ান আসা-যাওয়ার দিন রোযা রাখা যাবে না। রমযান মাসে কাদিয়ানে যারা জলসায় আসতেন তারা রোযা রাখতেন এবং রীতিমত তাদের জন্য সেহেরীর আয়োজন করা হতো।

হুযূর বলেন, রোযার মাসে প্রত্যেকের নিয়্যত করা উচিত যাতে সে এ মাসে রোযা রাখতে পারে। কিন্তু কোন শ্রমিক যদি একান্তই অপারগ হয় তাহলে তার জন্য অবকাশ রয়েছে। কিন্তু পরে তাকে ভাঙ্গা রোযা অবশ্যই রাখতে হবে।

অনেকে অসুস্থতার সময়ও রোযা রাখার ওপর জোর দেয় কিন্তু মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, এমনটি ঠিক নয়। জোর করে খোদাকে সন্তুষ্ট করা যায় না। খোদার নির্দেশ মেনেই খোদাকে সন্তুষ্ট করা যেতে পারে। অসুস্থতার কারণে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজেও অনেক সময় রোযা রাখতে পারতেন না। কিন্তু তিনি এর ফিদিয়া দিতেন এবং সুস্থ বোধ করলে রোযাও রাখতেন।

ফিদিয়া স্বরূপ কোন দরিদ্র ব্যক্তিকে আহার করানোর নিদের্শ সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করে যে, আমরা কোন দরিদ্রকে সরাসরি খাবার না খাইয়ে যদি সমপরিমাণ অর্থ দরিদ্রদের ফান্ডে দিয়ে দেই তাহলে হবে কি-না? হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, দিতে পারেন, এতে কোন সমস্যা নেই।

ফিদিয়ার অর্থ কী এ সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, ‘একবার আমার হৃদয়ে প্রশ্নোদয় হলো যে, ফিদিয়া নির্ধারণের কারণ কি? তখন জানতে পারলাম, এটি সামর্থ্য লাভের জন্য। অর্থাৎ এর মাধ্যমে যেন রোযা রাখার সামর্থ্য অর্জিত হয়। খোদা তা’লার পবিত্র সত্তাই শক্তি যুগিয়ে থাকে তাই সবকিছু খোদা তা’লার কাছেই চাওয়া উচিত। খোদা তা’লা সর্বশক্তির আধার। তিনি চাইলে একজন যক্ষ্মা-রুগীকেও রোযা রাখার সামর্থ্য দিতে পারেন। ফিদিয়ার উদ্দেশ্যই হলো, সেই শক্তি লাভ করা আর এটি খোদার কৃপায়-ই লাভ হয়। অতএব আমার মতে এভাবে দোয়া করলে খুব ভাল হয় যে, হে আমার প্রভু! এটি তোমার আশিসপূর্ণ একটি মাস, অথচ আমি এ থেকে বঞ্চিত। জানিনা, আগামী বছর বাঁচব কিনা কিংবা বাদ পড়া রোযাগুলো রাখতে পারব কিনা? যদি তাঁর কাছে এভাবে শক্তি চায় তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এমন হৃদয়কে খোদা তা’লা শক্তি দান করবেন’।

এরপর হুযূর একাধারে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এবং হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.)-এর বরাতে রমযান সম্পর্কিত হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিভিন্ন নির্দেশনা এবং তাঁর ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন।

এরমধ্যে কেউ তাহাজ্জুদের নামায যা রাতের শেষ প্রান্তে পড়া হয় তা রাতের প্রথম প্রহরে পড়া যায় কিনা প্রশ্ন করলে মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, হ্যাঁ যারা শ্রমিক বা পরিশ্রমের কাজ করেন তারা যদি রাতের শেষ প্রহরে উঠে ইবাদত করতে সমর্থ না হয় তাহলে রাতের প্রথম প্রহরে নফল পড়ায় কোন বাধা নেই।

সফরেও নফল পড়ার বিধান রয়েছে। আর বিশ রাকাত বা এর চেয়ে বেশি রাকাত নামায পড়ার কোন বিধান নেই। রাতের নামায মূলতঃ আট রাকাত। আর তারাবীহ্ মূলতঃ তাহাজ্জুদ, নতুন কোন নামায নয়।

একস্থানে হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তাঁর বান্দার জন্য স্বাচ্ছন্দ্য চান- কাঠিন্য চান না। মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ছিল, যদি কোন বিষয়ে দু’টি বৈধ পন্থা থাকতো তাহলে তিনি এর মধ্য হতে সহজ পন্থা বেছে নিতেন। আর তাঁর নিবেদিতপ্রাণ দাস হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও এমনটিই করতেন।

রোযা রাখার বয়স সম্পর্কে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রীতি ছিল তিনি শিশুদের রোযা রাখতে দিতেন না বরং ১২-১৩ বছর বয়স হয়ে গেলে ২/১টি করে রোযা রাখাতেন যাতে তাদের অভ্যাস গড়ে উঠে আর ১৮বছরে উপনীত হলে তারা রোযা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে হুযূর হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) এবং হযরত নওয়াব মোবারেকা বেগম সাহেবাকে দিয়ে হুযূর কত বয়সে রোযা রাখিয়েছেন তা উল্লেখ করেন।

মহানবীর আদর্শ এবং যুগ ইমামের যাপিত জীবনের আলোকে রমযান সম্পর্কে এসব কথা তুলে ধরে হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে তাক্বওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে আর আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে মাহে রমযান থেকে কল্যাণমন্ডিত হওয়ার তৌফিক দান করুন, আমীন।