প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আ.): যুগ-ইমামের আবশ্যকতা

হযরত মির্যা মসরূর আহমদ - খলীফাতুল মসীহ্‌ আল্‌ খামেস (আই.)

২২-মার্চ, ২০১৯

মসজিদ বাইতুল ফুতুহ্, লন্ডন, যুক্তরাজ্য

জুমুআর খুতবার সারমর্ম


এই জুমু’আর খুতবার সারাংশটিতে কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তার দায়ভার আহ্‌মদীয়া বাংলা টীম গ্রহণ করছে।

আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিশ্ব-প্রধান ও পঞ্চম খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মসরূর আহমদ (আই.) গত ২২শে মার্চ, ২০১৯ লন্ডনের বায়তুল ফুতুহ মসজিদে প্রদত্ত জুমুআর খুতবায় ২৩ মার্চ মসীহ্ মওউদ দিবসের প্রক্ষাপট, প্রতিশ্রুত মসীহ্ মওউদ (আ.) আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তার বর্ণনা, প্রতিশ্রুত মসীহ্-এর আগমনের উদ্দেশ্য ও আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ব্যাখ্যা করেন।

হুযূর বলেন, আগামীকাল ২৩শে মার্চ, যা আহমদীয়া জামাতে ‘মসীহ্ মওউদ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনে মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী (আ.) তাঁর আগমনের ঘোষণা প্রদান করেন। যার শেষ যুগে পৃথিবীতে এসে জগতের সামনে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরার ও তা প্রচার করার কথা, মুসলমানদের এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করার কথা এবং সকল ধর্মের লোকদের মহানবী (সা.)-এর দাসত্বের গণ্ডিভুক্ত করার কথা। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) ঘোষণা করেন- আমিই সেই প্রতিশ্রুত মসীহ্ ও মাহদী, যার আগমনের সুসংবাদ মহানবী (সা.) প্রদান করেছিলেন।

হুযূর (আই.) হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর রচনাসমগ্র হতে কতিপয় নির্বাচিত উদ্ধৃতি তুলে ধরেন, যেগুলোতে তিনি (আ.) মসীহ্ মওউদের আগমনের প্রয়োজন, যুগের বিরাজমান অবস্থা আর তাঁর দাবী ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নিদর্শনের উল্লেখ করেছেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তার একটি পঙক্তিতে লিখেন-ওয়াক্ত থা ওয়াক্তে মসীহা- না কিসি অওর কা ওয়াক্ত, ম্যাঁয় না আতা তো কোই অওর হি আয়া হোতা; অর্থাৎ “এটি ছিল যুগ মসীহ্‌র সময়, আমি না আসলে অন্য কেউ অবশ্যই আসতো।” অর্থাৎ যুগের বিরাজমান অবস্থাই দাবী করছিল যেন কেউ এসে ইসলামের দোদুল্যমান নৌকার হাল ধরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলমান আলেম-ওলামার অধিকাংশ, যারা ইতোপূর্বে মসীহ্‌র আগমনের অপেক্ষায় অধীর ছিল, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) ও তাঁর জামাতের বিরুদ্ধে সাধারণ মুসলমানদের কাছে এতটা মিথ্যাচার করেছে ও তাদেরকে বিরোধিতায় উস্কে দিয়েছে যে, হত্যার ফতোয়া পর্যন্ত জারি করেছে তাঁর বিরুদ্ধে; আর আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও স্থানে আহমদীদের ওপর চরম যুলুম ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে আর এসবই করা হচ্ছে ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে।

এ যুগে মসীহ্ মওউদের আগমনের আবশ্যকতা কী এ সম্পর্কে তিনি (আ.) বলেন, “পবিত্র কুরআনে ইস্রাঈলী ও ইসমাঈলী- এই দুই উম্মতের মধ্যে খিলাফতের সাদৃশ্যের ব্যাপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছে। তিনি (আ.) এর স্বপক্ষে আয়াতে ইস্তেখলাফের ভাষ্য তুলে ধরেন। যেভাবে মূসা (আ.)-এর পর চতুর্দশ শতাব্দীর শিরোভাগে মসীহ্ নাসেরীর আগমন হয়েছিল, তেমনিভাবে এই উম্মতেও চতুর্দশ শতাব্দীর শিরোভাগে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার মসীহ্‌র আগমন আবশ্যক ছিল। এছাড়া অনেক দিব্যদর্শী ব্যক্তিও একই অভিমত প্রকাশ করেছেন; তাদের মধ্যে শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দেহলভী অন্যতম, যিনি বলেছিলেন- মসীহ্‌র আগমনের প্রায় সকল নিদর্শনই পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, প্রকৃতপক্ষে নিদর্শনাবলী সবই পূর্ণ হয়েছে; বুখারী শরীফ অনুসারে আগমকারীর একটি বড় নিদর্শন হল ‘তিনি ক্রুশ ভঙ্গ করবেন ও শূকর বধ করবেন’, অর্থাৎ মসীহ্‌র নাযিল হবার যুগ হল, খ্রিস্টধর্মের জয়জয়কার ও ক্রুশ-পূজার আধিক্যের যুগ। আর এমনটি তো এই যুগেই (অর্থাৎ মসীহ্ মওউদ এর যুগে) স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর এখন তিনি যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে দাজ্জালকে হত্যা করবেন; কেননা হাদীসে তা-ই বর্ণিত হয়েছে- মসীহ্ ভ্রান্ত ধর্মগুলোকে ধ্বংস করবেন, সাধারণ মানুষদের নয়।

যুগের বিরাজমান অবস্থা ও মসীহ্‌র আগমনের আবশ্যকতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি (আ.) আরো বলেন, জমি যদি উপযুক্ত ও উর্বর না হয়, তাহলে বৃষ্টির পানি দ্বারা তা আদৌ উপকৃত হয় না, উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন আকাশ থেকে জ্যোতি অবতীর্ণ হচ্ছে, এমন যেন না হয় যে, তোমরা উপকৃত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো অন্ধকারের গহ্বরে নিপতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাও। আল্লাহ্ তা’লা এ যুগের প্রতি অনেক অনুগ্রহ করে তাঁর মনোনীত ধর্ম ও মহানবী (সা.)-এর সমর্থনে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করেছেন। যদি এই যুগ এতটা বিশৃঙ্খল না হতো ও ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এত গভীর ষড়যন্ত্র না হতো, তাহলে কোন সমস্যাই ছিল না। কিন্তু তোমরা দেখছ যে, চতুষ্পার্শ্ব হতে এর ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। ইসলামের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণে বই-পুস্তক প্রচার করা হয়েছে ও হচ্ছে। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মপ্রচারে ব্যাপকহারে অর্থ ব্যয় করছে। অথচ ইসলামের পক্ষে এমন কিছুই করা হচ্ছে না। ভারতবর্ষে সে যুগে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল কোটি আর খিস্ট্রানরা ইসলামের বিরুদ্ধেও কোটি বই-পুস্তক প্রকাশ করেছিল। মোটকথা প্রত্যেক মুসলমানের হাতে একটি করে ইসলাম বিরোধী বই তারা ধরাতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলমানদের এমন কোন পরিবার নেই যাদের দু’একজন সেযুগে খ্রিস্টানদের খপ্পরে না পড়েছে।

হুযূর (আই.) বলেন, এটি মসীহ্ মওউদ (আ.) যে যুগে দাবী করেছিলেন সেই যুগের চিত্র, বর্তমান যুগে যদিও এ চিত্র কিছুটা বদলেছে, কিন্তু তা মূলত চরমপন্থা ও আহমদীয়াতের বিরোধিতার মাঝেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অতএব ইসলামের প্রচার ও প্রসার প্রকৃতপক্ষে মসীহ্ মওউদ ও তাঁর জামাতের মাধ্যমেই হচ্ছে এবং তাদের মাধ্যমেই হবে।

আগমনকারী মসীহ্ ও মাহদীর জন্য আল্লাহ্ ও রসূল (সা.) কিছু নিদর্শনও উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে একই রমযানে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হওয়া অন্যতম; দাবীকারকের দাবীর পর এই নিদর্শন প্রদর্শিত হওয়া এমন এক বিষয় যা কোন মানুষের জন্য সাধ্যাতীত; এটিকে মিথ্যা বা বানোয়াট বলে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এমনকি আরববাসীরাও এই নিদর্শনকে সত্য বলে স্বীকার করেছে। এই নিদর্শন দাবীকারকের সত্যতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করছে। আবার সূরা তকভীরের বর্ণনা থেকে দেখা যায়, উষ্ট্রী বেকার হয়েছে, বন্যপশুগুলো একত্রিত করা হচ্ছে অর্থাৎ চিড়িয়াখানা বানানো হচ্ছে, সমুদ্রগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে, মানুষজনকে সংযুক্ত করা হয়েছে অর্থাৎ যোগাযোগ মাধ্যমের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, গোটা পৃথিবী আজ বিশ্ব-পল্লিতে রূপ নিয়েছে। জ্যান্ত কবর দেয়া মেয়েদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা যে, কেন তাদের হত্যা করা হল অর্থাৎ নারী অধিকার আন্দোলন- সেটিও হচ্ছে, পুস্তকাদির ব্যাপক প্রচার-প্রসার ইত্যাদি সব নিদর্শনই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে। আবার হাদীসে দাজ্জালের আগমনের স্থান পূর্বদিকে বলা হয়েছে, যা ভারতবর্ষের প্রতি ইঙ্গিত করে; হুজাজুল কিরামা পুস্তকের রচয়িতাও লিখেছেন- দাজ্জালের ফিতনা ভারতে প্রকাশিত হয়েছে। আর এটাও জানা কথা, মসীহ্‌র আগমন সেখানেই হবে, যেখানে দাজ্জালের আগমন হয়েছে। মসীহ্‌র গ্রামের নামও ‘কাদাআহ’ বর্ণিত হয়েছে, যা কাদিয়ানের সংক্ষিপ্তরূপ। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, গোলাম আহমদ কাদিয়ানী- নামটির “আবজাদের মান” একেবারে ১৩০০; এটা প্রমাণ করছে তিনি-ই প্রতিশ্রুত মসীহ্, যার চতুর্দশ শতাব্দীর শিরোভাগে আগমনের ইঙ্গিত আল্লাহ্ তার নামের মাঝেই রেখে দিয়েছেন। এরই সাথে বিভিন্ন ঐশী আযাব বা শাস্তিও নিদর্শন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা দুর্ভিক্ষ, প্লেগ, ভূমিকম্প ইত্যাদির আকারে প্রকাশ পেয়েছে, যার সম্পর্কে মসীহ্ মওউদ (আ.) স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আবার লেখরামের মত বিরোধীর হুবহু ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে নিদর্শনমূলকভাবে নিহত হওয়াও এক অসাধারণত নিদর্শন ছিল। আবার সর্বধর্ম সম্মেলনে তাঁর (আ.) রচিত ‘ইসলামী নীতিদর্শন’ শীর্ষক প্রবন্ধ বিজয়ী হওয়া, যার বিজয়ের সংবাদ আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আগেই প্রদান করা হয়েছিল, যার স্বীকারোক্তি চরম বিরোধী ও ইসলামের শত্রুরাও দিতে বাধ্য হয়েছে- এটিও এক অসাধারণ নিদর্শন ছিল। এছাড়া আরও অজস্র নিদর্শন রয়েছে, যা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.)-এর সত্য মসীহ্ ও মাহদী হওয়ার বিষয়টিকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছে।

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, নিশ্চিত স্মরণ রেখ, খোদার প্রতিশ্রুতি সত্য; তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পৃথিবীতে এক সতর্ককারী প্রেরণ করেছেন। পৃথিবী তাকে গ্রহণ করে নি, কিন্তু খোদা তা’লা তাকে অবশ্যই গ্রহণ করবেন, আর প্রবল পরাক্রমশালী আক্রমণসমূহ দিয়ে তার সত্যতা প্রকাশ করে দিবেন। আমি তোমাদের সত্য সত্যই বলছি, আমি খোদা তা’লার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মসীহ্ মওউদ হিসেবে এসেছি- তোমরা চাইলে গ্রহণ কর, নতুবা প্রত্যাখ্যান কর; কিন্তু তোমাদের প্রত্যাখ্যান করায় কিছুই যায় আসে না, খোদা তা’লা যা ইচ্ছা করেছেন, তা-ই হবে।

হুযূর (আই.) এরপর গত শুক্রবার নিউজিল্যান্ডে মসজিদে মুসল্লীদের ওপর যে ন্যাক্কারজনক ও নৃশংস আক্রমন চালানো হয়েছিল এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। তিনি এই পাশবিক হত্যাযজ্ঞের কারণে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন, আহত ও নিহতদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং তাদের জন্য দোয়া করেন। যারা এই আক্রমণের সময় পরম সাহসিকতার সাথে দুর্বৃত্তকে প্রতিরোধ করেছেন তাদের প্রশংসা করেন ও তাদের জন্য দোয়া করেন। একইসাথে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, প্রশাসনসহ সাধারণ মানুষের ভূয়সী প্রশংসা করেন, যারা এই ঘৃণ্য হামলার প্রতিবাদে সম্মিলিতভাবে ইসলামের প্রতি তাদের ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন এবং করছেন। তাদের কাছ থেকে হুযূর ইসলামী বিশ্বকে শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানান। আর যেসব জঙ্গীগোষ্ঠী এই আক্রমনের প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তাদের নিন্দা করে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে রক্তপাতের ধারা কখনোই থামবে না।

খুতবার শেষদিকে হুযূর (আই.) জামাতের তিনজন নিষ্ঠাবান সেবকের মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে তাদের গায়েবানা জানাযা পড়ানোর ঘোষণা দেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তারা হলেন, কাদিয়ানের মওলানা খুরশীদ আহমদ আনওয়ার সাহেব, ফিজির নায়েবে আমীর মোকাররম তাহের হোসেন মুন্সী সাহেব ও মালীর মোকাররম মূসা সিসকো সাহেব। হুযূর তাদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করেন এবং তাদের আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা করেন আর তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য দোয়া করেন। (আমীন)