শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ – নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীগণ

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

১৭-আগস্ট, ২০১৮

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ১৭ই আগস্ট, ২০১৮ইং লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় পূর্বের ধারা অনুসরণে নিষ্ঠাবান বদরী সাহাবীদের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। এ খুতবায় হযরত আমের বিন রবীআ (রা.), হযরত হারাম বিন মিলহান (রা.), হযরত সা’দ বিন খাওলা (রা.), হযরত আবুল হাইসাম বিন আত-তাইয়িহান (রা.)’র জীবনের স্মৃতিচারণ করেন।

হুযূর (আই.) তাশাহহুদ, তাআ’ব্বুয ও সূরা ফাতিহা পাঠের পর বলেন, আজও আমি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন সাহাবীর স্মৃতিচারণ করব। প্রথমে রয়েছেন হযরত আমের বিন রবীআ (রা.)। তিনি হযরত উমর (রা.)-এর পিতা খাত্তাবের পালকপুত্র ছিলেন এবং আগে আমের বিন খাত্তাব নামে পরিচিত ছিলেন; কিন্তু যখন কুরআন শরীফে নির্দেশ অবতীর্ণ হল যেন প্রত্যেককেই তার জন্মদাতা পিতার প্রতি আরোপ করে ডাকা হয়, তখন থেকে তাকে তার আসল পিতা রবীআর নাম জুড়ে দিয়ে আমের বিন রবীআ ডাকা শুরু হয়। হুযূর বলেন, এই ঘটনা তাদের ক্ষেত্রে দলিল, যারা বাচ্চা দত্তক নেবার সময় আসল পিতা-মাতার নাম বদলে দেয়, এমনকি পরিচয়পত্রেও আসল পিতা-মাতার বদলে পালক পিতা-মাতার নাম লেখানো হয়, ফলে অনেক রকম সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি হয়; তাই সবসময় কুরআনের নির্দেশ পালন করা উচিত। ব্যতিক্রম কেবল সেক্ষেত্রে হতে পারে যদি এমন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে বাচ্চা দত্তক নেয়া হয় যারা আসল পিতা-মাতার পরিচয় কখনো প্রকাশ করে না। হুযূর বলেন, হযরত উমরের পরিবারের সাথে তার এই সুসম্পর্ক শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। হযরত আমের একেবারে প্রথম দিকের মুসলমান ছিলেন। তিনি তার স্ত্রী লায়লা বিনতে হাসমাকে নিয়ে আবিসিনিয়াতেও হিজরত করেছিলেন, পরে মক্কা ফেরত এসে আবার মদীনায় হিজরত করেন, তার স্ত্রী-ই মদীনাতে প্রথম নারী মুহাজির ছিলেন। তিনি বদরসহ সকল যুদ্ধেই মহানবী (সা.)-এর সাথী ছিলেন। তার মৃত্যু হয় ৩২ হিজরি সনে। হযরত আমের বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোন জানাযা যেতে দেখে এবং সে তার সাথে যেতে অপারগ হয়, তাহলে সে যেন সেই জানাযা তাকে অতিক্রম না করা পর্যন্ত বা কোথাও রাখা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে সম্মান দেখায়।’ হযরত উসমান (রা.)-এর যুগে যখন খলীফার বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, তখন একদিন রাতে তাকে স্বপ্নে নির্দেশ দেয়া হয় যেন তিনি এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করেন। তিনি তা-ই করেন, এর ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং নিজে আর বাড়ি থেকে বেরোতে পারেন নি, বরং লাশরূপে বাড়ি থেকে বের হন। কাবা প্রদক্ষিণ করার সময় রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায়, আমের সেটি মেরামত করতে চাইলে তিনি (সা.) তা করতে দেন নি এবং নিজের কাজ নিজে করার অতুলনীয় শিক্ষা নিজের উদাহরণের মাধ্যমে শিখিয়ে দিলেন। মহানবী (সা.) হযরত ইয়াযিদ বিন মুনযের-এর সাথে তাকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় সাহাবী হলেন হযরত হারাম বিন মিলহান (রা.)। তিনি আনসারদের বনু আদী বিন নাজ্জার গোত্রের লোক ছিলেন। হযরত আনাস বিন মালেকের মা হযরত উম্মে সুলায়ম ও হযরত উবাদা বিন সামেতের স্ত্রী উম্মে হারাম তার বোন ছিলেন। হযরত হারাম বিন মিলহান বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, বি’রে মা’উনার ঘটনায় তিনি শহীদ হন যার উল্লেখ কয়েক মাস আগে খুতবাতে করা হয়েছে। বুখারী শরীফ থেকে হুযূর নতুন আরও কিছু বর্ণনা তুলে ধরেন। হযরত হারামকে যখন পেছন থেকে বর্শা মারা হয়, তখন তিনি নিজ হাতে সেই রক্ত নিয়ে মুখে ও মাথায় ছিটিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কা’বার প্রভুর শপথ, নিশ্চয়ই আমি সফল হয়েছি!’ এই দুঃখজনক ঘটনায় মহানবী (সা.) রি’ল, যাকওয়ান, বনু লিহইয়ান ও কুসাইয়া গোত্রের বিরুদ্ধে টানা একমাস নামাযে রুকুর পর দাঁড়িয়ে ব্যথিত হৃদয়ে দোয়া করতেন। হারাম বিন মিলহানকে হত্যাকারী জাব্বার বিন সালমা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন, এর কারণ ছিল হারাম বিন মিলহানের সেই মহান উক্তি- ‘কা’বার প্রভুর শপথ, নিশ্চয়ই আমি সফল হয়েছি!’ জাব্বার এটি শুনে আশ্চর্য হন যে, এই লোক মরে গিয়েও বলছে সে সফল হয়েছে। পরে যখন তিনি মুসলমানদের সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন তিনি প্রভাবিত হন ও ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) লিখেন, এই ঘটনায় মহানবী (সা.) চরম দুঃখ পেলেও দোষীদের বিরুদ্ধে কোন সামরিক ব্যবস্থা নেন নি বরং একটানা দোয়া করে গিয়েছেন; হুযূর বলেন, আজও আহমদীয়াতের শত্রুদের থামানোর জন্য দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সাহায্য লাভের প্রয়োজন রয়েছে।

আরেকজন সাহাবী হলেন হযরত সা’দ বিন খাওলা (রা.), তিনি প্রথম দিকের মুমিনদের মধ্যে গণ্য হন। তিনি দ্বিতীয় দফায় আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণের সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর; এছাড়াও উহুদ, খন্দকের যুদ্ধ ও হুদায়বিয়ার সন্ধিতে উপস্থিত ছিলেন। বিদায় হজ্জের সময় তার মৃত্যু হয়।

আরেকজন সাহাবী হযরত আবুল হাইসাম বিন আত-তাইয়িহান (রা.), তিনি আনসারী সাহাবী ছিলেন। তিনি জাহিলিয়্যাতের যুগেও মূর্তিপূজার তীব্র বিরোধী ছিলেন। যখন ইসলামের সংবাদ পান, সাথে সাথে তা গ্রহণে প্রস্তুত হয়ে যান, উকবার প্রথম বয়আতের সময় মদীনা থেকে আগত প্রতিনিধিদলের সাথে এসে বয়আত করেন। তিনি সেই ছয়জন আনসারীর একজন ছিলেন যারা মক্কায় গিয়ে মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং এরপর মদীনা এসে ইসলাম প্রচার করেন। উকবার দ্বিতীয় বয়আতের সময় মহানবী (সা.) যে বারজন ব্যক্তিকে অন্যদের জন্য নকীব বা নেতা মনোনীত করেছিলেন, হযরত আবুল হাইসাম তাদের একজন ছিলেন। বয়আতের সময় মহানবী (সা.)-এর কাছে আবেদন করে বলেছিলেন, যখন আল্লাহ্ আপনাকে সাহায্য করবেন ও আপনার জাতির উপর আপনাকে বিজয়ী করবেন, তখন আমাদেরকে ছেড়ে নিজ জাতির কাছে ফিরে যাবেন না। রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছিলেন, ‘এখন তোমাদের রক্ত আমার রক্ত হয়ে গিয়েছে, এখন আমি তোমাদের অংশ আর তোমরা আমার অংশ। তোমাদের সাথে যে লড়ে সে যেন আমার বিরুদ্ধেই লড়াই করে, আর যে তোমাদের সাথে সন্ধি করে সে যেন আমার সাথেই সন্ধি করে।’

হিজরতের পর মহানবী (সা.) হযরত উসমান (রা.)-এর সাথে তাকে ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ করেন। তিনি প্রায়ই মহানবী (সা.) ও তাঁর সাথীদের দাওয়াত করে খাওয়াতেন। একবার এমন একটি দাওয়াত খাওয়ার পর মহানবী (সা.) সাথের সঙ্গীদের বলেন, তাকে দাওয়াত খাওয়ানোর প্রতিদান দাও। সাহাবীরা জানতে চাইলেন, কিভাবে প্রতিদান দেব? মহানবী (সা.) শেখালেন, যখন কেউ তার ভাইয়ের বাড়িতে দাওয়াত খায়, তখন তার উচিত সেই ভাইয়ের জন্য দোয়া করা- এটিই তার প্রতিদান। একবার মহানবী (সা.) তাকে উপহারস্বরূপ একজন দাস দান করেন ও তার সাথে উত্তম আচরণ করার নির্দেশও প্রদান করেন। তার স্ত্রীও ঈমানের ক্ষেত্রে অসাধারণ ছিলেন, আবুল হাইসাম বাড়ি ফিরে সবকিছু স্ত্রীকে বললে স্ত্রী বলেন, তুমি মহানবী (সা.)-এর নির্দেশের হক তো আদায় করতে পারবে না; তুমি একে স্বাধীন করে দাও- তাহলেই রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নির্দেশের হক আদায় হবে। তার ইসলাম সেবার আরও অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। তার মৃত্যু সম্পর্কে হুযূর বলেন, কারও কারও মতে তার মৃত্যু হযরত উমরের যুগে হয়েছে, কেউ বলে ২০ হিজরিতে তার মৃত্যু হয়েছে, কেউ বা বলে তিনি ২৭ হিজরিতে সিফফিনের যুদ্ধে হযরত আলীর পক্ষে লড়াই করতে করতে শহীদ হন।

হুযূর (আই.) বলেন, এরা হলেন সেসব সাহাবী যারা আমাদের জন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন এবং আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়ে গিয়েছেন। হুযূর দোয়া করেন, আল্লাহ্ তা’লা তাদের পদমর্যাদা ক্রমশ উন্নত করুন।

হুযূর নামাযের পর দুটি গায়েবানা জানাযার ঘোষণাও করেন। প্রথম জানাযা মোকাররম সাহেবযাদা মির্যা মজিদ আহমদ সাহেবের, যিনি সাহেবযাদা মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.)-এর পুত্র ছিলেন, গত ১৪ আগস্ট ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিঊন। ৭ মে ১৯৪৪ সালে ধর্মসেবার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে জামেয়াতে ভর্তি হন, ১৯৫৪ সালের জুলাইয়ে শাহেদ ডিগ্রী লাভ করেন, বিভিন্নভাবে জামাতের সেবা করেছেন। পড়াশোনার খুব শখ ছিল, হুযূর (আই.) নিজেও তাকে অধিকাংশ সময় লাইব্রেরিতে পড়াশোনায় মগ্ন দেখেছেন। হুযূর তার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। দ্বিতীয় জানাযা মোকাররমা সাঈদা নাসিম আখতার সাহেবার, যিনি ২৭ জুলাই তারিখে মৃত্যুবরণ করেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিঊন। হুযূর তারও সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন। উভয়ের জন্য দোয়া করেন যেন আল্লাহ্ তা’লা তাদের পদমর্যাদায় উন্নীত করেন এবং তাদের পরিজনদেরকে ধৈর্য দান করেন ও তাদের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তৌফিক দান করেন। (আমীন)