আল্লাহ্‌র প্রকৃত বান্দা হওয়া

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১২-ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ১২ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “আল্লাহ্‌র প্রকৃত বান্দা হওয়া”- বিষয়ে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) তাঁর বিভিন্ন খুতবা এবং বক্তৃতায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কর্তৃক বর্ণিত বিভিন্ন শিক্ষামূলক ঘটনা ও গল্প বর্ণনা করেন। বিভিন্ন সময় আমিও তা উদ্ধৃত করি এবং আজও এর কয়েকটি বর্ণনা করবো।

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এক খুতবায় বলেন, ‘আল্লাহ্ তা’লা যখন কাউকে নিজের পক্ষ হতে দন্ডায়মান করেন বা নবীদের প্রেরণ করেন তখন তাদের সাহায্য ও সমর্থন করেন। আর যদি তাঁর সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য জগতের বিশাল জনগোষ্ঠিকেও তাদের অপকর্মের কারণে শাস্তি দিয়ে হয় তবে ভ্রুক্ষেপহীনভাবে তাদের শাস্তি প্রদান করেন।’

এ প্রসঙ্গে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদের যে শিক্ষণীয় গল্পটি শোনান তাহলো, হযরত নূহ (আ.)-এর যুগে প্লাবন আসার কারণ হলো সে যুগে মানুষ অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল আর পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তাদের পাপাচার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খোদার দৃষ্টিতে তাদের মূল্য কমে যাচ্ছিল অবশেষে একদিন পাহাড়ের চূড়ায় একটি গাছের ওপর পাখির বাসায় একটি চড়ুই ছানা বসেছিল। সেই ছানার মা কোথায় গিয়েছিল কিন্তু কোন কারণে আর ফিরে আসেনি। এমন সময় সেই চড়ুই ছানার পানির তেষ্টা পায় আর সে পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ে তখন তা দেখে খোদা তা’লা স্বীয় ফিরিশ্তাদের নির্দেশ দেন, যাও পৃথিবীতে পানি বর্ষণ করো আর এতটা বারী বর্ষণ করো যাতে পানি সেই পাহাড় চূড়ার পাখির বাসা পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং সেই চড়ুই ছানা পানি পান করতে পারে। ফিরিশ্তারা বলে, হে খোদা! ঐ পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে গেলে পুরো জগত পানির তুলে ডুবে যাবে। আল্লাহ্ বলেন, ডুবে গেলে যাক আমি তাদের কোন পরওয়া করি না। এখন আমার কাছে জগতের মানুষের এতটুকু মূল্যও নেই যতটা সেই চড়ুই ছানার রয়েছে।

হুযূর বলেন, এটি গল্প হলেও এতে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, সততা ও সাধুতা বিবর্জিত এক জগত মানুষও খোদার দৃষ্টিতে পাখির ছানার মতো মূল্য রাখে না।

এই গল্প থেকে আজ আমাদের যে শিক্ষাটি গ্রহণ করা উচিত তা হলো, যেকোন মূলে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। আত্মজিজ্ঞাসা করা উচিত। জানা আবশ্যক যে, আমরা আমাদের দায়িত্ব ও লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেলে খোদাও আমাদের পরওয়া করবেন না।

আজ পৃথিবীর সর্বত্র নৈরাজ্য আর হানাহানি বিরাজমান। কেউ কারো অধিকার দিতে প্রস্তুত নয়। নিজের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হলেও অন্যের বিষয়ে ভ্রুক্ষেপহীন। মানব প্রকৃতি বিরোধী আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্র তা জনগণকে মানতে বাধ্য করছে। এরফলে পৃথিবীর সকল প্রান্তে অশান্তির আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলছে। বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুযোর্গ দেখা দিচ্ছে আর হাজার হাজার মানুষ এর প্রকোপে প্রাণ হারাচ্ছে। এগুলো সবই সতর্কবাণী। যদি মানুষ এখনও সাবধান না হয় তাহলে পৃথিবীতে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসবে। এক্ষেত্রে আহমদীদের দায়িত্ব রয়েছে। মানুষকে বোঝানো, যদি কান্ডজ্ঞান না খাটাও তাহলে খোদার কঠোর আযাব আসবে।

হুযূর বলেন, জাপানে কেউ আমাকে শান্তির সংজ্ঞা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। আমি বলেছিলাম, ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, তোমরা নিজের জন্য যা পছন্দ করো তোমার ভাইয়ের জন্যও তাই পছন্দ কোরো। ইসলামের এই অনিন্দ্য সুন্দর শিক্ষার ফলে সমাজে পরষ্পরের অধিকার সুনিশ্চিত হবে আর জগত শান্তিধামে পরিণত হবে। আমার এই উত্তরে সে খুবই সন্তোষ প্রকাশ করেছিল এবং এটি তার কাছে যথার্থ সংজ্ঞা মনে হয়েছিল।

মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে কত উন্নত আদর্শ আমরা দেখতে পাই। কোন একজন সাহাবী ঘোড়ার বিক্রয়মূল্য ২০০টাকা চাইলে ক্রেতা সাহাবী বলেন, আপনি বাজার দর জানেন না তাই কম মূল্য চাইছেন। আমি এর চেয়ে বেশি মূল্য দিতে চাই। বিক্রেতা বলেন, আমি এর চেয়ে বেশি মূল্য নিতে পারবো না। বিচারকের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত এর নিষ্পত্তি হয়। তাঁদের এমনটি করার কারণ হলো, পরষ্পরের অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা। মানুষ যখন সত্যিকারেই খোদার বান্দা হয়ে যায় তখন সে বলে, আমার নিজের বলতে কিছুই নেই সবই আল্লাহ্‌র। এমন চিন্তা-ধারণার জন্ম হলেই মানুষ আমিত্বের দাসত্ব হতে মুক্তি পেতে পারে। আর সত্যিকার খোদার বান্দার যোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয়।

যে কোন মূল্যে আমাদেরকে আল্লাহ্র সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাহলে খোদার ফিরিশ্তার সাথে আমাদের সখ্যতা হবে আর আমরা তাদের সাহায্যে আমরা মানুষের মন-মস্তিষ্কে সহজেই জায়গা করে নিতে সক্ষম হবো।

সাহাবীদের আদর্শ কি ছিল দেখুন? ইমাম হাসান কোন অপরাধ না করেও কেন ইমাম হোসেন এর কাছে ক্ষমা চাইতে যান। কারণ হাদীসে এসেছে, ঝগড়ার পর যে তার ভাইয়ের কাছে প্রথমে সন্ধির হাত বাড়ায় সে অপরের তুলনায় ৫০০ বছর আগে জান্নাতে যাবে।

হুযূর বলেন, আমাদের জামাতের বিচার বিভাগও যদি এ বিষয়ে সচেতন হয় এবং পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে তাহলে ঝগড়া-বিবাদের সংখ্যা কমে আসবে অনায়াসে। এ ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বশীলদের নবীর আদর্শ অনুসরণ করা প্রয়োজন।

এরপর হুযূর ত্বাকওয়া অবলম্বনের আবশ্যতা বর্ণনা করেন এবং দৃঢ় সংকল্প, উদ্যম এবং সকল প্রকার শক্তি-সামর্থ নিয়োজিত করে পুণ্যকর্মে ব্রত হওয়ার জন্য জামাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি নামাযের দৃষ্টান্ত দেন, অনেকেই বলেন, আমরা নিয়মিত নামায পড়তে চাইলেও কার্যতঃ পেরে উঠি না। হুযূর বলেন, শুধু মুখে মুখে ইচ্ছার কথা বললেই কাজ হবে না বরং ইচ্ছার পাশপাশি পুরো আন্তরিকতা ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা থাকা চাই তবেই আল্লাহ্‌র সাহায্য আসে। এটি হতেই পারে না যে, একজন দৃঢ় সংকল্প করে কাজ আরম্ভ করবে আর আল্লাহ্ তাকে সফলতা দিবেন না। আসল কথা হলো, কথার সাথে কাজের সমন্বয় থাকতে হবে নতুবা যারা খোদার দ্বার পরিত্যাগ করে তাদের জন্য পৃথিবীর অন্য কোন দ্বারই আর খোলা থাকে না।

খুতবার শেষ দিকে হুযূর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আহমদীয়াতের বিরোধিতার উল্লেখ করে বলেন, খোদার প্রতিশ্রুতি অনুসারে আহমদীয়াতের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু আমাদেরকে খোদার দরবারে আহাজারি করতে হবে। এখন সদকা ও নফল রোযা রাখার সময়। সপ্তাহে একটি করে হলেও কমপক্ষে ৪০ সপ্তাহ নফল রোযা রাখার চেষ্টা করুন আর সাধ্যমতো সদকাও করুন। আর নামাযে এত বিগলিত চিত্তে দোয়া ও আহাজারি করুন যেন খোদার আরশ কেঁপে উঠে। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে এর তৌফিক দিন।