শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ: হযরত হামযা বিন মুত্তালিব (রা.)

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

০৪-মে, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ৪শে মে, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় তিনি হযরত হামযা বিন মুত্তালিব (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর (আই.) বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) একস্থানে বলেছেন, “মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের সময় আরব জাতির সাংস্কৃতিক, চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিকতার অবস্থা কীরূপ ছিল? ঘরে ঘরে যুদ্ধ, মদ্যপান, ব্যভিচার, লুটপাট- এক কথায় সকল প্রকার অপকর্মই সেখানে বিদ্যমান ছিল। খোদা তা’লার সাথে কারো কোন সম্পকই ছিল না আর উত্তম চরিত্রের অধিকারীও কেউ ছিল না। প্রত্যেকেই ফেরাউনের মত আচরণ করত। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর আগমনের পর যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করল, তখন এমন ঐশীপ্রেম ও একত্ববাদের চেতনা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেল যে, প্রত্যেকেই খোদা তা’লার পথে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা বয়আতের অঙ্গীকার বাস্তবে পূর্ণ করে দেখিয়েছেন এবং নিজেদের কর্মের মাধ্যমে তার আদর্শ প্রদর্শন করেছেন। মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ এরূপ বিশ্বস্ততার আদর্শ দেখিয়েছেন, যার দৃষ্টান্ত আগেও কখনও দেখা যায়নি আর পরেও দেখা যায় না।”

তিনি (আ.) বলেন, কিন্তু খোদা তা’লা চাইলে পুনরায় তদ্রুপ করতে পারেন। সাহাবীদের এসব আদর্শে অন্যদের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। খোদা তা’লা সাহাবীদের প্রশংসায় কতই না সুন্দর কথা বলেছেন, مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ (সূরা আল্ আহযাব: ২৪) অর্থাৎ, ‘মুমিনদের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা খোদা তা’লার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেখিয়েছে; তাদের মধ্যে কতক নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে এবং কতক জীবন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত বসে আছে’; সাহাবীদের প্রশংসা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন থেকে যদি বিভিন্ন আয়াত সংগ্রহ করা হয় তাহলে এরচেয়ে উত্তম আর কোন আদর্শ বর্ণনা হতে পারে না। মোটকথা, বিভিন্ন প্রকার পুণ্যকর্ম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলেন আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।

হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন, বিগত কিছুদিন ধরে আমি কতিপয় খুতবায় সাহাবীদের জীবনালেখ্য বর্ণনা করছি, যার মাঝে কয়েকজন বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবী ছিলেন আর কয়েকজন অন্য সাহাবীও ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হল, প্রথমে শুধুমাত্র বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের কথা বর্ণনা করি, কারণ তাঁদের একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাঁরা এমন মানুষ ছিলেন যাঁদের প্রতি আল্লাহ্ তা’লা সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তাঁরা খোদার বিশেষ সন্তোষভাজন ছিলেন।

হুযূর বলেন, আজ আমি হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব (রা.)-এর কথা বর্ণনা করব। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বিস্তারিতভাবে হাদীস ও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে, তেমনিভাবে তাঁর শাহাদতের ঘটনারও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে; তাঁর উপাধিই আছে সৈয়দুশ্ শুহাদা বা শহীদদের নেতা, একইভাবে আসাদুল্লাহ্ ও আসাদে রসূল অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সিংহ ও রসূলের সিংহ উপাধিতেও তিনি ভূষিত হয়েছেন।

হুযূর বলেন, হযরত হামযা কুরাইশ নেতা হযরত আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র ও মহানবী (সা.)-এর চাচা ছিলেন। হামযার মাতা ‘হালা’ মহানবী (সা.)-এর মাতা হযরত আমেনার চাচাতো বোন ছিলেন। হযরত হামযা মহানবী (সা.)-এর চেয়ে বয়সে দুই বা চার বছরের বড় ছিলেন; তারা দু’জন দুধভাইও ছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা উভয়ে কৃতদাসী সওবিয়ার দুধ পান করেছেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর নবুওয়ত লাভের ষষ্ঠ বছরে দারুল আরকামের যুগে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেন।

ইতিহাসের আলোকে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে ঘটনার বিবরণ হল, একদিন মহানবী (সা.) সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে একটি পাথরের ওপর বসে ভাবছিলেন যে, কীভাবে খোদার তৌহিদ বা একত্ববাদ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা যায়। ইত্যবসরে আবু জাহল সেখানে এসে চরম নোংরা ও অকথ্য ভাষায় তাঁকে গালাগালি করতে আরম্ভ করে এবং এক পর্যায়ে তাঁর গালে চড়ও মারে। কিন্তু এত কদর্যপূর্ণ গালিগালাজ এবং থাপ্পর খেয়েও মহানবী (সা.) ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব ও নিশ্চুপ। হযরত হামযার ঘর এই উপত্যকার একেবারে সামনেই ছিল। হামযা যদিও জানতেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) সত্য তারপরও সামাজিকতার কারণে তিনি তখনও তাঁর প্রতি ঈমান আনেন নি। হযরত হামযার অভ্যাস ছিল দৈনিক সকালে তীর-ধনুক নিয়ে শিকারে বের হতেন, সন্ধ্যায় শিকার করে ফিরে এসে কুরাইশ নেতাদের আসরে যোগ দিতেন। সেদিন আবু জাহল যখন মহানবী (সা.)-এর সাথে এরূপ অসদাচরণ করেছিল তখন হযরত হামযা তো শিকারে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বাড়ীর এক পুরনো দাসী এসব ঘটনা দেখছিল। যদিও সেই দাসী অমুসলমান ছিল, কিন্তু আবু জাহলের এমন ধৃষ্টতা ও বর্বরতা দেখে সে মনে মনে খুবই কষ্ট পাচ্ছিল। বিকালে হামযা বাড়ি ফিরেন এবং তীর-ধনুক হাতে নিয়ে বীরবেশে যখন ঘরে ঢুকছিলেন, তখন সেই কৃতদাসী খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, তোমার লজ্জা করে না এরকম বীরের বেশ ধরতে! তোমার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও আবু জাহল তোমার ভাতিজার সাথে এমন নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারলো? একথা শুনে হামযা খুবই আশ্চর্য হন। তখন সেই দাসী নিজ চোখে দেখা পুরো ঘটনা খুলে বলে। একথা শুনে হামযার চোখ রক্তিম হয়ে যায়, তিনি তৎক্ষণাৎ সেই অবস্থাতেই কাবা অভিমূখে রওয়ানা হন। কাবা তওয়াফ করে তিনি কুরাইশদের আসরের দিকে যান যেখানে আবু জাহল সকালের সেই ঘটনা খুব রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করছিল। হযরত হামযা গিয়েই ধনুক দিয়ে তার মাথায় সজোরে আঘাত করে বলেন, ‘খুব নিজের বীরত্বের বর্ণনা দিচ্ছ যে, মুহাম্মদকে (সা.) অপমান করেছ আর সে টুঁ শব্দটিও করেনি? এখন আমি তোমাকে লাঞ্ছিত করছি, সাহস থাকলে আমাকে কিছু করে দেখ!’ এতে আবু জাহলের সাঙ্গপাঙ্গ অন্যান্য কুরাইশ নেতারা হামযাকে আক্রমন করতে উদ্যত হলে আবু জাহল নিজেই সবাইকে নিরস্ত করে বলে, ‘বাদ দাও, আসলে আমিই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম’। তখন হযরত হামযা সেখানেই তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। আর হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণের ফলে মক্কার মুসলমানরা অনেকটা সাহস পায়।

কাফিররা যখন মুসলমানদের জীবন বিষিয়ে তোলে তখন মহানবীর নির্দেশে হযরত হামযাও অন্যান্যদের সাথে মদীনায় হিজরত করেন। হিজরতের পরও মক্কার কাফিররা মুসলমানদের পিছু ছাড়েনি, বরং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এমনি একবার মহানবী (সা.) কুরাইশদের ব্যাপারে খোঁজ নেবার জন্য হযরত হামযার নেতৃত্বে ৩০জন উষ্ট্রারোহীকে ‘কিশ’ এলাকায় পাঠান। তারা সেখানে গিয়ে দেখেন আবু জাহল আগেই সেখানে ৩০০ উষ্ট্রারোহী নিয়ে হাজির। মুসলমানদের তুলনায় তারা দশগুণ হওয়া সত্ত্বেও হযরত হামযা নির্ভয়ে তাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার উপক্রম করেছিলেন, তখন সেখানকার এক নেতার হস্তক্ষেপ ও অনুরোধে লড়াই বাঁধতে বাঁধতে থেমে যায়। এছাড়া এটিও বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, রসূলুল্লাহ্ (সা.) মুসলমানদের প্রথম পতাকা হযরত হামযার হাতেই দিয়েছিলেন, তবে কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী তা আবু উবাদাকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২য় হিজরিতে বনু কায়নোকাআর যুদ্ধে হযরত হামযাই রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পতাকা বহন করেছিলেন।

বদরের যুদ্ধের সময়ও তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের যুদ্ধেই কাফির নেতা উতবার জবাবে তিনি একথা বলেছিলেন, আমি হামযা, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সিংহ। এমনকি কাফির নেতারাও একথা অবলীলায় স্বীকার করে যে, হামযাই সেদিন তাদের সবচেয়ে ক্ষতি করেছিল। উহুদের যুদ্ধেও তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। সেদিন তিনি দু’হাতে দু’টি উম্মুক্ত তরবারী নিয়ে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু ওয়াহশি নামক এক হাবশী ক্রীতদাস, যে তাকে হত্যা করার জন্য লুকিয়ে ওঁৎ পেতে বসে ছিল, তার ওপর বর্শা দিয়ে অতর্কিত আক্রমন করে তাঁকে শহীদ করে। শাহাদতের সময় তার বয়স ছিল ৫৯ বছর। কাফিররা হামযার লাশ বিকৃত করেছিল, তার নাক-কান ইত্যাদি কেটে দিয়েছিল এবং আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা তার কলিজা চিবিয়েছিল। মহানবী (সা.) হযরত হামযার লাশের নিকট এসে যে আবেগ প্রকাশ করেন ও হামযার উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ শোনান তা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন, হে হামযা! তোমার এই অবস্থার চেয়ে বড় আর কোন কষ্ট আমার হবে না; জীব্রাঈল এসে আমাকে খবর দিয়েছেন, হামযার নাম সাত আকাশে লেখা হয়েছে- ‘আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সিংহ’।

হযরত যুবায়েরের মাতা হযরত সাফিয়া (রা.) হযরত হামযার কাফনের জন্য দু’টি কাপড় এনেছিলেন, যার মধ্যে একটি হামযার কাফন হিসেবে ব্যবহার করা হয়, অন্যটি আরেকজন আনসারীর জন্য ব্যবহার করা হয়। কাপড়ের টুকরোটি হামযার কাফনের জন্য ছোট ছিল, অর্থাৎ মাথা ঢাকালে পা বেড়িয়ে পড়তো আর পা ঢাকলে মাথা। তখন মহানবী (সা.) মাথা ঢেকে দিতে বলেন এবং তার খোলা পা দু’টি ঘাস দিয়ে ঢেকে দিতে বলেন। পরবর্তীতে সাচ্ছন্দ্যের যুগে অন্য সাহাবীরাও এই ঘটনা বেদনাভরে স্মরণ করতেন আর আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়তেন আর বলতেন, আল্লাহ্ আমাদেরকে ইহজগতেই এতকিছু দিয়েছেন যে, ভয় হয় পরকালে আমরা আবার খোদার নিয়ামত থেকে বঞ্চিত না থাকি।

মহানবী (সা.) হামযার জানাযাও অসাধারণভাবে পড়িয়েছিলেন। প্রথমে তিনি (সা.) হামযার জানাযা পড়ান, এরপর একে একে অন্য শহীদদের লাশ আনা হয় এবং জানাযা হবার পর সেগুলোকে সরিয়েও নেয়া হয়; কিন্তু হামযার লাশ সরানো হয়নি এবং এভাবে মহানবী (সা.) ৭০ বার তার জানাযা পড়ান।

বিভিন্ন সময়ে এবং কঠিন মুহুর্তে হযরত হামযা (রা.) যে বীরত্ব ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন এবং ইসলামের সেবায় তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, খোদার ধর্মের সম্মান রক্ষার জন্য তাঁর হৃদয়ে যে ব্যাকুলতা ছিল তা হুযূর বিভিন্ন সাহাবীর বরাতে বর্ণনা করেন। তাঁর বীরত্বের কথা প্রাচ্যবিদ মিষ্টার উইলিয়াম মুইরও বিভিন্নস্থানে বর্ণনা করেছেন। হুযূর আনোয়ার (আই.) সংক্ষেপে সেসব ঘটনা তুলে ধরেন এবং জামাতকে হযরত হামযার আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দেন।

হুযূর (আই.) খুতবার শেষদিকে এসে দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা সাহাবীদের মর্যাদা উচ্চ থেকে উচ্চতর করতে থাকুন, আর তাঁরা আত্মোৎসর্গের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা পৃথিবী যতদিন আছে ততদিন মুসলমানরা স্মরণে রাখুক, আর তাঁরা যে পুণ্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন আমাদেরকে তা অবলম্বন ও পালনের তৌফিক দিন। (আমীন)