দোয়ার কার্যকারীতা এবং এর গুরুত্ব

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২৯-জানুয়ারি, ২০১৬

বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

নিখিল বিশ্ব আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বর্তমান ইমাম হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.) গত ২৯শে জানুয়ারী, ২০১৬ইং রোজ শুক্রবার লন্ডনের বাইতুল ফুতুহ্ মসজিদে “দোয়ার কার্যকারীতা এবং এর গুরুত্ব”- বিষয়ে জুমুআর খুতবা প্রদান করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এক জায়গায় বলেন, “আল্লাহ্ তা’লা গোপন এক সত্তা কিন্তু তাঁকে চেনা যায় তাঁর পবিত্র শক্তির মাধ্যমে, দোয়ার মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কেউ রাজা বা রাজাধিরাজ হলেও কোন না কোন সময় অবশ্যই এমন সমস্যার সম্মুখীন হয় যখন সে সম্পূর্ণরূপে অসহায় হয়ে যায়। তখন সে জানে না বা বুঝে উঠতে পারে না যে, এখন কি করা উচিত। তখন একমাত্র দোয়ার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব।”

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বিভিন্ন স্থানে দোয়ার কার্যকারীতা এবং এর গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। তাঁর সাহচর্যের ফলে তাঁর সাহাবীগণও এ বিষয়ে এমন অভিজ্ঞতা ও বুৎপত্তি অর্জন করেছেন যে, সমসাময়িক বিধর্মীরা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যেতে ভয় পেতো। এখানে হুযূর হযরত মুন্সী অরোঢ়া খান সাহেবের একটি ঈমান উদ্দীপক ঘটনা বর্ণনা করেন। মুন্সী সাহেব প্রথম দিকে ঘন-ঘন কাদিয়ান যেতেন। পরে যেহেতু তার ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল তাই তিনি খুব একটা ছুটি-ছাটা পেতেন না। তারপরও সময় পেলেই কাদিয়ান আসতেন। মুন্সী সাহেব সেশন জজের অফিসে কাজ করতেন, একবার তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেন, আমি কাদিয়ান যেতে চাই আমাকে ছুটি দিন কিন্তু তিনি ছুটি দিতে অস্বীকার করে। তখন তিনি বলেন, কাদিয়ান আমি অবশ্যই যাব। আমাকে ছুটি দিন আপনি। ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, অনেক কাজ আছে এখন আপনাকে ছুটি দেয়া সম্ভব নয়। মুন্সী সাহেব বলেন, ঠিক আছে আপনি কাজ করান, আপনার কাজ হোক, আমাকে ছুটি দেবেন না তাই তো। কিন্তু আজ থেকে আমি অভিশাপ দেয়া আরম্ভ করবো, আপনি যে কাজের অজুহাত দেখাচ্ছেন আপনার সেই কাজ যেন কখনও সমাধা না হয়। এরপরও আপনি যদি যেতে দিতে না চান না দিন। অবশেষে সেই ম্যাজিস্ট্রেটের এমন মারাত্তক কোন ক্ষতি হয় যে, সে এতে ভয় পেয়ে যায়, এরপর সেই ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর মুন্সী সাহেবের যে প্রভাব পড়ে তাহলো, শনিবার এলেই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আদালতের কর্মচারীদের বলতো, আজকে তাড়াতাড়ি কাজ গুটিয়ে নিও নতুবা মুন্সী আরোঢ়া খান সাহেবের কাদিয়ান যাওয়ার গাড়ির সময় পেরিয়ে যাবে। তার দোয়ায় ফলে তিনি ভীত ত্রস্ত ছিলেন যে, এরপর মুন্সী সাহেবন কাদিয়ান যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেই ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ছুটি দিয়ে দিতেন। কাজেই এমন লোকেরাই নিজেদের পুণ্য এবং দোয়ার মাধমে অন্যদেরকেও প্রভাবিত করে রেখেছিলেন আর আজও আমাদের এসব বিষয়ই দৃষ্টিতে রাখা উচিত আর উত্তরোত্তর আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা উচিত।

এরপর হুযূর হযরত মুসলেহ্ মওউদ (আ.)-এর বরাতে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জীবনের বিভিন্ন অনুপম দিক তুলে ধরেন। সব মানুষের শক্তি-সামর্থ বা অনুভূতি শক্তি বা ইন্দ্রীয় শক্তি সমান প্রখর হয় না। শহরের মানুষ আর গ্রামের কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত লোকদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। শুধু পার্থিব দিক দিয়েই যে পার্থক্য বিদমান তা কিন্তু নয় আধ্যাত্মিক জগতেও এ বিষয়টি পরিদৃষ্ট হয়। যেমন কারও ওপর নামাযের প্রভাব বেশি পড়ে কারও ওপর কম। অনেকে এমন আছে যারা কেবল নামায পড়ে বা মুরগির খাবার খাওয়ার মতো নামায পড়ে, সিজদা দিয়েই চলে যায়। আধ্যাত্মিক অনুভূতি যে রয়েছে এর প্রমাণ হিসেবে তাদের স্বাক্ষ্যই গৃহীত হবে যাদের মাঝে এই অনুভূতি প্রখর। যারা নিষ্ঠার সাথে ইবাদত করে এবং ইবাদতের প্রভাবও তাদের ওপর পড়ে।

হুযূর বলেন, কাজেই আমাদের জামাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর এমনই হওয়া উচিত যাদের অনুভূতি শক্তি প্রখর হবে, তারা আধ্যাত্মিক প্রভাব বেশি গ্রহণ করবে এরপর পৃথিবী বাসীকে অবহিত করবে, প্রকৃত নামায কী আর সত্যিকারের ইবাদত কাকে বলে।

এরপর হুযূর বিভিন্ন মানুষের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগে আমেরিকায় সর্বপ্রথম এক ইংরেজ বা একজন আমেরিকান ইসলাম গ্রহণ করেন। তার নাম ছিল আলেকজান্ডার রাসেল। প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মুসলমান ছিলেন। আর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাথে তার নিষ্ঠাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, এখনও আমি দেখি, জামাতের উন্নতি ইউরোপিয়ান দেশগুলোর তুলনায় আমেরিকায় বেশি হচ্ছে। কোন কোন ইউরোপীয়ান দেশেও আহমদীয়াতের বিস্তার ঘটছে। আর ইউরোপও পাশ্চাত্যের অন্তর্গত। কিন্তু আমেরিকায় উন্নতির ছাপ বা লক্ষণাবলি বেশি দেখা যায়।

হুযূর বলেন, আল্লাহ্ করুন আমেরিকার জামাত যেন এমন পুণ্য স্বভাবী লোকদের সন্ধান করে এবং হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পতাকাতলে সমবেত করার চেষ্টা করে।

এরপর সন্তানদের সাথে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সম্পর্ক কেমন ছিল, তাদের তরবীয়তের ব্যাপারে তিনি কতটা সচেতন ছিলেন সে সম্পর্কে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, সঠিক তরবীয়ত বা শিক্ষার রীতি সেটি যা খেলাধূলার মাধ্যমে তারা শিখে থাকে। অর্থাৎ প্রথমে বয়স যখন একেবারেই কম তখন গল্প শোনানোর মাধ্যমে তরবীয়ত করতে হয়। বড় মানুষ বা বয়স্কদের জন্য শুধু ওয়াজ নসীহতই যথেষ্ট হয়ে থাকে কিন্তু শৈশবে আগ্রহ ধরে রাখার জন্য বাচ্চাদের গল্প-কাহিনী শুনাতে হয়। কাহিনী মিথ্যা হওয়া উচিত নয়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) আমাদেরকে কাহিনী শুনাতেন। কখনও হযরত ইউসুফের কাহিনী বর্ণনা করতেন, কখনও হযরত নূহের গল্প শোনাতেন আর কোন সময় হযরত মূসার ঘটনা বর্ণনা করতেন কিন্তু আমাদের জন্য সেগুলো কাহিনীই হতো। যদিও সেগুলো ছিল সত্য ঘটনা। হাসেদ বা মাসুদের একটি ঘটনা আলিফ লায়লাতে অন্তর্ভুক্ত আছে, তাও তিনি শোনাতেন। অনুরূপভাবে আমরা অনেক কিংবদন্তীর কাহিনী তাঁর কাছে শুনেছি। তাই শৈশবে শিক্ষার উত্তম উপায় হলো, গল্প শোনানো যদিও কোন কোন গল্প অর্থহীন এবং বাজে হয়ে থাকে কিন্তু কল্যাণকর এবং চারিত্রিক শক্তিকে দৃঢ়কারী এবং শিক্ষণীয় দিকও এসব কাহিনীতে প্রচ্ছন্ন থাকে। এরপর কিছুটা বড় হলে শিক্ষা এবং তরবীয়তের উৎকৃষ্ট উপায় হলো খেলাধূলা।

অতএব পিতাদের উচিত সন্তানদের সময় দেয়া। পিতামাতা উভয়ে সম্মিলিতভাবে যদি সন্তান সন্ততির তরবীয়তের ওপর জোর দেয় আর তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখে তাহলে তরবীয়তের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা।

এভাবে হুযূর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর তরবীয়ত সংক্রান্ত আরো বিভিন্ন গঠনমূলক ঘটনা বর্ণনা করেন। খুতবার শেষ দিকে মহানবী (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়ার প্রতি হুযূর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাহলো, “সুবহানাল্লাহি ওয়াবেহামদিহী, সুবহানাল্লাহীল আযীম।”

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, নিয়মিত আমার এই দোয়ার পড়ার অভ্যাস রয়েছে আর আমি দেখেছি অনেক সময় একবারই এই শব্দগুলো উচ্চারণ করলে আমার আত্মা ঊর্ধ্বোলোকে উড্ডীন হয়। আসল কথা হল, আল্লাহ্ তা’লার পবিত্র মর্যাদার সম্পর্কে বা আল্লাহ্ তা’লার আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে আমাদের আন্তরিকতার সাথে চিন্তা এবং প্রণিধান করা উচিত এবং সেগুলোকে কর্মে রূপায়িত করার চেষ্টা করা উচিত। আর এটিই পরম সত্য কথা যে, অনেক সময় হৃদয়ের গভীর থেকে যখন আল্লাহ্ তা’লার তাসবীহ্ পাঠ করা হয় আল্লাহ্র প্রশংসার গান গাওয়া হয় তখন মনে হয় যেন এর সুগভীর প্রভাব পড়ছে আমাদের অন্তরাত্মায়, আর এটি অনুভূতও হয়।

আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন, আমরা যেন এমনভাবে তাসবীহ্ এবং তাহমীদ করি অর্থাৎ যেন এমনভাবে খোদার পবিত্রতার গান গাইতে পারি এবং এমনভাবে খোদার প্রশংসার গান গাইতে পারি যা আমাদের আত্মায় আধ্যাত্মিক আকাশে উড্ডয়নের শক্তি জোগাবে এবং আমরা যেন এর ফলে খোদার নৈকট্য লাভ করতে পারি।