সালানা জলসার গুরুত্ব ও কল্যাণ

মাওলানা শাহ মোহাম্মদ নূরুল আমিন

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের সালানা জলসা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের রূপ ধারণ করেছে। এটি একদিকে জামাতে আহ্‌মদীয়ার স্বপক্ষে আল্লাহ্ তা’লার ঐশী সাহায্য ও সমর্থনের চিত্রকে তুলে ধরছে ও আহ্‌মদীয়তের উত্তরোত্তর উন্নতির সূচক জগতকে দেখাচ্ছে। অপরদিকে আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের ব্যবস্থাপনায়ও সালানা জলসার এক অসাধারণ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। এ জলসার ভিত্তি স্বয়ং হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) ঐশী নির্দেশে রেখেছেন। আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাত প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর অর্থাৎ ১৮৮৯ সালের ২৩শে মার্চ জামাত প্রতিষ্ঠিত হয় আর ১৮৯১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর সর্বপ্রথম সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয়। কাদিয়ানের মসজিদে আকসায় অনুষ্ঠিত সে জলসায় ৭৫ জন মহান সৌভাগ্যবান ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। সর্বপ্রথম এ জলসা সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) ১৮৯১ সালের ২২শে ডিসেম্বর হযরত নবাব মুহাম্মদ আলী খান (রাঃ) কে লিখিত এক ঐতিহাসিক চিঠিতে উল্লেখ করেনঃ

“আমি ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৯১ জলসার তারিখ নির্ধারণ করেছি। এতে বিভিন্ন স্থান থেকে নিষ্ঠাবান লোকেরা একত্র হবেন”। (মকতুবাতে আহ্‌মদীয়া, পঞ্চম খন্ড, পৃঃ ৪)

সালানা জলসা শুরুর পর থেকে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮৯১ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১৭টি বছর অতিবাহিত হয়। এর মধ্যে ১৮৯৩, ১৮৯৬ ও ১৯০২ এই তিন বার বিভিন্ন কারণে জলসা মূলতবী হয়। বাকি ১৪বার অনুষ্ঠিত জলসায় স্বয়ং হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) উপস্থিত থেকে জলসাকে অশেষ বরকত ও কল্যাণমন্ডিত করেছেন। নিঃসন্দেহে এ বিষয়টি জলসার গুরুত্বকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে।

এ ছাড়াও এ জলসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে ১৮৯১ সালে ২৭শে ডিসেম্বর এক ইশতেহারে বলেনঃ

“এ জলসাকে সাধারণ মেলার মত মনে করো না। এর ভিত্তি সত্যের প্রতিষ্ঠা ও ইসলামকে অপরাপর ধর্মের উপর বিজয়ের মধ্যে নিহিত রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার মূলভিত্তি প্রস্তর স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলা নিজ হাতে রেখেছেন। আর এজন্য তিনি জাতিসমূহকে প্রস্তুত করে রেখেছেন। তারা এতে এসে শামিল হবে। কেননা, এটা সেই সর্বশক্তিমান সত্তার কর্ম যাঁর কথাকে কেউ টলাতে পারে না”। (মজমুয়ায়ে ইশতিহারাত, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৪১)

হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) জলসার গুরুত্ব বুঝাতে আরও বলেনঃ

“এ জলসার লক্ষ্য ও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের জামাতের সদস্যগণ যেন এভাবে বার বার পরস্পর সাক্ষাতের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে এমন এক পবিত্র পরিবর্তন সাধন করে যাতে তাদের হৃদয় সম্পূর্ণরূপে পরকালের দিকে ঝুঁকে যায়। আর তাদের ধর্মভীরুতা, তাকওয়া, খোদাভীতি, পরহেযগারী, সহানুভূতি, পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রার্তৃত্ববোধে তারা যেন অন্যদের জন্য একটা আদর্শে পরিণত হয়। নম্রতা, বিনয় ও সততা যেন তাদের মাঝে সৃষ্টি হয়। আর ধর্মীয় উৎকর্ষের জন্য তারা যেন পরিশ্রমের রাস্তা বেছে নেয়”। (শাহাদাতুল কুরআন, রূহানী খাযায়েন, খন্ড-৬ পৃঃ ৩৯৪)

“বয়াতের (মসীহ্ মাওউদ আঃ-এর হাতে) ধারাবাহিক বন্ধনের মাঝে প্রবেশ করার পর বয়াতকারী ব্যক্তিকে তাঁর সাথে বার বার সাক্ষাৎ করা উচিত। কোন বয়াতকারী ব্যক্তি যদি বার বার ইমামের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ না রাখে তাহলে তার বয়াত কল্যাণ বিবর্জিত, সারশূন্য ও কেবল একটা রীতি মাত্র। সর্বসাধারণের জন্য প্রকৃতিগত দুর্বলতার কারণে, অথবা সফরের দূরত্বের কারণে এখানে এসে ইমামের সাথে যথেষ্ট সময় থাকার অথবা বছরে একাধিকবার কষ্ট করে এখানে এসে ইমামের সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ হয় না। অধিকাংশ মানুষের অন্তরে এতো বেশি আগ্রহ বা উৎসাহও থাকে না যে, তারা সাক্ষাতের জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করে, অনেক বড় ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করে এখানে আসবে। এসব কারণে বছরে একবার তিনদিনের জন্য এখানে এমন জলসা অনুষ্ঠান করা সমীচীন মনে হয়েছে যাতে জামাতের সব আহ্‌মদী, যারা আন্তরিকতা রাখেন, আল্লাহ্ চাইলে, স্বাস্থ্য ও সুযোগ-সুবিধা যাদের আছে তারা সময়মত নির্ধারিত তারিখে এখানে এসে উপস্থিত হবেন”। (মজমুয়ায়ে ইশতিহারাত, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩০২)

“যতদূর সম্ভব, সাধ্যমত চেষ্টা করে বন্ধুদের কেবল মাত্র আল্লাহ্‌র খাতিরে, তরবিয়তী কথাবার্তা শোনার উদ্দেশ্যে এবং দোয়ায় শামিল হবার জন্য নির্ধারিত তারিখে এখানে চলে আসা উচিত। এ জলসায় এমনসব মূল্যবান সত্যনিষ্ঠ তথ্য ও তত্ত্বজ্ঞানের কথা শুনানো হবে যা আস্থা, ঈমান ও ধর্মীয় ব্যুৎপত্তির জন্য আবশ্যক। এছাড়া এসব বন্ধুর জন্য দোয়াও করা হবে। বিশেষ মনোযোগ সহকারে দোয়া করা হবে। আরহামুর রাহেমীন (সবচেয়ে বড় দয়ালু)-এর দরবারে বিশেষ আকুতি জানানো হবে, আল্লাহ্ যেন নিজের কাছে এদের টেনে নেন এবং নিজ বান্দা হিসেবে এদের কবুল করেন এবং এদের মাঝে পবিত্র পরিবর্তন সাধন করেন। একটি সাময়িক উপকার এটাও তারা লাভ করবেন, প্রতি বছর যেসব নতুন নতুন ভাই জামাতে শামিল হয়েছেন নির্ধারিত তারিখে এখানে এসে তাদের সাথে দেখা করবেন, পরিচিত হবেন এবং পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রার্তৃত্ব বন্ধনে উন্নতি লাভ করবেন।……..এ আধ্যাত্মিক জলসায় আরো অনেক আধ্যাত্মিক উপকার লাভ হবে যা ইনশাআল্লাহুল কাদীর সময়ে সময়ে প্রকাশ পেতে থাকবে”। (ইশতিহার ৩০শে ডিসেম্বর, ১৮৯১ইং, রূহানী খাযায়েন ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৩৫২)

“আমরা কি চাই? মানুষ আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত নয়। আমরা যা চাই, যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তাআলা আমাদের আবির্ভূত করেছেন, তা পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়, যদি মানুষ বারবার এখানে যুগ ইমামের সান্নিধ্যে না আসে। সুতরাং তারা যেন এখানে আসতে কোন বিরক্তিবোধ না করে”। (মলফূযাত, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৫৫)

হযরত আকদস মসীহ্ মাওউদ (আঃ) জলসার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরার সাথে সাথে জলসায় অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়ার এক প্রস্রবণও রেখে গেছেন। তিনি (আঃ) বলছেনঃ

“পরিশেষে আমি দোয়ার সাথে শেষ করছি। যেসব ব্যক্তি এ ঐশী জলসার জন্য সফর করেছেন, খোদা তাআলা তাদের সাথী হোন, তাদের মহান পুরস্কারে ভূষিত করুন। তাদের ওপর করুণা বর্ষণ করুন। তাদের কষ্ট ও দুর্ভাবনার অবস্থা তাদের জন্য সহজসাধ্য করে দিন। প্র��্যেক কষ্ট থেকে তাদের রক্ষা করুন। তাদের আশা-আকাক্সক্ষার দুয়ারসমূহ খুলে দিন। আর পরকালে তাঁর সে সব বান্দাদের সাথে তাদের উত্থিত করুন যাদের ওপরে তাঁর অনুগ্রহরাজ��� ও করুণা ধারা বর্ষিত হয়েছে। আর তাদের শেষ যাত্রার পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত যেন বিদ্যমান থাকে।

হে খোদা, হে মর্যাদাবান খোদা, হে দাতা ও পরম দয়াময় খোদা, হে দুঃখ নিরসনকারী খোদা! এসব দোয়া কবুল কর। আর আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের ওপর আমাদেরকে উজ্জ্বল নিদর্শনের সাথে বিজয় দান করো। কেননা, সর্বশক্তি ও সামর্থ্যরে অধিকারী তুমিই। আমীন, সুম্মা আমীন”! (মজমুয়ায়ে ইশতিহারাত, ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৪২)

ইনশাআল্লাহ্, কিয়ামতকাল পর্যন্ত আমরা এ বরকতমন্ডিত জলসায় অংশগ্রহণ করে হযরত আকদস মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর দোয়ার সুফল লাভ করতে থাকবো। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের এ মহান জলসার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝে এর সুফলসমূহ লাভ করার তৌফীক দান করুন, আমীন।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে জানুয়ারী ২০০৭