‘লাগাভ’ বা বৃথা এবং অলাভজনক কথাবার্তা সম্পর্কে আল্-কুরআনের শিক্ষা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৬-ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “‘লাগাভ’ বা বৃথা এবং অলাভজনক কথাবার্তা সম্পর্কে আল্-কুরআনের শিক্ষা”- সম্পর্কে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, এ পৃথিবীতে মানুষ অনেক কথা বৃথা ও অকারণেই বলে থাকে। অনেকেই এমন আছে যারা হাসি ঠাট্টার ছলে কাউকে কোন কথা বলে বসে এবং এর ফলে ঝগড়া বিবাদের সূত্রপাত হয়। অনেক সময় বৈঠক ইত্যাদিতে এমন সব কথা বলা হয় যা কেবল কথার খাতিরে বলা হয়। অনেক সময় এমন ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সূচক কথাও বলা হয় যার ফলে অন্যের কষ্ট হয় অথবা এমন অলাভজনক বা অহেতুক কথাবার্তা হয় যা কোনভাবেই কারও জন্য কল্যাণকর হয় না। ‘লাগাভ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, বৃথা এবং অলাভজনক কথাবার্তা বলা বা অবিবেচকের মতো কথাবার্তা বলা, অহেতুক ও অর্থহীন আর নির্বোধের মতো কথা বলা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’লা মু’মিনদের এরূপ কর্মকান্ড থেকে বারণ করেছেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এক জায়গায় খোদা তা’লার এই নির্দেশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন, যা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলতেন যে, সূরা ফুরক্বানের ৭৩ নম্বর আয়াতে মু’মিনের পরিচয় সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাহলো, তারা যখন কোন বৃথা কার্যকলাপ দেখে তখন সসম্মানে তা এড়িয়ে যায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মহিলারা সবসময় বৃথা কার্যকলাপের প্রতি আকৃষ্ট থাকে, যদিও আজকাল পুরুষদের অবস্থাও এমনই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ তারা অকারণে অন্যদের জিজ্ঞেস করে বেড়ায়, এই কাপড় কত টাকা দিয়ে ক্রয় করেছ, এই গয়না কোত্থেকে বানিয়েছ ইত্যাদি। এই যে, ছোট ছোট কথা এগুলোও বৃথা কাজ। এই কথাগুলো বস্তুবাদিতার সাথে সম্পর্ক রাখে এবং এর কোন লাভজনক দিক নেই বরং অনেক সময় পাশে যেসব মহিলা বসে থাকে তাদের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। মহিলারা এর ইতিহাস এবং আদ্যপান্ত উদঘাটন না করা পর্যন্ত স্বস্তি পায় না। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলতেন, একজন মহিলা একটি আংটি বানিয়েছিল, কিন্তু কেউ সেই আংটির প্রতি দৃষ্টিপাতই করেনি। সেটি খুবই আকর্ষণীয় একটি স্বর্ণের আংটি ছিল। অবশেষে সে বিরক্ত হয়ে স্বয়ং নিজের ঘরে অগ্নি সংযোগ করে। মানুষ তাকে জিজ্ঞেস করে, আগুন থেকে আদৌ কিছু রক্ষা পেয়েছে কি? তখন সে বলে, এই আংটি ছাড়া আর কোন কিছুই রক্ষা পায়নি। তখন এক মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করে, বোন! এই আংটি তুমি কবে বানিয়েছ, এটি তো খুবই সুন্দর একটি আংটি। সে তখন বলে, তুমি যদি একথা আমাকে পূর্বেই জিজ্ঞেস করতে তাহলে আমার ঘর পুড়তো না।

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, এই বদভ্যাস শুধু মহিলাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, পুরুষদের মধ্যেও এমন বদভ্যাস রয়েছে, অকারণে অনেক সময় অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা আরম্ভ করে। যেমন সালামের পর জিজ্ঞেস করে, কোত্থেকে এসেছ, কোথায় যাবে, কত আয় কর। প্রশ্ন হলো, এমন বিষয়ে অন্যের নাক গলানোর প্রয়োজনই বা কী? এরপর তিনি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জাতির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, ইংরেজদের ক্ষেত্রে কখনও এমনটি দেখবে না যে, তারা পরষ্পরকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কোথায় চাকুরী কর, তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি, বেতন কত পাও ইত্যাদি। এভাবে কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর বিষয়টি তাদের মাথায়ই আসে না।

এরপর হুযূর হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর ভাষায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর কাছ থেকে শোনা বিভিন্ন শিক্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা করেন।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এক জায়গায় বলেন, এমন কাজ সাধিত হওয়া যা না করলে বিশেষ কোন লাভ বা ক্ষতি হয় না তা-ই ‘লাগাভ’ বা বৃথা কাজ।

হুযূর বলেন, পৃথিবীতে প্রয়োজনের গুরুত্বের নিরিখে অনেক ছোট জিনিসও বড় হয়ে যায় আবার অনেক মূল্যবান জিনিসকেও অজ্ঞানতার কারণে মানুষ অবজ্ঞা করে। কোন শিশুকে মূল্যবান একটি হীরা দিয়ে দিলে সে এর কীইবা মূল্য বুঝবে। অতএব একজন মু’মিনকে স্বীয় আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে বা অন্যের প্রতি অনুগ্রহ করে নিজের গুরুত্ব পৃথিবীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করা উচিত। তার দৃষ্টি যেন সীমিত না থাকে, কেবল তার নিকটাত্মীয়রাই যেন তার জন্য না কাঁদে বরং সে যেখানে থাকে, যে সমাজে থাকে সেখানে যেন সে সর্বজন স্বীকৃত হয়। সবারই নিজস্ব একটি কর্মগন্ডি আছে আর সেই গন্ডিতে কোন আহমদীর পরিচিতি বা সুপরিচিতির গন্ডি শুধু তার নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং জামাতের জন্যও তা সুনাম বয়ে আনে আর এভাবে তবলীগের পথও উন্মোচিত হয়। একজন আহমদী যদি নেক প্রভাব বিস্তারকারী হয় তাহলে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে, ইসলামের প্রকৃত অর্থ এবং মর্ম কী, আর পৃথিবীর শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য এ যুগে ইসলামী শিক্ষাই হলো একমাত্র শিক্ষা যা প্রকৃত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। অতএব পৃথিবীবাসীর জ্ঞানের যে অভাব রয়েছে তাদের মাঝে সেই জ্ঞান সৃষ্টির জন্য আমাদের সবার স্ব স্ব গন্ডিতে অবদান রাখার চেষ্টা করা উচিত।

হুযূর বলেন, অনেক এমন মানুষও আছে যারা কোন কুরবানী না করেই মনে করে যে, আমরা কুরবানী করেছি বা অন্যের ওপর অনুগ্রহ করেছি। এমন লোকদের সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একটি ঘটনা বর্ণনা করতেন, একজন কাউকে নিমন্ত্রণ করে এবং সামর্থ অনুসারে তার সেবায় কোন প্রকার ত্রুটি করেনি। অতিথি যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন ঘরের মালিক তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলে, আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিল এবং আরও কিছু সমস্যা ছিল বলে যথাযথভাবে আপনার সেবা করা সম্ভব হয়নি। আশা করি আপনি আমায় ক্ষমা করবেন। একথা শুনে অতিথি বলেন, আমি জানি তুমি কোন উদ্দেশ্যে এই কথা বলছো। তোমার ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্য হলো আমি যেন তোমার প্রশংসা করি এবং তোমার অনুগ্রহের কথা স্বীকার করি। এহলো সেই অতিথির চিন্তাধারা। সে বলে, কিন্তু আমার কাছে এই আশা রেখো না, বরং আমি যে অনুগ্রহ করেছি তা তোমার স্বীকার করা উচিত। অতিথি সেবক বলেন, কোনরূপ অনুগ্রহ পাবার বাসনায় আমি এমনটি বলিনি। আমি সত্যিই লজ্জিত যে, ভালোভাবে আপনার সেবা করা সম্ভব হয়নি। তবে আমার প্রতি আপনার যদি কোন অনুগ্রহ থেকে থাকে তাহলে তাও আপনি বলতে পারেন, আমি এর জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। তখন অতিথি বলে, তুমি যাই বল, তোমার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা আমি জানি আর তোমার হৃদয়ে কি আছে তাও আমার জানা আছে। মেহমান তাকে বলে, আমাকে শুধু খাবারই খাইয়েছ এর বেশি তুমি আর কি করেছ আমার জন্য, বরং তোমার প্রতি আমি অনেক বড় অনুগ্রহ করেছি। তুমি তোমার এই কক্ষের দিকে তাকাও যে কক্ষে আমাকে বসিয়েছ, এতে বেশ কয়েক হাজার রুপির দামী আসবাবপত্র পড়ে আছে। তুমি যখন খাবার আনার জন্য ভেতরে গিয়েছিলে আমি চাইলে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে এসবকিছু জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিতে পারতাম। এখন তুমিই বল, আগুন লাগিয়ে দিলে এক পয়সার জিনিসও কি রক্ষা পেত? কিন্তু আমি এমনটি করিনি। আমার এই অনুগ্রহ কি কোনভাবে খাটো করে দেখার মতো? একথা শুনে ঘরের মালিক বলে, সত্যিই আপনার অনুগ্রহ অনেক বড়, আমি এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, আপনি আমার ঘর জ্বালিয়ে দেননি। কাজেই দেখুন! এমন মানুষও আছে, অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহকে স্বীকার করা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পরিবর্তে মনে করে, আমি এর প্রতি অনুগ্রহ করছি করছি। অতএব একজন মু’মিনের অনুগ্রহকারীর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, এই অতিথির মতো অকৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয়।

এক জায়গায় হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) মুরুব্বী ও মুবাল্লিগদের নসীহত করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বর্ণিত একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলতেন যে, এক বাদশাহ্ ছিল যে কোন পীরের খুবই ভক্ত এবং অনুরক্ত ছিল আর মন্ত্রীকে বলতো, আমার পীরের সাথে সাক্ষাৎ কর। কিন্তু মন্ত্রী যেহেতু তার পীরের স্বরূপ জানতো তাই তাকে এড়িয়ে চলতো। অবশেষে একদিন পীরের কাছে যাওয়ার সময় বাদশাহ্ মন্ত্রীকেও সাথে নিয়ে যায়। পীর সাহেব বাদশাহ্কে সম্বোধন করে বলে, বাদশাহ্ সালামত! ধর্মসেবা বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। আলেকজান্ডার বাদশাহ্ ইসলামের অনেক সেবা করেছেন যার ফলে আজ পর্যন্ত তিনি সুখ্যাতি রাখেন। একথা শুনে মন্ত্রী বলেন, দেখুন হুযূর! পীর সাহেব ওলী হওয়ার পাশাপাশি ইতিহাসেরও অনেক জ্ঞান রাখেন। আলেকজান্ডার তো ইসলামের অনেক পূর্বেই মারা গেছেন অথচ পীর সাহেব তার কথাই বলছেন। অর্থাৎ পীর সাহেব কেবল ওলী-আল্লাহ্ই নন বরং মনে হচ্ছে তিনি অনেক বড় ঐতিহাসিকও কেননা তিনি নতুন ইতিহাস গড়ছেন। এর ফলে বাদশাহ্র হৃদয়ে পীরের বিরুদ্ধে ঘৃণা জন্মে। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এই কাহিনী বর্ণনা করার পর বলতেন যে, বৈঠকে আলোচিত বিষয়ের জ্ঞান যদি না থাকে তাহলে মানুষ অন্যদের দৃষ্টিতে হেয় বা তুচ্ছ প্রমাণিত হয়। একইভাবে সভার নিয়ম কানুন বা আদবেরও জ্ঞান থাকা চাই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ কোন পরামর্শ সভা চলাকালে একজন বড় আলেম যদি সেখানে গিয়ে সবার সামনে শুয়ে পড়ে তাহলে কেউ তার জ্ঞানের ভ্রুক্ষেপ করবে না বরং মানুষের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। তাই সভা যেমনই হোক না কেন একজন মুবাল্লিগ যখন সেই সভায় যাবে তার সেই সভা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তাই প্রত্যেক মুবাল্লিগের ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, চিকিৎসা শাস্ত্র, কথা বলার রীতি-নীতি, বৈঠকের নিয়ম কানুন ইত্যাদির অন্তত পক্ষে ততটা জ্ঞান থাকা আবশ্যক যতটা ভদ্রলোকের বৈঠকে অংশ গ্রহণের জন্য আবশ্যক হয়ে থাকে। আজকাল আমাদের মুরুব্বী ও মুবাল্লিগদের বর্তমান যুগের চলমান সংকট সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। আর অনেক সময় যেহেতু রীতিমত পত্র-পত্রিকা পড়া হয় না তাই সে সম্পর্কে ততটা জ্ঞান থাকে না। তাই চলমান ঘটনাবলীর জ্ঞান রাখা আর যে সভায় যোগদান করেন সে সভা সংক্রান্ত কিছুটা জ্ঞান অবশ্যই অর্জন করে যাওয়া উচিত।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলতেন প্রত্যেক জিনিসেরই উপকারী এবং অপকারী উভয় দিকই রয়েছে। চরিত্রের দিক থেকে বা আচার আচরণের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে উন্নত চরিত্র মুসলমানের হওয়া উচিত কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আজ এরা চরিত্রের দিক থেকে সবচেয়ে হীন এবং সবচেয়ে অধঃপতিত। সত্যের ওপর অবিচল থাকার তো প্রশ্নই উঠে না বরং এরা যার কাছে স্বার্থ দেখে তাদের পানেই চেয়ে থাকে। তা সে কোন নেতা হোক বা কোন সাধারণ মানুষই হোক না কেন। সত্যের ওপর অবিচল থাকার দাবি হলো সঠিক এবং ভ্রান্তকে সামনে রেখে সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরামর্শ দেয়া এবং কোন মতামত ব্যক্ত করা।

এরপর আমি খোদার সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপন সংক্রান্ত আরো একটি ঘটনা বর্ণনা করছি, আল্লাহ্র সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপনই সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে আর এই সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় তাক্বওয়া বা খোদাভীতির মাধ্যমে। আমরা আহমদীরা দাবি করি যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-কে মেনে আমরা সঠিক ইসলামী শিক্ষা অনুসারে জীবন যাপন করব, আমাদের এই জীবনের জন্য সর্বাবস্থায় খোদার পানেই আমাদের চেয়ে থাকা উচিত, খোদাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকা উচিত, তাঁর সাথেই সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। আমাদের সাফল্য কখনও জাগতিক কথাবার্তায় আসতে পারে না। অতএব আমরা যদি নিজেদের হৃদয়ে খোদাভীতি এবং তাক্বওয়া সৃষ্টি করি তবেই আমরা সাফল্য পাব। এমনটি যদি হয় তাহলে ফিরিশ্তারা আমাদের চলার পথকে সুগম করবে, ইনশাআল্লাহ্।

একজন প্রকৃত মু’মিনের পরিচয় কী? হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) প্রকৃত মু’মিনের তুলনা করতেন সত্যিকার বা প্রকৃত বন্ধুর সাথে, তিনি বলতেন, কোন একজন সম্পদশালী মানুষ ছিল, তার ছেলের কিছু ভবঘুরে এবং বাউন্ডুলে বন্ধু ছিল। তার পিতা তাকে বুঝালো, এরা তোমার প্রকৃত বন্ধু নয়, এরা শুধু লোভের বশবর্তী হয়ে তোমার কাছে আসে, নতুবা তাদের মাঝে একজনও এমন নেই যে তোমার প্রতি বিশ্বস্ত কিন্তু সেই ছেলে পিতাকে উত্তর দেয়, মনে হয় যেন আপনি জীবনে কোন সত্যিকার বন্ধু পান নি, তাই সবার সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করেন। আমার বন্ধুরা এমন নয়, তারা পরম বিশ্বস্ত, আমার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও তারা প্রস্তুত। পিতা তাকে বুঝান, সত্যিকার বন্ধু পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। সারা জীবনে আমি একজন মাত্র সত্যিকার বন্ধু পেয়েছি। কিন্তু সেই ছেলে তার হঠকারিতায় ছিল অনড়। কিছু দিন পর সে পিতার কাছে খরচের জন্য কিছু টাকা চায়, পিতা বলে, আমি তোমার খরচ চালাতে পারব না, তোমার বন্ধুদের কাছে চাও, আমার কাছে এখন কিছুই নেই। সত্যিকার অর্থে পিতা ছেলের বন্ধুদের পরীক্ষা নেয়ার কোন সুযোগ খুঁজছিলেন। পিতা যখন না করে দেন আর তার সব বন্ধুরা যখন এটি জানতে পায় যে, ঘর থেকে তাকে না করে দেয়া হয়েছে তখন বন্ধুরা তার কাছে আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়, মেলা-মেশা ছেড়ে দেয়। অবশেষে নিরুপায় হয়ে এই ছেলে নিজেই বন্ধুদের সাথে স্বাক্ষাতের জন্য তাদের কাছে যায়। কিন্তু যেই বন্ধুর দরজায়ই কড়া নাড়তো সে ভেতর থেকে সংবাদ পাঠাতো সে ঘরে নেই, কোথাও বাহিরে গিয়েছে বা সে অসুস্থ এখন দেখা করা সম্ভব নয়। এভাবে সে সারা দিন ঘুরে বেড়ায় কিন্তু কোন বন্ধুই তার সাথে দেখা করার জন্য বাহিরে আসে নি, অবশেষে সন্ধ্যা বেলা বাসায় ফিরে আসে। পিতা তখন জিজ্ঞেস করেন, বন্ধুরা কি উত্তর দিয়েছে। সে বলে, সবাই হারাম খোর, অকৃতজ্ঞ, কেউ কোন বাহানা করেছে, কেউ অন্য কোন অজুহাত দেখিয়েছে। পিতা বলেন, আমি কি তোমাকে পূর্বেই একথা বলিনি, এরা বিশ্বস্ত নয়। ভাল হয়েছে, তোমারও একটা অভিজ্ঞতা হলো, এসো এখন আমার বন্ধুর সাথে তোমার সাক্ষাৎ করাই। এরপর তারা পাশেই এক জায়গায় যায় যেখানে তার একজন বন্ধু বাস করতো। সেই বন্ধু কোন জায়গায় সিপাহী হিসেবে কাজ করত। পিতা-পুত্র উভয়ে তার ঘরে পৌঁছে দরজার কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে যে আমি আসছি। অনেক সময় পার হলেও দরজা খোলার জন্য কেউ আসেনি। তখন ছেলের হৃদয়ে বিভিন্ন চিন্তাধারার উদয় হতে থাকে, সে তার পিতাকে বলে, আব্বু! মনে হয় আপনার বন্ধুও আমার বন্ধুদের মতই। তিনি বলেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। এরপর আরও কিছুটা সময় কেটে যায়। এরপর দরজা খুলে সেই বন্ধু যখন বাহিরে আসে তখন তার গলায় একটি তরবারী ঝুলছিল, এক হাতে ছিল একটি থলি আর অন্য হাতে ছিল স্ত্রীর বাহু। দরজা খুলতেই সে বলে, আমায় ক্ষমা করবেন, আপনার কষ্ট হয়েছে, আমি তাড়াতাড়ি আসতে পারি নি, দ্রুত আসতে না পারার কারণ হলো, আপনি যখন কড়া নেড়েছেন আমি বুঝতে পেরেছি, নিশ্চয় বিশেষ কোন কারণ আছে যে কারণে আপনি স্বয়ং এসেছেন নতুবা আপনি কোন চাকরকেও পাঠাতে পারতেন। আমি যখন দরজা খুলতে চাইলাম তখন হঠাৎ করে আমার মনে পড়লো, হয়তো কোন সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমার কাছে এই তিনটি জিনিসই ছিল, একটি তরবারী আর একটি থলি যাতে আমার এক বছরের খরচের জন্য কয়েকশ’ রুপি আছে, আর আমার স্ত্রী এজন্য এসেছে কারণ আপনার ঘরে হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে তাই সে খিদমতের জন্য এসেছে। আর দেরী হওয়ার কারণ হলো, আমার এই থলিটি মাটির নিচে পুঁতে রাখা ছিল যা বের করতে সময় লেগেছে। এরপর ভাবলাম, হয়তো এমন কোন সমস্যার উদয় হয়েছে যেখানে কোন সাহসী ব্যক্তি কাজে আসতে পারে তাই তরবারী সাথে নিয়ে এসেছি, জীবনের যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমার জীবন যেন উৎসর্গ করতে পারি। তখন সেই সম্পদশালী বন্ধু বলেন, হে আমার বন্ধু! আমার এখন কোন সাহায্যের প্রয়োজন নেই আর আমি এমন কোন সমস্যারও সম্মুখীন নই বরং আমি কেবল আমার ছেলেকে শেখাতে নিয়ে এসেছি। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলতেন, এটিই হলো প্রকৃত বন্ধুত্ব আর এর চেয়েও ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব মানুষের আল্লাহ্র সাথে স্থাপন করা উচিত এবং নিজ প্রাণ, সম্পদ এবং যা কিছু আছে এর সবই উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। এক বন্ধু যেভাবে কখনও মানায় আবার কখনও মানে, অনুরূপভাবে মানুষের জন্য আবশ্যক হলো আন্তরিকতার সাথে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহ্ তা’লার পথে ত্যাগ স্বীকার করতে থাকা। খোদা তা’লা আমাদের কত কথা মানেন। দিবা-রাত্র আমরা তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতরাজি ভোগ করি। তিনি আমাদের আরাম এবং প্রশান্তির জন্য যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সেসব আমরা ব্যবহার করি। কোন্ অধিকার বলে আমরা এগুলোকে উপভোগ করছি বা ভোগ করছি। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের কত বাসনা পূর্ণ করেন। দু’একবার আমাদের বাসনা পরিপন্থী কিছু হলে মানুষ খোদা সম্পর্কে কত ঘৃণ্য কু-ধারণা পোষণ করতে আরম্ভ করে। আসল বিষয় হলো, স্বাচ্ছন্দ্য হোক বা দারিদ্রতা আর সুখ হোক বা দুঃখ সর্বাবস্থায় স্থির এবং অবিচল থাকা উচিত, সে যেন দ্যোদুল্যমান না হয়।

হুযূর বলেন, যারা যথাযথভাবে নামায পড়ে না তাদের আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত। এমন মানুষ যারা ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেয়ার অঙ্গীকার রক্ষা করে না তাদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত। এমন মানুষ যারা আহমদীয়াতের কল্যাণে এখানে এসেছে কিন্তু এখানে এসে ভুলে গেছে যে, আহমদীয়াতের সুবাদেই তারা এখানে থাকার এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, এমন মানুষদের জামাতের খিদমতের জন্য এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু এটি তারা ভুলে যায় এবং আপত্তিও করে অনেক সময়। এমন মানুষ ভালো ইবাদতকারীও নয় এবং বিশ্বস্তও নয়। খোদা তা’লার জন্য সর্বাবস্থায় এবং সর্বদা তাঁর দ্বারে উপস্থিত থেকে কুরবানীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা উচিত। নবীগণ এবং খোদার বান্দাদের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের দাবি রক্ষাকারী যেই ব্যক্তির ঘটনা আমি এই মাত্র শুনিয়েছি তা কীভাবে প্রযোজ্য হয় তাও হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। যেখানে ভালোবাসা থাকে সেখানে যুক্তি প্রমাণ চাওয়া হয় না, সেখানে মানুষ প্রথমে আনুগত্যের ঘোষণা দেয় এরপর চিন্তা করে, এই নির্দেশ আমি কীভাবে পালন করতে পারি।

অতএব আজ আমরা যারা খোদার ভালোবাসায় নিবেদিত এবং খোদার বাণীকে পৃথিবীময় প্রচারের অঙ্গীকার নিয়ে দন্ডায়মান এই ব্যক্তিকে মানার দাবি করি, আজকে আমরা আল্লাহ্ তা’লার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিবেদিত প্রাণ দাসের হাতে যারা বয়আতের দাবি করি, যদি আজকে আমরা মনে করি, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আগমণের মাধ্যমে খোদার প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়েছে এবং মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে আর ইসলাম রেনেঁসার যুগে প্রবেশ করেছে, আর এখন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মাধ্যমে এটি পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছবে, যদি আমরা এই কারণে তাঁর হাতে বয়আতের অঙ্গীকার করি যে, আমরা তাঁর সকল কাজে তাঁর সাহায্যকারী হব, তাহলে আমাদেরকেও সমস্ত শক্তি-সামর্থ দিয়ে, যাই আছে আমাদের মাঝে, তা স্বল্প হোক বা বেশি, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসা উচিত এবং ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা উচিত। আল্লাহ্র প্রতি, তাঁর রসূলের প্রতি এবং তাঁর মসীহ্র প্রতিও। নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে, জীবন-যাত্রায় পবিত্র পরিবর্তন আনয়ন করা উচিত, নিজেদের বিশ্বস্ততার মান উন্নত করা উচিত, আর সেভাবেই সকল ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকা উচিত যেভাবে সেই দরিদ্র বন্ধু তার ধনী বন্ধুর জন্য সব কিছু বিসর্জন দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আল্লাহ্ তা’লা আমাদেরকে এর তৌফিক দান করুন। (আমীন)