হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কিছু শিক্ষণীয় উপদেশ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৪-মার্চ, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ৪ঠা র্মাচ, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কিছু শিক্ষণীয় উপদেশ”- এ বিষয়ে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর (আই.) বলেন, অনেক সময় কৌতুকের মাধ্যমেও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) জামাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কিন্তু এর পিছনেও তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সংশোধন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একজন মালিনীর ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তার দু’জন কন্যা ছিল। একজনের বিয়ে হয় কুমারের সাথে আর অন্যজনের বিয়ে হয় মালির সাথে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখলেই সেই মালিনী অস্থির ও উদ্বোগাকুল হয়ে বলতো আমার এক মেয়ে আর নেই। কারণ বৃষ্টি হলে কুমারের তৈরি মাটির বাসন-কোসন নষ্ট হবে আর বৃষ্টি না হলে মালির শবজি উৎপন্ন হবে না। এই ঘটনা বর্ণনার পর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, কাদিয়ানে একবার দু’জন আহমদীর মাঝে বিবাদ হয়। বন্ধুরা তাদের মাঝে মিমাংসার চেষ্টা করলেও তারা আদালতের দ্বারস্থ হয় এবং শুনানীর সময় ঘনিয়ে এলে তারা উভয়ে আমাকে দোয়ার জন্য পত্র লিখে। এখানে আমার অবস্থাও সেই মালির মতই। আমি কার পক্ষে দোয়া করবো? কেননা তারা উভয়ে আমার অনুসারী, আমার আপনজন। তাই আমি যার প্রাপ্য সেই যেন তা পায় এই দোয়াই করি।

হুযূর (আই.) বলেন, এই একই অবস্থা আজও বিরাজমান। আমাদের বিচার বিভাগে যখন আহমদীদের পক্ষ থেকে মামলা আসে তখন তারা আমার কাছেও দোয়া চায়। আমি কার জন্য কি দোয়া করবো? এভাবে জামাতের ইমামকে বিপদে ফেলার কোন মানে হয় না। আমি তো কেবল সে দোয়াই করবো যা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) করেছিলেন, অর্থাৎ যে সত্যের ওপর আছে তারই জয় হোক।

হুযূর (আই.) বলেন, এখানে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে স্মরণ রাখা উচিত, অধিকার রক্ষার জন্য আদালদের শরণাপন্ন হওয়ার বিধান থাকলেও জামাতের বন্ধুরা এবং জ্যেষ্ঠরা যদি মিমাংসার উদ্যোগ নেন তাহলে তা মাথা পেতে নেওয়া উচিত। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগের আহমদীরাও মামলা-মোকদ্দমা করতো এই অজুহাত দেখিয়ে নিজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া সমীচীন নয়।

এরপর হুযূর (আই.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আর তাহলো পিতামাতার সম্মান করা আর তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা। আল্লাহ্‌র নির্দেশ পরিপন্থী না হলে তাদের কথা সানন্দে মেনে চলা উচিত। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, প্রত্যেকের জন্য তার পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার আবশ্যক। তাদের কোন আদেশ অমান্য করা উচিত নয়। কিন্তু অনেক যুবক আছে যারা তাদের পিতামাতার যথাযথ সম্মান করে না এবং তাদের অধিকারের বিষয় সচেতন হয়। বরং কেউ যদি বড় কোন পদে অধিষ্টিত হয় তাহলে সে তার দরিদ্র পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাত করতে এবং তাদের পরিচয় দিতেও কুন্ঠাবোধ করে।

হুযূর (আই.) এখানে একজন হিন্দুর উদাহরণ টেনে বলেন, একজন গরিব হিন্দু তার ছেলেকে বিএ এবং এমএ পাশ করায়। এরপর সে সরকারী উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হলে একদিন সেই পিতা তার ছেলের সাথে সাক্ষাতের জন্য যান। কিন্তু সহকর্মীদের সামনে সে তার পিতাকে বাড়ীর চাকর বলে পরিচয় দেয় তখন সেই পিতা রাগতঃস্বরে বলেন, আমি তার নয় নই বরং তার মায়ের চাকর। এতে সেখানে উপস্থিত লোকেরা বুঝতে পারে যে, ইনি চাকর নন বরং তার পিতা। এরপর তারা সেই ছেলেকে ভর্ৎসনা করে। কাজেই অনেকে নিজেদের মিথ্যা মান-সম্মানের ভয়ে পিতামাতা বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায় না আর এভাবে তারা পিতামাতার নাম উজ্জ্বল করার পরিবর্তে তাদের জন্য দুর্নামের কারণ হয়।

এরপর হুযূর (আই.) আরেকটি শিক্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা করেন। অনেক সময় মানুষ কোন বক্তার জোরালো বক্তৃতা শুনে সাময়ীক আনন্দ ভোগ করেন আর অনেক বক্তাও শ্রোতাদের কাছ বাহবা নেওয়ার জন্য বা সস্তা নাম কামানোর জন্য বক্তৃতার সময় বিভিন্ন ঢং করে থাকে। একবার এমনই একজন বক্তা খুব জোড়ালো বক্তৃতা দেয় আর শ্রোতাদের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য গলা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্বর বা আওয়াজ বের করে। ঘটনাক্রমে যাত্রাপথে একজন কৃষক সেখানে দাঁড়িয়ে তার বক্তৃতার কিছুটা অংশ শুনে কাঁদতে আরম্ভ করে। সেই মৌলভী নিজের দাম বাড়ানোর জন্য সবাইকে বলে, দু’ধরনের মানুষ পৃথিবীতে বাস করে এরমধ্যে এক ধরনের মানুষ আপনারা যারা দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা শোনার পরও এর কোন প্রভাব আপনাদের ওপর পড়েনি আরেক ধরনের মানুষ হচ্ছে ঐ কৃষক, যিনি বক্তৃতার অল্প একটু অংশ শুনেই এর মর্ম বুঝে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। সেই কৃষককে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, আপনি কি বুঝে কাঁদছেন? তিনি বলেন, গতকাল আমার মহিষের বাচ্চা মারা গেছে, মরার সময় ওর গলা দিয়ে এমনই আওয়াজ বেরোচ্ছিল যা এখন এই মৌলভীর গলা দিয়ে বেরোচ্ছে। ওনার আওয়াজ শুনে আমার সেই মৃত বাছুরের কথা মনে পড়েছে বিধায় আমি কাঁদছি।

হুযূর (আই.) বলেন, আজও পাকিস্তানে আহমদীয়াতের বিরুদ্ধে মোল্লারা এমনটিই করে বেড়াচ্ছে।

এরপর হুযূর (আই.) আরো কতিপয় ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, অনেকেই আছে নামায নিয়মিত পড়তে চান কিন্তু পেরে উঠেন না, এর কারণ কি? এর কারণ হলো সৎসঙ্গের অভাব। সঙ্গী নির্বাচনে সতর্ক হোন। আর গন্তব্য নির্ধারণ করার পর সঠিক রাস্তা বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন। হুযূর এখানে কাদিয়ান এবং রাবোয়ার আহমদীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তাদেরকে মসজিদ আবাদ করার প্রতি আহ্বান জানান। দুর্বলদের ছেড়ে সবলদের সঙ্গ নিন। জামাতের সাথে যাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় তাদের সাহচর্যে থাকুন ফলে ধীরে ধীরে সক্রিয়শীল লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

হুযূর (আই.) বলেন, কোন লক্ষ্য অর্জন এবং জামাতের সার্বিক উন্নতি আর তরবীয়তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের লাগাতার এবং অনবরত চেষ্টা করা উচিত। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগে একজন ফকীর ছিল যে, মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দ্বারে বসে থাকতো আর যতক্ষণ পর্যন্ত তার প্রার্থিত বস্তু না পেতো সেখান দিয়ে যেতো না। অনুরূপভাবে দুধরনের ভিক্ষুক হয়ে থাকে। এক হচ্ছে তারা যারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে দরজার কড়া নাড়ে আর দু’তিন বার চাওয়ার পর দরজা না খুললে অন্য বাড়ীতে চলে যায় কিন্তু আরেক দল আছে যারা নাছোড়াবান্দা হয়ে কড়া নাড়তে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কিছু না দেয়া হয় তারা সেখানে থেকে নড়ে না।

অতএব আমাদের জামাতে যারা কাজ করেন তাদেরও এরূপ অবিচলতার সাথে চেষ্টা করা উচিত যাতে কিছু না কিছু তাদের হাতে আসে। প্রথম একজনের সংশোধন দিয়ে আরম্ভ করলেও ধীরে ধীরে এর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। কাজেই তোমরা নিজেদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করো আর এর ফলাফলের অপেক্ষা করো। জাগতিক কাজের যখন ফলাফল বের হয় তাহলে আধ্যাত্মিক কাজের ফলাফল বের হবে না তা কি করে হতে পারে। অনেকেই সঠিকভাবে কাজ না করে আল্লাহ্‌কে দোষারোপ করে। আল্লাহ্‌কে দোষারোপ না করে নিজেদের দায়িত্বের প্রতি আরো যত্নবান হওয়া আবশ্যক।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) একজন শহীদের স্মৃতিচারণ করেন। গত ১লা মার্চ শেখুপুরার কোট আব্দুল মালিক নিবাসী মোহতরম কমরুয্ জিয়া সাহেবকে দু’জন আততায়ী ছুরিকাঘাতে শহীদ করে, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি আহমদীয়াতের কারণে বিরোধিতার সম্মুখীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারে তিনি পিতা, স্ত্রী এবং তিনজন সন্তান রেখে গেছেন। আল্লাহ্ তা’লা শহীদকে তাঁর প্রিয়দের চরণে ঠাঁই দিন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সাবরে জামীল দান করুন। আমীন।