শয়তানের আক্রমন থেকে মু’মিনদের আত্মরক্ষার উপায়

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১১-মার্চ, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১১ই মার্চ, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “শয়তানের আক্রমন থেকে মু’মিনদের আত্মরক্ষার উপায়”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) পবিত্র কুরআনের যে আয়াতটি পাঠ করেন তার অনুবাদ হলো, হে যারা ইমান এনেছ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। আর যে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার জানা উচিত, নিশ্চয় শয়তান অশ্লীলতা এবং অপছন্দনীয় কাজের আদেশ দেয়। আর তোমাদের ওপর আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও কৃপা না হলে তোমরা কখনই পবিত্র পতে পারতে না। বস্তুতঃ আল্লাহ্ যাকে চান পবিত্র করেন আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।

এরপর হুযূর বলেন, শয়তান আদি থেকেই মানুষের শত্রু আর চিরকাল শত্রুই থাকবে। তার মাঝে চিরস্থায়ী কোন শক্তি আছে বলে সে এমনটি করছে না বরং মানব সৃষ্টির সময় আল্লাহ্ তা’লা তাকে স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন, কেননা তিনি জানতেন যে, তাঁর সত্যিকার বান্দারা শয়তানের আক্রমন থেকে মুক্ত থাকবে। শয়তান প্রকাশ্যে শত্রুতা করে না বরং সে বিভিন্ন ছল-চাতুরী, ধোকা ও প্রতারণা এবং জাগতিক লোভ-লালসার মাধ্যমে মানুষকে প্ররোচিত করে এবং মানুষকে অহংকারী কওে তুলে এবং মানুষকে সৎকাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং অপকর্মের নিকটে নিয়ে যায়।

শয়তান আল্লাহ্‌কে বলেছিল, তুমি যে বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছ তাতে তারা উভয় দিকে যেতে পারে। তাই এদেরকে আমি আমার দিকে ধাবিত করবো আর মন্দের প্রতিই তাদের বেশি আকর্ষণ থাকবে। যদি তুমি আমাকে অনুমতি দাও তাহলে সকল দিক থেকে আমি তাদের ওপর আক্রমন করবো। এমনকি সিরাতে মুস্তাকীমে বসেও আমি তাদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করবো। তোমার নিষ্ঠাবান বান্দারা আমার এই কুমন্ত্রণা ও প্রতারণা থেকে রক্ষা পেলেও অধিকাংশ মানুষই আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। আমার ধোকায় পড়ে নিজেদের সর্বস্ব হারাবে।

আল্লাহ্ তা’লা তাকে অনুমতি দেওয়ার পর বলেন, যারা তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করবে আমি তাদের জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। তবে এর পাশপাশি আল্লাহ্ তা’লা স্বীয় নবীগণকে প্রেরণের ধারা সূচনা করেন আর তাঁদের মাধ্যমে মানুষকে সরল-সুদৃঢ় পথে পরিচালিত করার এবং তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা নেন। এবং তাদেরকে নিজেদের ইহ ও পরকালকে সুন্দর করার মাধ্যমও বাতলে দেন।

আল্লাহ্ একথাও স্পষ্টভাবে নিজ বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে সহানুভূতি দেখানোর নামে তোমাদের প্রতারিত করবে। তোমাদেরকে অশ্লীলতা, নোংরামি ও ক্ষয়-ক্ষতির দিকে আহ্বান করবে আর বিচার দিবসের দিন সে বলবে, আমি লোভ-লালসা দেখিয়ে তোমাদের প্রতারিত করেছি। ধোকা ও প্রতারণার মাধ্যমে আমি তোমাদের ক্ষতি করেছি, খোদার নির্দেশ পরিপন্থী মন্দ কাজে আমি তোমাদের প্রলুব্ধ করেছি আর এটিই আমার উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু তোমরা তো বিবেক-বুদ্ধি রাখো তাহলে তোমরা কেন বুদ্ধি খাটালে না। তোমরা কেন আমার ক্ষপ্পরে পড়লে, খোদার কল্যাণময় আওয়াজের ওপর আমার মন্দ আওয়াজকে প্রাধান্য দিলে? যাও এখন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করো। এভাবেই শয়তান মানুষের সাথে শত্রুতা করে আর করবে। পবিত্র কুরআনের অগণিত স্থানে আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা, ধোকা ও প্রতারণা থেকে মুক্ত থাকার জন্য সাবধান করেছেন।

হুযূর বলেন, এখানে অনেকেই প্রশ্ন করেন, আল্লাহ্ শয়তানকে কেন বানালেন? প্রথমদিনই তাকে ধ্বংস করলেন না কেন? তাহলে এসব সমস্যাই দেখা দিত না।

হুযূর এ সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বিভিন্ন উদ্ধৃতি পেশ করেন এবং শয়তানের সংজ্ঞা, এদের কাজ এবং মানুষ কীভাবে এদের ধোকায় পড়ে প্রতারিত হয় তা ব্যাখ্যা করেন।

হুযূর বলেন, শয়তান আকষ্মিকভাবে মানুষের ওপর আক্রমন করে না। ধীরে ধীরে তাকে ছোট-খাটো পাপে প্ররোচিত করে এরপর সে আস্তে আস্তে বড় পাপ করতে আরম্ভ করে এবং অহংকারী হয়ে উঠে। তাই মানুষের সর্বদা আত্মবিশ্লেষণ করতে থাকা উচিত এবং সর্বদা আত্মশুদ্ধির জন্য চেষ্টা করা উচিত।

অনেক সময় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিপদে পড়ে আর বলে, আল্লাহ্ই আমাদের এই বিপদে ফেলেছেন, আসলে আল্লাহ্ কাউকে বিপদে ফেলেন না। মানুষের কর্মই তাকে বিপদে ফেলে। মানুষ অনেক সময় অনেক গোপন পাপ করে, আল্লাহ্ যেহেতু অনেক বেশি ক্ষমাশীল ও মার্জনাকারী তাই তিনি একান্ত অনুগ্রহবশে বান্দাকে বার বার ক্ষমা করেন। কিন্তু মানুষের অভ্যন্তরীন পাপের কারণেই সে বিপদে পড়ে। হুযূর বলেন, অনেক সময় বাহ্যিক রোগের চেয়ে আভ্যন্তরীণ রোগ বেশি ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। রোগের স্বরূপ জানলে এর চিকিৎসা করা সহজ হয় কিন্তু অনেক রোগ আছে যা শেষ সময় গিয়ে প্রকাশ পায় আর সেসময় প্রাণ বাঁচানোও দায় হয়ে পড়ে। যেমন যক্ষা বা ক্যান্সার রোগ। অনেক সুস্থ-সবল মানুষও হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং শেষে জানা যায় যে, সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত আর এই রোগই তার জন্য প্রাণহারী প্রমাণিত হয়।

হুযূর বলেন, মানুষের ফিরিশতার স্বভাব ও গুণ আয়ত্ত্ব করা উচিত শয়তানের নয়, তবেই মানুষের ইহ ও পরকাল সুনিশ্চিত হতে পারে। মানুষকে পুণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ফিরিশ্তা আর মন্দকর্মের প্রতি প্ররোচিত করে শয়তান। তাই মু’মিনকে সর্বদা আত্মজিজ্ঞাসা করতে থাকা উচিত আর দুর্বলতার কোন লক্ষণ দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা দূরীভূত করার জন্য চেষ্টা করা উচিত।

কেননা আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন, যে আত্মশুদ্ধি করে সেই সফল। তাই সফলতার জন্য, খোদার নৈকট্য লাভের জন্য, শয়তানকে মারার জন্য এবং পবিত্র জীবনের অধিকারী হওয়ার জন্য আত্মশুদ্ধি আবশ্যক।

আল্লাহ্ করুন, আমরা যেন বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহ্‌র দাসত্ব বরণ করি, সকল প্রকার অশ্লীল, নোংরা ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে মুক্ত থাকি, সব ধরনের মন্দ থেকে যেন মুক্ত থাকি, সকল প্রকার অহংকার থেকে যেন মুক্ত হই। আত্মশুদ্ধির জন্য সদা সর্বদা যেন চেষ্টা করতে থাকি যাতে আল্লাহ্‌র কৃপারাজির উত্তরাধিকারী হতে পারি। আমাদের দৃষ্টি যেন সর্বদা খোদার প্রতি নিবদ্ধ থাকে আর তিনিই যেন সর্বদা আমাদের প্রভু-প্রতিপালক থাকেন। তাঁর রাজত্বই যেন আমাদের হৃদয় মন্দিরে আসন গেড়ে বসে। তিনিই আমাদের উপাস্য হোন আর আমরা সর্বদা তাঁকেই ডাকতে থাকি আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ থেকে মুক্ত হতে পারি। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে এর তৌফিক দিন।