শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৬-সেপ্টেম্বর, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ টিলফোর্ডস্থ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত উবাদা বিন সামেত আনসারী (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, গত খুতবায় আমি উবাদা বিন সামেত (রা.)’র স্মৃতিচারণ করছিলাম, তার ব্যাপারে আরও যেসব ঘটনা ও বর্ণনা রয়েছে তা আজ বর্ণনা করছি। ইতিহাসে রয়েছে, আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সলুলের কথায় তার মিত্র ইহুদী গোত্র ‘বনু কায়নুকা’ যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, এর পূর্বে উবাদা বিন সামেতও ‘বনু কায়নুকা’র মিত্র ছিলেন; কিন্তু যখন তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল (সা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন তিনি তাদের সাথে মিত্রতা পরিত্যাগ করেন এবং কুরআন শরীফের সূরা মায়েদার ৫২নং আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতে আল্লাহ্ তা’লা যে নির্দেশ প্রদান করেছেন তা পালন করেন।

হুযূর (আই.) এই প্রসঙ্গে এ বিষয়টিও স্পষ্ট করেন যে, সর্বাবস্থায় বিধর্মীদের প্রতি এমন মনোভাব পোষণের নির্দেশ আল্লাহ্ তা’লা প্রদান করেন নি, বরং পবিত্র কুরআনে বিধর্মীদের প্রতিও সদ্ব্যবহার করার ও তাদের সাথে সদাচারণ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সূরা মায়েদার নির্দেশটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অর্থাৎ যখন ইহুদী বা খ্রিস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ শত্রুতা ও যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখনকার জন্য প্রদান করা হয়েছে। মোদ্দাকথা, নিজেদের দুর্বলতা বা ভীরুতার কারণে অমুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বারণ করা হয়েছে এবং আল্লাহ্‌র ওপর পূর্ণ ভরসা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, বর্তমান যুগে কতিপয় মুসলমান রাষ্ট্র এই নির্দেশ পরিপন্থী আচরণ করছে। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা মুসলমান রাষ্ট্রগুলোকে সুবুদ্ধি দিন। (আমীন)

হুযূর ‘সীরাত খাতামান্নাবীঈন’ পুস্তকের বরাতে উপরোক্ত যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের বিশাল বাহিনীর যখন শোচনীয় পরাজয় ঘটে, তখন মদীনার ইহুদীদের হিংসার সুপ্ত আগুন প্রজ্জলিত হয় এবং তারা প্রকাশ্যেই মুসলমানদের সাথে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হতে আরম্ভ করে। এমনকি তারা মহানবী (সা.)-কেও এক উপলক্ষ্যে প্রকাশ্যে বলে বসে, ‘মক্কার কিছু কুরাইশের ওপর বিজয় লাভ করে তুমি অহংকারী হয়ে গিয়েছ, যদি আমাদের সাথে তোমার যুদ্ধ হয় তাহলে বুঝবে- যুদ্ধ কাকে বলে!’ এই ইহুদীরা অত্যন্ত জঘন্য কূটচালের মাধ্যমে মুসলমানদের অপমান ও ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় একদিন এক ইহুদীর দোকানে কোন মুসলমান ভদ্রমহিলা গেলে তারা তাকে সেখানে চরমভাবে অসম্মান করে। সেই মুসলিম নারীর আর্তচিৎকারে পার্শ্ববর্তি কয়েকজন মুসলমান ছুটে আসেন এবং তাদের মধ্যে বিবাদ আরম্ভ হয় আর এতে দুষ্কৃতকারী ইহুদী দোকানদার নিহত হয়। তখন দোকানে থাকা বাকি ইহুদী ষড়যন্ত্রীরা অন্যান্য মুসলমানদের শহীদ করে। এই ঘটনা জানাজানি হলে মুসলমানদের জাতীয় আত্মাভিমান জেগে ওঠে এবং ইহুদীরাও, যারা যুদ্ধ বাধানোর পাঁয়তারা করছিল, এই সুযোগে যুদ্ধের জন্য একাট্টা হয়। মহানবী (সা.) যখন এসব জানতে পারেন তখন ‘বনু কায়নুকা’র নেতাদের ডেকে এসব দুষ্টামি পরিহার করতে উপদেশ দেন। তারা ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে উল্টো দাম্ভিকতায় ভরা সেই পুরনো হুমকির পুনরাবৃত্তি করে যে, ‘বদরের যুদ্ধ জয়ের অহংকার করো না, আমাদের সাথে যুদ্ধ হলে বুঝবে কত ধানে কত চাল!’ মহানবী (সা.) তাই বাধ্য হয়েই সাহাবীদের একটি দল সাথে নিয়ে তাদের দুর্গগুলোর অভিমুখে রওয়ানা হন। কিন্তু অনুশোচনা প্রকাশের এই শেষ সুযোগটিও তারা হাতছাড়া করে এবং দুর্গের দরজা বন্ধ করে দিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যাহোক, ১৫ দিন পর্যন্ত মুসলমানরা তাদের দুর্গ অবরোধ করে রাখেন, অবশেষে তারা রণে ভঙ্গ দেয় ও পরাজয় স্বীকার করে নেয়। তখন মহানবী (সা.) তাদেরকে দেশান্তরের শাস্তি প্রদান করেন। যদিও তাঁর (সা.) হাতে তওরাতের শিক্ষানুসারে তাদের সবাইকে হত্যা করার সুযোগ ছিল, কিন্তু তিনি (সা.) দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং কৃপা প্রদর্শনপূর্বক তাদেরকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। মহানবী (সা.) তাদের দেশান্তর করার দায়িত্ব হযরত উবাদা বিন সামেতের ওপর অর্পণ করেন, আর তাদেরকে তিনদিন সময় বেঁধে দেয়া হয়। ইহুদীরা হযরত উবাদার কাছে আরও কিছুদিন সময় দেয়ার জন্য অনুরোধ করে, কিন্তু তিনি (রা.) এক মিনিটও অবকাশ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাই তারা শেষ পর্যন্ত মদীনা ছেড়ে সিরিয়ার অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়।

হযরত উবাদা বিন সামেত (রা.) বর্ণনা করেন, একবার মহানবী (সা.) তাকে একজন ব্যক্তিকে কুরআন ও ইসলাম শিখানোর দায়িত্ব প্রদান করেন। সেই ব্যক্তি যাবার সময় তাকে একটি ধনুক উপহার দেন যা খুবই ভালো কাঠের ও উন্নত মানের ছিল। যেহেতু এটি সরাসরি কোন সম্পদ বা অর্থ ছিল না, তাই হযরত উবাদা তা গ্রহণ করেন এবং এটি দিয়ে আল্লাহ্‌র রাস্তায় যুদ্ধ করার সংকল্প করেন। কিন্তু যখন তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন, তখন মহানবী (সা.) বলেন, এটা তোমার দু’কাঁধের মাঝে থাকা এক জ্বলন্ত অঙ্গার। অর্থাৎ এটি প্রকারান্তরে কুরআন শিখানোর পারিশ্রমিক, তাই এটি অত্যন্ত ভয়ংকর। হুযূর বলেন, যারা ব্যক্তিগতভাবে কুরআন পড়ানোকে আয়ের মাধ্যম বানায়, তাদের জন্য এই হাদীসে দিকনির্দেশনা রয়েছে। মহানবীর শিক্ষানুসারে কুরআন শেখানোর কোন বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ নয়।

হুযূর বলেন, আমীর মুয়াবিয়ার সাথে হযরত উবাদা বিন সামেতের কোন কোন বিষয়ে মতানৈক্যের বিষয়টি গত খুতবাতেও বর্ণিত হয়েছে। এমন মতানৈক্যের পর হযরত উবাদা মদীনায় চলে এলে হযরত উমর (রা.) তাকে পুনরায় সিরিয়া ফেরত পাঠান এবং মুয়াবিয়াকে জানিয়ে দেন যে উবাদার কথা মানতে হবে। হযরত উসমান (রা.)-এর খিলাফতকালে মুয়াবিয়া তাকে পত্র লিখে জানান যে উবাদা বিন সামেতের কারণে সিরিয়াবাসী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। তখন হযরত উসমান (রা.) তাকে মদীনায় পাঠিয়ে দিতে বলেন। মদীনায় হযরত উসমানের সাথে হযরত উবাদার এ বিষয়ে আলাপ হলে হযরত উবাদা মহানবী (সা.)-এর হাদীস উদ্ধৃত করেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশ অমান্য করার নির্দেশ দেয়, তার আনুগত্য করা যাবে না। হুযূর (আই.) বলেন, মূলতঃ আমীর মুয়াবিয়া ও তার মধ্যে কোন কোন বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল, নতুবা তারা উভয়েই মহানবী (সা.)-এর সাহাবী ছিলেন। হুযূর আরো বলেন, সর্বাবস্থায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আনুগত্য আবশ্যক। তিনি সঠিক নির্দেশনা দিচ্ছেন কি-না এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সবার নয়।

প্রসঙ্গক্রমে হুযূর হযরত উবাদা বিন সামেতের পুণ্যবতী স্ত্রী হযরত উম্মে হারাম বিনতে মিলহানেরও কিছুটা স্মৃতিচারণ করেন, যিনি মহানবী (সা.)-এর দূর-সম্পর্কীয় খালা ছিলেন। মহানবী (সা.)-এর দেয়া সুসংবাদ অনুযায়ী তিনি ২৭ বা ২৮ হিজরিতে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন। হযরত উবাদা বিন সামেত বর্ণনা করেন, আমি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে একথা বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ উপাসনার যোগ্য নয় এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ্‌র রসূল, আল্লাহ্ তা’লা তার জন্য আগুন হারাম করে দিয়েছেন’। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা এই সাহাবীদের পদমর্যাদা উত্তরোত্তর উন্নীত করতে থাকুন, যাদের মাধ্যমে আমরা এমন কিছু কথাও জানতে পেরেছি, যা আমাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবহারিক জীবনের করণীয় নির্ধারণের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

খুতবার শেষদিকে হুযূর তিনটি গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন। প্রথম জানাযা সিরিয়ার শ্রদ্ধেয় সাঈদ সুকিয়া সাহেবের, যিনি গত ১৮ই এপ্রিল ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুযূর বলেন, তার মৃত্যুর সংবাদ অনেক বিলম্বে পাওয়া গিয়েছে, তাই এতদিন পর তার উল্লেখ করা হচ্ছে। মরহুম সিরিয়ার পুরনো ও নিষ্ঠাবান আহমদীদের একজন, তার তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্য থেকে বড় ছেলে মুহাম্মদ সাহেব ও ছোট ছেলে জালাল উদ্দীন সাহেব আহমদী, বাকিরা অ-আহমদী।

দ্বিতীয় জানাযাটি হচ্ছে তিউনিসিয়ার শ্রদ্ধেয় আত-তাইয়্যেব আল-উবায়দী সাহেবের, যিনি গত ২৬শে জুন ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি তার এলাকার একমাত্র আহমদী ছিলেন এবং আহমদীয়াতের কারণে তাকে নিজ পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু তিনি কোন চাপ বা অত্যাচারের মুখেই নতী স্বীকার করেন নি।

তৃতীয় জানাযা হল, শ্রদ্ধেয়া আমাতুশ্ শাকুর সাহেবার, যিনি হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.)’র সবচেয়ে বড় মেয়ে ছিলেন, গত ৩রা সেপ্টেম্বর ৭৯ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি বিভিন্নভাবে জামাতের সেবা করেছেন এবং জামাতের সাহিত্যেও তার অনন্য অবদান রয়েছে। হুযূর প্রত্যেকেরই সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের মর্যাদা উন্নীত হওয়ার জন্য দোয়া করেন। প্রথমোক্ত দু’জনের সকল সন্তান ও পরিবার-পরিজনের হিদায়েত লাভের জন্যও হুযূর দোয়া করেন। আল্লাহ্ তা’লা মরহুমদের শোকসন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্যের সাথে এই শোক সহ্য করার এবং খিলাফত ও আহমদীয়াতের সাথে বিশ্বস্ততাপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার তৌফিক দান করুন (আমীন)