শয়তানের কবল থেকে রক্ষা পেতে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ: )-এর শিক্ষা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২০-মে, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২০শে মে, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার সুইডেনের গোথেনবার্গের নাসের মসজিদে “শয়তানের কবল থেকে রক্ষা পেতে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ: )-এর শিক্ষা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) সূরা নূরের ২২ নাম্বার আয়াত পাঠ করেন যার অর্থ হলো, হে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। আর যে-ই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে (তার জানা উচিত) নিশ্চয় সে অশ্লীলতা ও অপছন্দনীয় কাজের আদেশ দেয়। আর তোমাদের ওপর আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও তাঁর কৃপা যদি না হতো তাহলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হ’তে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ্ যাকে চান পবিত্র করেন। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা (ও) সর্বজ্ঞ।।

এরপর হুযুর (আই.) বলেন, এ আয়াত ছাড়াও আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনের অন্যত্রও শয়তানের নির্দেশ না মানার বিষয়ে বিশ্বাসীদের তাকিদ দিয়েছেন। কেননা, শয়তান আল্লাহ্‌র আদেশের বিরোধিতা করে এবং বিদ্রোহ করে। তাই যারা তাকে অনুসরণ করে তাদেরও সে বিদ্রোহের শিক্ষাই দেয়। শয়তান জাহান্নামের ইন্ধন আর যারা তাকে অনুসরণ করে তাদেরকেও জাহান্নামের ইন্ধন বানিয়ে দেয়।

উপরোক্ত আয়াতের আলোকে আল্লাহ্ বলেন, তারপরও কি তোমরা এটা বুঝতে পার না যে, শয়তান তোমাদের চরম শত্রু! অনেকে আছে যারা ধর্ম বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। আবার অনেকে এমনও রয়েছে যারা পবিত্র কুরআন শুধুমাত্র আপত্তি খুঁজে বের করার জন্য পাঠ করে, আর এর উৎকর্ষ গুণাবলী থেকে লাভবান হয় না এবং শয়তানের কবল থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করে না। এছাড়া এমন লোকও আছে যারা নিজেদের মু’মিন বলে আখ্যা দেয়ার পরও নির্বুদ্ধিতার কারণে অথবা জ্ঞানের অভাবে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।

এ আয়াতে মু’মিনদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে চিন্তামুক্ত হয়ে যেও না, বরং মৃত্যুকাল পর্যন্ত শয়তানের আক্রমনের আশংকা রয়েছে। শয়তান যেভাবে সাধারণ মানুষকে পথভ্রষ্ট করে সেভাবে মু’মিনকেও পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম।

এ বিষয়ে নসীহত করতে গিয়ে হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, এ কারণে মানুষের উচিত সে যেন সব সময় আল্লাহ্কে স্মরণ রাখে। কেননা, শয়তান সৃষ্টির প্রথম দিনই বলেছিল, সে মানব জাতিকে পথভ্রষ্ট করার লক্ষ্যে পথের প্রতিটি মোড়ে ওঁৎপেতে বসে থাকবে এবং অধিকাংশ মানুষ তাকে অনুসরণ করবে।

এরপর হুযুর (আই.) সূরা নিসা’র ৯৪ নাম্বার আয়াতের (ওয়া মাঈয়াক্বতুল মু’মিনান মুতাআম্মিদান ফা জাযাউহু জাহান্নাম) উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বর্তমানে মুসলমান বিশ্বে যা কিছু ঘটছে এসব কি? ইসলামের নামে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করছে অথচ পবিত্র কুরআনে এর বিপরীত নির্দেশ রয়েছে। আজ কট্টরপন্থীদের পক্ষ হতে মুসলমানকে হত্যার প্রতিদানে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। অথচ আল্লাহ্ বলেছেন এর পরিণাম ’জাহান্নাম’। বস্তুতঃ এটি শয়তানের প্রতিশ্রুতি।

হুযূর (আই.) বলেন, এ কারণেই সব সময় আল্লাহ্‌কে স্বরণ রাখতে বলা হয়েছে। শুধু চরমপন্থীরাই নয় বরং কোন মানুষ যখন আল্লাহ্‌র ছোট-খাটো আদেশও অমান্য করে, প্রকৃতপক্ষে সে ধীরে ধীরে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে আরম্ভ করে। এ জন্যই অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন এবং আত্মবিশ্লেষণ করা প্রত্যেক বিশ্বাসীর জন্য আবশ্যক।

হুযূর (আই.) আরো বলেন, যারা অন্যায় এবং ব্যাভিচারে লিপ্ত তাদের ওপর শয়তানের রাজত্ব প্রকাশ্য বিষয়। কিন্তু ঈমানদার হওয়ার দাবিকারকদের যদি শয়তান প্ররোচিত করে তবে তা বোঝা সহজ কাজ নয়, কেননা সে যখনই পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে তখন পুণ্যের মাধ্যমেই করে। পুণ্যের বেশ ধরেই সে মানুষের সর্বনাশ করে। হযরত আদম (আ.)-কেও সে পুণ্যের প্রলোভন দেখিয়েই অন্যায়কর্মে বাধ্য করেছিল।

এরপর হুযূর (আই.) পর্দা বলেন, বাহ্যতঃ অনেক খারাপ জিনিস বা অপরাধ ক্ষুদ্র মনে হলেও যখন তা সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ করে তখন অনেকে সে অপরাধের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে রাখে, অনেকে আবার হীনমন্যতার কারণে চুপ করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এ সমাজে পর্দাকে কটু দৃষ্টিতে দেখা হয়। যারফলে অনেক আহমদী মেয়ে হীনমন্যতায় ভোগে আর পর্দার ক্ষেত্রে শৈথিল্য দেখায়। শয়তান প্ররোচনা দেয়, পর্দা একটি নগণ্য বিষয়, এটি ছেড়ে দেয়া কোন বড় অপরাধ নয়, এটি ছাড়া অন্যান্য সব ইসলামী আদেশ-নিষেধ তো তুমি মেনে চলছই। এভাবে সহানুভূতির ছলে সে মানুষকে পথভ্রস্ট করে। এক্ষেত্রে আমাদের মেয়েরা একথাটি ভুলে যায় যে, পর্দার আদেশ পবিত্র কুরআনে রয়েছে, তাই কোনভাবেই তা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

তিনি আরো বলেন, তবে, এমন মেয়েও রয়েছে যারা পর্দা বিদ্বেষীদের কড়া জবাব দেয় আর বলে, আমরা কোন পোষাক পড়বো বা না পড়বো এটি আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। তোমরা আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কে? অতএব যেখানেই থাকুন না কেন হীণমন্যতায় ভোগার কোন কারণ নেই। এসব দেশের বাবা-মায়ের উচিত তাদের সন্তানদের বলা যে, ইসলামের আদেশ মান্য করার মধ্যেই প্রকৃত সম্মান নিহিত।

একইভাবে ছেলেরাও ছোট-ছোট পাপে লিপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে বড় পাপে জড়িয়ে পড়ে। বাইরে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যায়। বাবা-মা’র উচিত সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বসূলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা। ঘরে ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে ঘরে শান্তি বিরাজ করে তাহলে সন্তানরা আর বাইরে গিয়ে শান্তি খুঁজবে না। এরপর বাবা-মায়ের দায়িত্ব হবে, সন্তানদের মসজিদমুখী করা। আর অঙ্গসংগঠেনের দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে সামলানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

হুযূর আরো বলেন, শয়তান জানে মানুষ যতক্ষণ আল্লাহ্‌র আশ্রয়ে রয়েছে সে তাকে পথভ্রষ্ট করতে সক্ষম হবে না, তাই সে সব সময় মানুষকে আল্লাহ্‌র সুরক্ষিত দূর্গ থেকে বের করার জন্য পুণ্যের প্রলোভন দেখিয়ে থাকে।

এরপর হুযুর (আই.) নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার বিষয়ে হাদিসের বরাতে বলেন, নারী-পুরুষের কখনও নিভৃতে সাক্ষাত করা বৈধ নয়। কেননা, শয়তান মানুষের শিরা উপশিরায় রক্তের মত প্রবহমান। এ সমাজে প্রত্যেকের বিশেষভাবে এদিকে খেয়াল রাখা উচিত, যেখানে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে একটি সাধারণ বিষয় মনে করা হয়।

এরপর হুযূর (আই.) বলেন, অধিকাংশ মানুষ অনেক রাত পর্যন্ত টিভি অথবা ইন্টারনেটে সময় কাটায়, আর সকালে ফজরের নামায পড়ে না। এমন মানুষ প্রকৃতপক্ষে নামাযের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। অথচ নামায সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এবং সময়মতো নামায পড়া প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক।

এরপর হুযূর শয়তানের খপ্পর থেকে বাঁচার জন্য দোয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর একটি দোয়ার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের দোয়া শিখিয়েছেন যে, হে আমাদের আল্লাহ্! আমাদের হৃদয়সমূহে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দাও। আমাদের সংশোধন করে দাও এবং আমাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করো। আমাদেরকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোর পানে নিয়ে যাও। এবং আমাদেরকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অশ্লীলতা হতে রক্ষা করো। আর আমাদের জন্য আমাদের কর্ণসমূহে, চোখে, হৃদয়ে এবং আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মাঝে কল্যাণ নিহিত রাখো। আমাদের প্রতি দয়ার দৃষ্টি দাও কেননা; তুমিই তওবা গ্রহণকারী এবং পরম দয়াময়। এবং আমাদেরকে নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী এবং তা স্মরণকারী এবং গ্রহণকারী বানাও। হে আল্লাহ্! আমাদের ওপর তোমার নিয়ামতরাজিকে সম্পূর্ণ করো।

এরপর হুযূর তওবা ও ইস্তেগফার সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্র হতে বিভিন্ন অংশ পাঠ করেন। তিনি বলেন, আমাদের সদা-সর্বদা দোয়া ও ইস্তেগফার করতে থাকা উচিত যাতে শয়তানের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ইস্তেগফারের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে বলেন, আল্লাহ্ তা’লা চিরকালের জন্য ইস্তেগফারের ব্যবস্থা করিয়েছেন। অর্থাৎ মানুষ যেন প্রত্যেক পাপের জন্য তা বাহ্যিক হোক বা আভ্যন্তরীণ, সে তার জ্ঞান রাখুক বা না রাখুক, এবং তার হাত, পা, জিহ্বা, নাক, কান ও চোখ মোটকথা সব ধরনের গুনাহ্ থেকে যেন ইস্তেগফার করতে থাকে। আজকাল আদম (আ.)-এর দোয়া পাঠ করা উচিত অর্থাৎ, হে আমাদের প্রভু-প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রাণের ওপর অবিচার করেছি তুমি যদি আমাদের প্রতি দয়া না করো এবং আমাদের ক্ষমা না করো তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য হবো।

হুযূর বলেন, কোন উচ্চবাচ্য ছাড়াই আল্লাহ্‌র কথা পূর্ণরূপে মেনে চলার চেষ্টা করুন এবং কুরআনের শিক্ষামালা মেনে উন্নত মানে অধিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করুন। আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর প্রতি সমর্পিত থাকার এবং শয়তানের পদাঙ্গ অনুসরণ থেকে মুক্ত থাকার তৌফিক দিন, আমীন।