মসজিদে মুবারক-এর শুভ উদ্ভোধন

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৭-মে, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৭মে, ২০১৯ টিলফোর্ডস্থ ইসলামাবাদের মসজিদে মুবারকে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় মসজিদ মোবারকের উদ্বোধন করেন এবং মসজিদের নির্মানের পটভূমি তুলে ধরেন।

হুযূর (আই.) মসজিদের ফলক উন্মোচন করেন এবং মসজিদে প্রবেশের পর মূল খুতবা শুরুর আগে সকলকে নিয়ে সিজদায়ে শুকুর বা কৃতজ্ঞতামূলক সিজদা আদায় করেন, যেমনটি হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) রাবওয়ার মসজিদে মোবারকের উদ্বোধনকালে করেছিলেন।

জুমুআর খুতবায় হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর সূরা আরাফের ৩০ থেকে ৩২ নং আয়াত তিলাওয়াত করেন, যার অনুবাদ হল- ‘তুমি বল, আমার প্রভু আমাকে ন্যায়পরায়ণতার আদেশ দিয়েছেন। আর (এ আদেশও দিয়েছেন যে) তোমরা প্রত্যেক মসজিদে (উপস্থিতির সময়) নিজেদের মনোযোগ (আল্লাহ্র দিকে) নিবদ্ধ কর; আর আল্লাহ্র ইবাদতকে কেবলমাত্র তাঁরই অধিকার জ্ঞান করে তাঁকেই ডাক। তিনি যেভাবে তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন, একদিন তোমরা সেই অবস্থাতেই ফিরে যাবে। একদলকে তিনি হেদায়াত দান করেছেন; কিন্তু আরও একটি দল রয়েছে, যাদের জন্য পথভ্রষ্টতা অবধারিত হয়ে গিয়েছে। তারা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে শয়তানদের নিজেদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে, আর তারা নিজেদের হেদায়াতপ্রাপ্ত মনে করে। হে আদমসন্তানগণ! প্রত্যেক মসজিদে (যাওয়ার সময়) সৌন্দর্য অবলম্বন করো। আর তোমরা আহার কর ও পান কর, তবে বাড়াবাড়ি করো না; কেননা তিনি (আল্লাহ্) সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’

এরপর হুযূর বলেন, আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ্ তা’লা আজ আমাদেরকে ইসলামাবাদের এই মসজিদে জুমুআ পড়ার তৌফিক দান করছেন। কয়েক জুমুআ পূর্বেই আমি জামাতের কেন্দ্র ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ার কথা বলেছিলাম। যেখানে খলীফায়ে ওয়াক্তের বাসস্থান সেখানে একটি মসজিদ থাকাও জরুরি, যেন খলীফার ইমামতিতে সবাই স্বচ্ছন্দে নামায আদায় করতে পারে এবং তরবিয়ত ইত্যাদি বিভিন্ন কাজও স্বচ্ছন্দে করা যায়। হুযূর বলেন, যদিও আজ জুমুআর মাধ্যমে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই মসজিদের উদ্বোধন করছি, কিন্তু কার্যত এটি আমার আসার পর থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে; পাঁচবেলার নামাযসহ খোদ্দাম-আতফাল-লাজনাদের প্রতিনিধি দলের সাথে মিটিং ইত্যাদি হয়েছে। যদিও এই মসজিদটি ফযল মসজিদের তুলনায় প্রায় চারগুণ বড়; কিন্তু যারা এখানে নিয়মিত আসছেন তারা জানেন যে এটিও প্রয়োজনের তুলনায় ছোট মনে হচ্ছে। তবে একটি পশ্চিমমুখী বড় হলরুম রয়েছে, সেটিও কিছুটা চাহিদা পূরণ করছে। হুযূর বলেন, এই যাবতীয় কথা বলার উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় যুক্তরাজ্যে ও পৃথিবীজুড়ে মসজিদ নির্মাণের দিকে জামাতের বিশেষ মনোযোগ রয়েছে ও মসজিদ নির্মিত হচ্ছে; কিন্তু এই মসজিদটি খলীফায়ে ওয়াক্তের বাসস্থান ও বিভিন্ন কর্মী ও প্রয়োজনীয় সব দপ্তরাদির অবস্থানের কারণে এখন কেন্দ্রীয় মসজিদ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা; আল্লাহ্ করুন- এই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি যেন কাদিয়ানের মসজিদে মোবারকের প্রতিবিম্ব হয় এবং আল্লাহ্ তা’লার করুণাসিক্ত ও সর্বদিক থেকে মোবারক বা কল্যাণমন্ডিত হয়। (আমীন)

হুযূর বলেন, এই মসজিদের জন্য বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করা হচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ কাদিয়ানের মসজিদে মোবারকের জন্য আল্লাহ্ তা’লা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি যে ইলহাম করেছিলেন তা হুযুরের মনে পড়ে যাওয়ায় হুযূর এর নাম মসজিদে মোবারক রাখেন। আরবী ইলহামটির যে অনুবাদ মসীহ্ মওউদ (আ.) স্বয়ং করেছেন তা হল- ‘এই মসজিদ কল্যাণ দানকারী ও কল্যাণমন্ডিত, আর প্রত্যেক কল্যাণমন্ডিত কাজ (বা সিদ্ধান্ত) এতে করা হবে’। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ করুন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কাদিয়ানের মসজিদে মোবারকে যে সকল দোয়া করেছেন এবং পৃথিবীতে ইসলামের বিস্তৃতি লাভের ও বিজয়ের জন্য তার যে আকাঙক্ষা ও ব্যাকুল আবেগ ছিল- তা সবই যেন এই মসজিদও লাভ করে; আর ইংল্যান্ড, ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্বে তওহীদ প্রতিষ্ঠার ও ইসলামের প্রচারের জন্য এটি যেন এক চিরন্তন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এখানে কেন্দ্রের স্থানান্তর সবদিক থেকে কল্যাণমন্ডিত হোক, আর খিলাফতে আহমদীয়ার পক্ষ থেকে নেয়া সকল পরিকল্পনা সর্বদা যেন আল্লাহ্ তা’লার ফযল ও বরকতে সিক্ত হয়; আর আল্লাহ্ তা’লার দৃষ্টিতে যেসব কল্যাণ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, এই মসজিদও তা লাভ করতে থাকুক। (আমীন)

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) রাবওয়ার মসজিদে মোবারকের নির্মাণের সময়ও বলেছিলেন, এই মসজিদ কাদিয়ানের মসজিদে মোবারকের স্থলাভিষিক্ত এবং সেটির সদৃশ ও প্রতিবিম্ব হবে। সেখানে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খিলাফতের অবস্থান ছিল, এখনও কেন্দ্রীয় দপ্তরসমূহ সেখানে অবস্থিত। কিন্তু বিগত প্রায় ৩৫ বছর ধরে খিলাফত সেখানে নেই, রাষ্ট্রীয় আইনের কারণে খিলাফতকে সেখান থেকে হিজরত করতে হয়। আর পরবর্তীতে আল্লাহ্ তা’লা এখানে জামাতের জন্য উন্নতির আরও বড় দুয়ার খুলে দেন। আল্লাহ্ তা’লা সেই বিস্তৃতিকে আরও ব্যাপক করতে থাকুন; আর শত্রুরা নিজেদের ভ্রান্ত ধারণা অনুসারে যে কল্যাণ ও কৃপা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল, আল্লাহ্ তা’লা এই মসজিদ ও কেন্দ্রের মাধ্যমে জামাতকে তার চেয়ে অনেক গুণ বাড়িয়ে উন্নতির দৃশ্য দেখানে থাকুন। (আমীন)

হুযূর (আই.) প্রাসঙ্গিকভাবে আহমদী-বিরোধীদের বিভিন্ন অন্ধ বিদ্বেষ ও মূর্খতার উদাহরণ তুলে ধরেন, তাদের নিজেদের জঘন্য ইসলামবিরোধী ও রমযানের মর্যাদার পরিপন্থী কর্মকান্ডের উদাহরণ তুলে ধরে আহমদীদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেন যে আমাদের কতটা আকুতির সাথে আল্লাহ্ তা’লার কাছে দোয়া করতে হবে যেন এসব লোক ভ্রান্তি থেকে সঠিক পথে ফিরে আসে; অমুসলিমদের সামনে ইসলামের প্রকৃত, খাঁটি ও অনিন্দ্যসুন্দর শিক্ষামালা তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমাদের উপর যে গুরুভার ন্যস্ত হয় তা-ও হুযূর স্মরণ করিয়ে দেন। হুযূর এটাও স্মরণ করান, এখানকার স্থানীয় অমুসলিমদের গভীর দৃষ্টি এখন আমাদের উপর রয়েছে, তাই আমরা যেন সার্বিকভাবে ইসলামী শিক্ষার উপর আমল করি; বিশেষভাবে প্রতিবেশীর অধিকার প্রদান ও কোনভাবে তাদের কষ্টের কারণ না হওয়ার বিষয়টি যেন আমরা দৃষ্টিপটে রাখি। যদি আমরা এসব বিষয় দৃষ্টিপটে রেখে খাঁটি ইসলামী পন্থায় নিজেদের জীবন যাপন করি, তবে তা-ই ইসলামের তবলীগের অনেক বড় মাধ্যম হবে, একইসাথে আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’লার কৃপারাজি অর্জনকারীও বানাবে। এর পাশাপাশি হুযূর প্রত্যেককে নিজ নিজ ঘরেও পরিবারের সদস্যদের সাথে সদ্ব্যবহার ও উন্নত আচরণ প্রদর্শনের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন যেন পরিবারের বাকি সদস্যরা, বিশেষভাবে পরবর্তী প্রজন্ম যেন ইসলাম বা আহমদীয়াত সম্বন্ধে বিরূপ না হয় এবং জামাতের উপকারী শাখা-প্রশাখায় পরিণত হয়। রমযান মাসের বিশেষ আধ্যাত্মিক পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে আমরা সবাই যেন নিজেদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন সাধন করি ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী স্থায়ীভাবে রপ্ত করি। মসজিদের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়ার ব্যাপারে হুযূর নির্দেশনা প্রদান করেন; নামাযের হক বা অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ আমাদেরকে স্মরণ করান যে আমরা যেন নামাযে দাঁড়ানোর সময় আল্লাহ্ তা’লাকে সাক্ষাৎ দর্শন করার মত অবস্থা নিজেদের মাঝে সৃষ্টি করি, নতুবা কমপক্ষে এতটুকু অনুভূতি যেন আমাদের মধ্যে কার্যকর থাকে যে আল্লাহ্ আমাদেরকে দেখছেন। অন্যথায় আমরা সেসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব, যাদের নামায উল্টো তাদের ধ্বংসের কারণ হয়েছে।

হুযূর বলেন, আল্লাহ্ তা’লা রমযান মাসে আমাদেরকে এই মসজিদ উদ্বোধনের সুযোগ দান করেছেন, তাই এই বরকতপূর্ণ ও দোয়া কবুল হওয়ার মাসের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আহমদীয়াতের উন্নতির জন্য এবং পৃথিবীর এই অংশে আহমদীয়াতের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য অনেক বেশি বেশি দোয়া করুন। এই কেন্দ্রও বড় হতে থাকুক, এর চারপাশে আহমদীদের বসবাস বৃদ্ধি পাক, মানুষদের ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করার নিত্যনতুন দৃশ্যাবলী যেন আমরা দেখতে থাকি, বিরুদ্ধবাদীদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র যেন আমাদের চোখের সামনে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, রাবওয়া ও কাদিয়ানে প্রত্যাবর্তনের পথ যেন উন্মুক্ত হয়, একইভাবে মক্কা ও মদীনায় যাবার পথও যেন উন্মুক্ত হয়, যা আমাদের নেতা ও মনীব মুহাম্মদ (সা.)-এর দেশ এবং ইসলামের চিরন্তন কেন্দ্র, খাঁটি ইসলামের বাণী যেন তাদেরও কর্ণগোচর হয় এবং তারা তা গ্রহণ করতে পারে; আল্লাহ্ তা’লা তাদের চোখ খুলে দিন যারা অজ্ঞতার কারণে জামাতের প্রতি বিদ্বেষ রাখে, আর যারা কেবলমাত্র দুষ্টামিবশতঃ ও নিজেদের জাগতিক স্বার্থের কারণে সাধারণ মুসলমানদের মনকে মসীহ্ মওউদ (আ.) ও তার জামাতের বিরুদ্ধে বিষিয়ে দিচ্ছে আল্লাহ্ তা’লা শীঘ্রই তাদের পাকড়াও করুন, মুসলমানরা মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে একত্রিত হয়ে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার বাস্তব চিত্রে পরিণত হোক, আর অমুসলিম বিশ্বও শীঘ্রই ইসলামের পতাকাতলে একত্রিত হোক। (আমীন)