আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকৃত তাৎপর্য

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৬-মে, ২০১৬

নুসরত জাহান মসজিদ, ডেনমার্ক

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৬ই মে, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার ডেনমার্কের নুসরত জাহান মসজিদে “আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকৃত তাৎপর্য”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, ১১বছর আগে আমি এখানে এসেছিলাম তখনকার তুলনায় আজ ডেনমার্ক জামাত সর্বক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। জামাতের সহায়-সম্পদ বেড়েছে এবং সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আল্লাহ্ নিজ অপার করুণায় এসব উন্নতি দিয়েছেন, এজন্য আল্লাহ্‌র প্রতি আমাদের সবার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আবশ্যক।

এরপর হুযূর বলেন, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কীভাবে করতে হয় তা আমাদের হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.)- এর কাছ থেকে শেখা উচিত।

এরপর হুযুর (আই.) ডেনমার্কে বসবাসকারী আহমদীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহ্ আপনাদের পিতা-পিতামহদের ওপর বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন বিধায় তারা আহমদীয়াত গ্রহণ করেছিলেন। আজ আপনারা জ্যেষ্ঠদের কল্যাণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধে ভোগ করছেন। এখন জাগতিক চাকচিক্য এবং বৈষয়িক উন্নতির কারণে যদি আপনারা ধর্ম থেকে দূরে সরে যান এবং ধর্মীয় বিষয়াদির প্রতি আপনাদের মনোযোগের অভাব দেখা দেয় তাহলে আপনাদের আগামী প্রজন্ম আহমদীয়াত থেকে দূরে সরে যাবে আর পুর্বপুরুষদের দোয়া ও পুণ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। কাজেই আপনারা আত্মবিশ্লেণ করুন এবং যেসব ক্ষেত্রে নিজেদের ঘাটতি ও দুর্বলতা রয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে আত্মসংশোধনের প্রতি মনোযোগ দিন। যদি এমনটি করেন তাহলে আপনাদের পূণ্য কাজের পুরস্কার আল্লাহ্ অবশ্যই দিবেন এবং আপনাদের বংশধররাও এত্থেকে কল্যাণমন্ডিত হবে।

ডেনমার্কে বসবাসকারী পুরাতন, নবাগত এবং স্থানীয় অর্থাৎ সব শ্রেণীর আহমদীদের উদ্দেশ্যে নসীহত করতে গিয়ে হুযূর (আই.) বলেন, আপনাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত যে, আমরা সত্যিকার অর্থে বয়আতের অঙ্গীকার পুর্ণ করছি কি-না? আমরা কি শুধুমাত্র সামাজিকতা এবং লৌকিকতার কারণে আহমদীয়াতের সাথে যুক্ত রয়েছি যে, এটি আমাদের পুর্বপুরুষদের জামাত?

এরপর হুযুর (আই.) কসভো এবং এর পূর্ব ইউরোপ থেকে আগত নবাগত আহমদীদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রত্যেক আহমদী নারী-পুরুষের উচিত আত্ম-পর্যালোচনা করে দেখা, সে বয়আতের অঙ্গীকার পালনের চেষ্টা করছে কি-না? হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের ওপর যেসব দায়িত্ব ও কর্তব অর্পণ করেছেন, তাঁর মান্যকারী ও অনুসারী হিসেবে আমরা সেসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করছি কি-না? ইসলামের শিক্ষা অনুসারে জীবন যাপন করছি কি-না? সন্তানদের ইসলামী শিক্ষামালার ওপর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছি কি-না? এসব বিষয় আমাদের সবারই যাচাই করে দেখা উচিত।

এরপর হুযুর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজ জামাতের কাছে কি প্রত্যাশা রেখেছেন এবং এই জামাত গঠনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি সম্পর্কে তাঁর রচনাসমগ্র হতে বিভিন্ন অংশ পাঠ করেন। যার বিষয়বস্তু ছিল, তাক্বওয়া, ইবাদত, নামায, ধর্মকে পার্থিবতার ওপর প্রাধান্য দেয়া, মানুষের প্রতি সদয় হওয়া, ক্রোধ সংবরণ করা ইত্যাদি।

তিনি (আ.) বলেন, আল্লাহ্ জীবিতদের সমন্বয়ে একটি নতুন দল গঠন করতে চান বলেই এই জামাত প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমরা জীবিত হওয়ার জন্য বয়আত করেছি তাই আমাদেরকে জীবিত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর গৃহের চতুর্র্সীমার মধ্যে যারা প্রবেশ করেন আল্লাহ্ তাদেরকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু যারা শুধুমাত্র নামে মাত্র বয়আত করে এবং তাঁর সাথে কৃত অঙ্গীকার পালনে যত্নবান নয় তাদের বিষয়ে আল্লাহ্ দায়িত্বমুক্ত।

তিনি (আ.) আরো বলেন, এই অন্ধকার ও অমানিশার যুগে ধর্মের প্রতি কারো মনোযোগ নেই, কারো অধিকারের প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ নেই, সবাই পার্থিব কাজে মগ্ন, পার্থিব ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য আধ্যাতিক ক্ষতিকে বরণ করে নিতেও তারা প্রস্তুত। যেমন, অনেকেই মামলা- মোকদ্দমায় জেতার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়। পাপ থেকে যদি কেউ বিরত থাকে তবে তা পুণ্যের জন্য নয়, বরং জাগতিক শাস্তির ভয়ে। ভয় দূর হয়ে গেলেই সাথে সাথে পাপাচারে লিপ্ত হয়। বর্তমানে সত্যিকার তাক্বওয়া উঠে গেছে। যখন খোদা তা’লা নিজ ফসলকে নষ্ট হতে দেখেন তখন তিনি নতুন ফসল নিয়ে আসেন। যেমন পবিত্র কুরআনে রয়েছে, (اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّکْرٰ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ) অর্থাৎ নিশ্চই আমরা এই যিকিরকে অবতীর্ণ করেছি আর আমরাই এর সুরক্ষা করব। আল্লাহ্ তা’লা দেখেন যে, মানুষের অন্তর তাক্বওয়া শূন্য হয় যাচ্ছে। তাই তিনি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে পাঠিয়েছেন কেননা; তিনি একটি নতুন জাতি সৃষ্টি করতে চান।

হুযূর (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যখন এ কথাগুলো বলেছেন তখনই যে কেবল এরূপ পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল তাই নয় বরং আজও বিদ্যমান। তিনি আরও বলেন, অন্যদের কথা বাদ দিলেও আমরা যারা আহমদী, যারা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মেনেছি, আমরা কি পার্থিব কাজের ওপর ইবাদতকে প্রাধান্য দেই? যদি সময়মত নামায পড়িও তাও কোনরকম মাথার বোঝা ছুঁড়ে ফেলার মত তাড়াহুড়ো করে পড়ি। পার্থিবতার ওপর ধর্মকে অগ্রাধিকার প্রদানের অঙ্গীকার রক্ষায় আমরা কতটা যত্নবান? ইহসান বা অনুগ্রহের আদেশ দেয়া হয়েছে, অনুগ্রহ তো দূরের বিষয় আমাদের মধ্যে অনেকে অন্যের প্রাপ্য অধিকারও খর্ব করছে।

হুযূর বলেন, আমরা জীবিতদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য বয়আত করেছি তাই আমাদের উচিত সর্বদা হযরত হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর নির্দেশাবলীর প্রতি দৃষ্টি রাখা। আল্লাহ্‌কে পাওয়ার চেষ্টা করা।

আর পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেন, (وَ الَّذِیْ جَاھَدُوْا فِیْنَا لَنَھْدِیَنَّھُم سُبُلَنَا) আর যারা আমাদের উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করে আমরা তাদেরকে আমাদের পথে পরিচালিত করবো। এ আয়াতে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে মানুষ যখন আল্লাহ্‌কে পাবার জন্য চেষ্টা করে তখন তিনি স্বয়ং বান্দাকে হাতে ধরে তাকে সুপথে পরিচালিত করেন।

হুযূর বলেন, যদি কারো হৃদয় অমানিশায় ছেয়ে থাকে তাহলে তার ইবাদত ও দোয়া কোন কাজে আসে না। বিশ্বাসের দিক থেকে ঠিক থাকলে অন্তর পরিস্কার না থাকার কারণে তার সব দোয়া ও চেষ্টা সাধনা বৃথা যায়। তাই আমাদের নিজ অন্তরকে কলুষমুক্ত করার চেষ্টা করা উচিত। অন্তর পরিস্কার না হলে এমন লোকদের ইবাদত ও দোয়া আল্লাহ্ তাদের মুখে ছুঁড়ে মারেন। আর যদি মানুষের অন্তরাত্মা পরিস্কার হয় তাহলে খোদা স্বয়ং তাদের অভিভাবক হয়ে যান।

এরপর হুযূর মসীহ্ মওউদ (আ.) ভাষায় মানুষের ঈমানকে মজবুত করার জন্য সৎকর্মের আবশ্যকতা এবং এর গুরুত্ব বর্ণনা করেন।

খুতবার শেষাংশে হুযূর বলেন, হাদীসে আছে, কেউ যদি আল্লাহ্‌র পানে সামান্য জোরে হাঁটে তাহলে আল্লাহ্ তার কাছে দ্রুত ছুটে যান। আল্লাহ্‌র কাছে আমার প্রার্থনা – আমরা যেন নিজেদের ঈমানকে সুদৃঢ় করি, আল্লাহ্‌র আদেশ-নিষেধের ওপর আমল করতঃ তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনকারী হই, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনকারী হই, নিজেদের আমল দ্বারা বিশ্ববাসীকে সত্যের পথ প্রদর্শনকারী হই আর আমাদের প্রতি আল্লাহ্ তা’লা যেসব অনুগ্রহ করেছেন সত্যিকার অর্থে এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী হই। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে এর তৌফিক দিন, আমীন।