বাংলাদেশের সালানা জলসার ইতিহাস


মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাবুল

পাক্ষিক আহ্‌মদী থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলীর ভিত্তিতে এ নিবন্ধ রচিত

হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) কর্তৃক ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে পবিত্রভূমি কাদিয়ানে প্রবর্তিত সালানা জলসা পরবর্তী বছরগুলিতে অব্যাহত থাকে এবং এর ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন দেশে জাতীয় পর্যায়ে এবং স্থানীয় জামাতের উদ্যোগে সালানা জলসা অনুষ্ঠানের সূত্রপাত ঘটে।

১৯১৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়া প্রতিষ্ঠার পর ১৯১৭ সালে বঙ্গদেশে প্রথম সালানা জলসা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক হেডকোয়ার্টার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌলভীপাড়াস্থ মসজিদুল মাহ্‌দী প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত এ জলসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বঙ্গীয় প্রথম আমীর হযরত মাওলানা সৈয়্যদ মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ (রহঃ)। উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিশেষ ভূমিকা রাখেন খান বাহাদুর আবুল হাশেম খান চৌধুরী চতুর্থ বঙ্গীয় প্রাদেশিক আমীর ও জনাব হোসাম উদ্দিন হায়দার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব। পরবর্তী বছরগুলিতে আহ্‌মদীয়াতের প্রচার ও প্রসারের প্রেক্ষিতে জলসার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও সমাগম আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে ২৬-২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত হয় ৬ষ্ঠ সালানা জলসা এবং ১৯২৪ সালের ১০-১১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় ৮ম বার্ষিক জলসা। এ জলসার শেষ দিন মহিলাদের অধিবেশন হয়।

১৯২৬ সালে অনুষ্ঠিত ১০তম জলসায় হযরত হেকিম মোহাম্মদ হোসেন কোরাইশী (রাঃ) ও মাওলানা মালেক গোলাম ফরিদ সাহেবের শুভাগমন হয় কাদিয়ান থেকে।

১৯৩৬ সালের ২৮-৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় ২০তম সালানা জলসা। স্থানীয় অন্নদা হাইস্কুলে বর্ণাঢ্য আয়োজনে তা অনুষ্ঠিত হয়। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রাশাসক ছিলেন নিয়াজ মোহাম্মদ খান। পাঞ্জাবের অধিবাসী। তাঁর স্ত্রী ছিলেন আহ্‌মদী। ১৯৩৬ সালে জামাতের আঙ্গিনার বাইরে অনুষ্ঠিত এ জলসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর মুখরিত হয়ে উঠে। হযরত ইমাম মাহ্‌দী (আঃ) এর আবির্ভাবের শুভ সংবাদ অধিক প্রচারিত হয়। এ জলসায় ৩০০ জন উপস্থিত ছিলেন।

১৪-১৬ অক্টোবর, ১৯৩৭ মসজিদুল মাহ্‌দীতে অনুষ্ঠিত হয় ২১তম সালানা জলসা। কর্মসূচী অনুসারে প্রথম দু’দিন পুরুষের অধিবেশন এবং শেষ দিনে মহিলাদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আঞ্জুমানের আমীর খান বাহাদুর আবুল হাশেম খান চৌধুরী সাহেব এম,এ, বি, টি, এতে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন। বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থান হতে নিমন্ত্রিত মহোদয়গণ উক্ত কনফারেন্সে যোগদান করেছিলেন। এতদ্ব্যতীত প্যালেষ্টাইন ও দামেস্কের ভূতপূর্ব সুযোগ্য মোবাল্লেগ মাওলানা আবুল আ’তা জলন্ধরী সাহেব এ কনফারেন্সে যোগদান করতে কাদিয়ান হতে আগমন করেন। তাঁর আগমনে স্থানীয় আহ্‌মদীগণ, মেহমান ও ডেলিগেট ভাইদের মাঝে অধিকতর উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছিল। স্থানীয় আমীর মৌলবী গোলাম ছামদানী খাদেম সাহেবের তত্ত্বাবধানে আহ্‌মদী ভ্রাতাবৃন্দ আগত মেহমানদের থাকার ও খাবার যথোচিত বন্দোবস্ত করতে যত্নবান ছিলেন। অনবরত বৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও কনফারেন্সের কার্য আশানুরূপ কৃতকার্যতার সাথে সম্পাদিত হয়েছে।

১৯৩৮ সালের ৬-৮ অক্টোবর, ২২তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়। নিখিল বঙ্গ আহ্‌মদীয়া কনফারেন্সের দ্বাবিংশ বার্ষিক জলসা মহাসমারোহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ‘মসজিদুল মাহ্‌দী’ প্রাঙ্গনে উদযাপিত হয়েছে এবং বঙ্গদেশে ২৭-২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯ অনুষ্ঠিত ২৩তম প্রাদেশিক জলসা ছিল খুবই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মসজিদুল মাহ্‌দী প্রাঙ্গনে মহা সমারোহে এ জলসা তথা কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় জুবিলী জলসা হিসেবে। কনফারেন্সে মৌলবী তালেব হোসেন সাহেব মৌলবী ফাজেল, মৌলবী আনিসুর রহমান সাহেব বি-এল, মৌলবী মোজাফফর উদ্দীন চৌধুরী সাহেব বি-এ, মাওলানা মোহাম্মদ সলিম সাহেব মৌলবী ফাজেল, খান সাহেব মৌলবী মোবারক আলী সাহেব বি, এ, বি, টি, মৌলবী দৌলত আহমদ খাঁ খাদেম সাহেব বি, এল, মৌলবী মীর রফিক আলী সাহেব এম, এ, বি, টি, মাওলানা জিল্লুর রহমান সাহেব এবং মৌলবী গোলাম ছামদানী খাদেম সাহেব বি, এল ধর্ম ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সারগর্ভ বক্তৃতা প্রদান করেন।

বঙ্গীয় প্রাদেশিক সালানা জলসা ১৯১৭ সালে শুরুর পর ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৫০ সালে জলসা ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। তাই ১৯৫০ সালে ঢাকার দারুত তবলীগে অনুষ্ঠিত জলসাটি ছিল ৩৪তম সালানা জলসা। বলাবাহুল্য, বঙ্গীয় প্রাদেশিক হেডকোয়ার্টার ১৯৩৬ সালের প্রথম দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় অধিকাংশ জামাত প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে প্রাদেশিক জলসা ও মজলিসে শূরাসহ বৃহৎ কর্মকান্ড ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই অনুষ্ঠিত হতো। দেশের বিভিন্ন স্থানে জামাতের বিস্তার এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী স্থাপনের প্রেক্ষিতে প্রাদেশিক হেডকোয়ার্টার ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।

ঢাকায় প্রাদেশিক জলসা অনুষ্ঠানের ক্রমধারায় ২৪-২৬ অক্টোবর, ১৯৫৮ সালে ৩৯তম এবং ২০-২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৯ সালে ৪০তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়। এ ৪০তম জলসা উপলক্ষ্যে বাংলার মাটিতে শুভাগমন করেন হযরত সাহেবযাদা মির্যা তাহের আহমদ (রাহেঃ)। তিনি পরবর্তীকালে চতুর্থ খিলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত হয়ে বিশ্বব্যাপী আহ্‌মদীয়ত প্রচার ও প্রসারে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সম্ভবত এদেশে এটাই তাঁর প্রথম সফর। তখন তিনি নব প্রতিষ্ঠিত নাযেম ইরশাদ ওয়াকফে জাদীদের দায়িত্ববান হিসেবে পদার্পণ করেন।

১৯-২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬০ সালে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার ৪১তম সালানা জলসা। এ জলসার প্রাক্কালে ৮ ফেব্রুয়ারী রাতে বিমানযোগে ঢাকার মাটিতে অবতরণ করেন বাঙালি আহ্‌মদীদের ভালবাসায় সিক্ত হযরত মির্যা তাহের আহমদ (রাহেঃ)। তখন পূর্ব পাকিস্তান আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার ইন্সপেক্টর ওয়াকফে জাদীদ ও আহমদনগর জামাতের প্রেসিডেন্ট মৌলবী মোহম্মদ সাহেবের আমন্ত্রণে ৯ ফেব্রুয়ারী তাঁর সাথে সম্মানিত অতিথি আহমদনগর যান। ১১-১৩ ফেব্রুয়ারী এ মহান ব্যক্তির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় আহমদনগর জামাতের প্রথম সালানা জলসা।

প্রাদেশিক আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার ৪২তম সালানা জলসা ২১-২৩ এপ্রিল, ১৯৬১ সালে অনুষ্ঠিত হয়। তখন রূপসী বাংলার অপরূপ দৃশ্যে মোহিত এবং বাঙালি আহ্‌মদীদের মায়ামমতায় জড়িত মির্যা তাহের আহমদ সাহেব হৃদয়ের টা��ে ১৭ এপ্রিল, ১৯৬১ তারিখ বিমানযোগে আবার ঢাকার মাটিতে পদার্পণ করেন। ১৯ এপ্রিল আসেন জামাতে আহ্‌মদীয়ার বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আবুল আতা জলন্ধরী সাহেব।

��৪-১৫ এপ্রিল, ১৯৬২ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার ৪৩তম সালানা জলসা। তখন হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রাঃ)-এর নির্দেশে ১০ এপ্রিল, ১৯৬২ তারিখ বিমানযোগে ঢাকা মাটিতে অবতরণ করেন ১। মাওলানা জালাল উদ্দিন শামস, লন্ডন মসজিদের সাবেক ইমাম। ২। মির্যা আব্দুল হক রামা, নাযের বায়তুল মাল ৩। চৌধুরী মঞ্জুর আহমদ বাজুয়া, নাযেম ইসলাহ ও ইরশাদ এবং ৪। হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর বিশিষ্ট সাহাবী মাওলানা কুদরত উল্লাহ্ সানোয়ারী (রাঃ)। ১২ এপ্রিল শুভাগমন করেন ১। ওয়াকফে জাদীদের নাযেম ইরশাদ ও নায়েব সদর বিশ্ব মজলিসে খুদ্দামুল আহ্‌মদীয়া সাহেবযাদা মির্যা তাহের আহমদ সাহেব ২। উকিলে আলা সাহেবযাদা মির্যা মোবারক আহমদ সাহেব এবং ৩। সদর বিশ্ব মজলিসে খুদ্দামুল আহ্‌মদীয়া সৈয়দ মীর দাউদ আহমদ সাহেব।

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রাঃ)-এর নির্দেশে তৎকালীন সদর, সদর আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়া রাবওয়া সাহেবযাদা মির্যা নাসের আহমদ (রাহেঃ)-এর নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ তারিখে বিমানযোগে ঢাকায় শুভাগমন করেন। এ প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন (১) মোহতরম শেখ বশির আহমদ, লাহোর হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি (২) মোহতরম মাওলানা আবুল আতা জলন্ধরী, সম্পাদক, আল ফুরকান ও সাবেক আহ্মদীয়া মুসলিম মিশনারী মিশর ও প্যালেষ্টাইন, ৩। মোহতরম শেখ মোবারক আহমদ, সাবেক আহ্‌মদীয়া মুসলিম মিশনারী আফ্রিকা ৪। মোহতরম চৌধুরী জহুর আহমদ এবং ৫। মোহতরম মাহমুদ আহমদ আনোয়ার হায়দরাবাদী। পূর্ব পাকিস্তান আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার উদ্যোগে ঢাকার দারুত তবলীগে ২৭-২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ তারিখ অনুষ্ঠিত ৪৪তম সালানা জলসার প্রাক্কালে বাংলার মাটিতে সম্মানিত অতিথিদের পদার্পণ হয়। ফলে জলসা সরগরম ও আনন্দ মুখরিত হয়ে ঐশী প্রেমিকদের মিলন মেলায় পরিণত হয়।

১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক জলসা হয়নি। ১৯৬৫ সালের ৫-৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় ৪৫তম সালানা জলসা। এ জলসায় রাবওয়া থেকে আগমন করেন মাওলানা আবুল আতা জলন্ধরী, মাওলানা শেখ মোবারক আহমদ এবং এডভোকেট মির্যা আব্দুল হক সাহেব।

১১-১৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়র ৪৬তম সালানা জলসা। এ মহতী জলসার প্রাক্কালে বাঙালি আহ্‌মদীদের হৃদয়ের পরশমণি মির্যা তাহের আহমদ সাহেব তাঁর সহধর্মীণি ধর্মপ্রাণ মহিলা মোহতারেমা আসেফা বেগম সাহেবাসহ ঢাকায় শুভাগমন করেন। তখন তাঁর সাথে আরো সফর সঙ্গী ছিলেন ১। মাওলানা আবুল আতা জলন্ধরী ২। এডভোকেট মির্যা আব্দুল হক এবং ৩। মাওলানা মোহাম্মদ সাদেক সাহেব। তখন ১১ই ফেব্রুয়ারী বাদ জুমা ঢাকার দারুত তবলীগে কাদিয়ান থেকে আনিত একটি ইটের মাধ্যমে দরুত তবলীগ মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন হযরত সাহেবযাদা মির্যা তাহের আহমদ (রাহেঃ)।

২৪-২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৭ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার ৪৭তম সালানা জলসা। তখন সাহেবযাদা মির্যা তাহের আহমদ (রাহেঃ)-এর পুনরায় বাংলার মাটিতে শুভাগমন হয়।

১৯৬৮ সালের ১৬-১৮ ফেব্রুয়ারী ৪৮তম প্রাদেশিক জলসা অনুষ্ঠিত হয়। রাবওয়া থেকে শুভাগমন করেন মাওলানা সুলতান মাহমুদ আনোয়ার, সদর মুরব্বী এবং নাযের ইশলাহ্ ও ইরশাদ কাযী মোহাম্মদ নাযীর লায়েলপুরী সাহেব।

১৯৬৯ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারী ৪৯তম সালানা জলসার প্রোগ্রাম করা হয়েছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণে তা স্থগিত করা হয়। এরপর ২৭-২৮ ফেব্রুয়ারীও ১ মার্চ, ১৯৭০ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় ৪৯তম জলসা। এ জলসায় রাবওয়া থেকে আগমন করেন মাওলানা সুলতান মাহমুদ আনোয়ার, সদর মুরব্বী ও কাযী মোহাম্মদ নাজির লায়েলপুরী নাযের ইসলাহ ও ইরশাদ।

১২-১৪মার্চ, ১৯৭১ তারিখ ৫০ তম জলসা উদযাপনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণে উদ্ধুত পরিস্থিতিতে এ জলসা অনুষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালেও যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে প্রাদেশিক জলসা করা সম্ভব হয়নি। এরপর ৬-৮ এপ্রিল, ১৯৭৩ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় ৫০তম সালানা জলসা। এটা স্বাধীন বাংলাদেশে আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়া বাংলাদেশের প্রথম সালানা জলসা।

৬-৭ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে ৫১তম, ১৪-১৬ মার্চ, ১৯৭৫ সালে ৫২তম, ৫-৭ মার্চ, ১৯৭৬ সালে ৫৩তম, ৪-৬ মাচর্, ১৯৭৭ সালে ৫৪তম এবং ৩-৫ মার্চ, ১৯৭৮ সালে ৫৫তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৮৮ সাল ছাড়া প্রতি বছর জলসা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ১৯৮৮ সালের ১৮-২০ মার্চ, ৬৫ তম জলসার কর্মসূচী ঘোষণার পর অনিবার্য কারণে তা স্থগিত করা হয়। ১৯৮৯ সালের ৬৫তম জলসা আহ্‌মদীয়তের ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় জলসা। এ বছর আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে জুবিলী উৎসব পালিত হয়। তাই ব্যাপক কর্মসূচীতে ৩১ মার্চ হতে ৩ এপ্রিল, ১৯৮৯ পর্যন্ত ৪দিন ব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপিত হয় শতবার্ষিকী জুবিলী জলসার আনন্দ মুখরিত উৎসব।

১০-১২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ৬৯তম জলসা উপলক্ষ্যে ১২ তারিখ জুমুআর খুতবায় লন্ডন মসজিদ থেকে হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে’ (রাহেঃ) এক মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। জলসায় উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তাঁর নসিহতমূলক বক্তব্য বাঙালি আহ্‌মদীদেরকে আবেগাপ্লুত করে তোলে। এটা এদেশের আহ্‌মদীয়তের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আশির দশক থেকে প্রায় প্রতি বছর খলীফাতুল মসীহের এক বা একাধিক প্রতিনিধি জামাতে আহ্‌মদীয়ার নক্ষত্র বুযূর্গ বাংলার মাটিতে প্রস্ফুটিত রূহানীয়তের বাগানকে ফুলে ফলে সুরভিত করে তুলতে শুভাগমন করেছেন। ১৬-১৮ জানুয়ারী, ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত ৮০তম সালানা জলসায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন, ১। বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, ২। বাংলাদেশ সোসালিষ্ট পার্টির সভাপতি মাঈনউদ্দিন খান বাদল, ৩। বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ৪। সাবেক বিচারপতি ও মানবাধিকার কর্মী বিচারপতি কে এম সোবাহান, ৫। লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ৬। ইউনিভার্সিটি অব ঢাকার ওয়ার্লড রিলিজিয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান কাজী নজরুল ইসলাম ৭। মানবাধিকার কর্মী ব্যারিষ্টার সারা হোসেন ৮। ডঃ ফস্টিনা পেরেরা এবং ৯। এডভোকেট সুলতানা কামাল প্রমুখ।

১০-১২ফেব্রুয়ারী, ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ৮২তম জলসায় জাগ্রত বিবেকের প্রতিধ্বনিতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। ১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক মহাপরিচালক বাংলা একাডেমী ও সাবেক উপাচার্য দারুল এহসান বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ডঃ আনোয়ার হোসেন, ২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ডঃ আরেফিন সিদ্দিকী, ৩। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, ৪। জাসদের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাইনুদ্দিন খান বাদল, ৫। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডঃ সৈয়দ তারিকুজ্জামান এবং ৬। সিপিবি-এর সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান। বিশিষ্ট আইনবিদ ডঃ শাহানা হোসেন জলসায় উপস্থিত হতে পারেন নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণ করেছেন।

বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় অনুষ্ঠিত জলসাকে আল্লাহ্ তা’লা শাহাদতের ঘটনা দ্বারা চিরঞ্জীব করে দিয়েছেনঃ

১৯৬৩ সালের ৩ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত ৪৭তম স্থানীয় জলসা আহ্‌মদীয়তের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তখন স্থানীয় লোকনাথ ট্যাঙ্কের পাড়ে ২-৩ নভেম্বর আঞ্চলিক মজলিসে খোদ্দামুল আহ্‌মদীয়ার দ্বিতীয় বার্ষিক ইজতেমা অনুষ্ঠানের পর ৩ নভেম্বর বাদ মাগরিব শুরু হয় স্থানীয় জলসার কার্যক্রম। এমন সময় বিরুদ্ধবাদীরা প্রচন্ড হামলা চালায়। জলসাগাহে তাদের অন্��ায় আক্রমণের মোকাবেলা করতে দু’জন আশেকে মসীহ শহীদ হন এবং শতাধিক আহত হয়। বঙ্গভূমিতে আহ্‌মদীয়াতের জন্য প্রথম বারের মত শহীদের ঝান্ডা উড়ে। শাহাদতের পিয়ালা পানকারী সেই সৌভাগ্যবানরা হলেন মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানার অধিবাসী শহীদ মোহাম্মদ ওসমান গনি ও তারুয়া জামাতের শহীদ আব্দুর রহীম (রহঃ)।

১৯৬৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জলসা হয়নি। ১৭-১৮ এপ্রিল, ১৯৬৫ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় ৪৮তম জলসা। পরবর্তীতে জলসা উদযাপন অব্যাহত থাকে। ১৯৮৫ সালে ২৬-২৭ এপ্রিল তারিখ অনুষ্ঠিত হয় ৬০তম জলসা। এরপর ২৭ এপ্রিল, ১৯৮৭ আহ্‌মদী পাড়াস্থ জামাতের মসজিদ ‘মসজিদে মোবারক’ বিরুদ্ধবাদীরা জোরপূর্বক দখল করে নেয়। ফলে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে কোন জলসা করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে অনেক বিরহ বেদনা, নিপীড়ন ও যাতনার মাঝে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ)-এর প্রবর্তিত জলসাকে পুনরায় চালু করার লক্ষ্যে বর্তমান নব নির্মিত মসজিদের ক্ষুদ্র পরিসরেই ২০মে, ২০০৬ তারিখ ৬১তম জলসার আয়োজন করা হয়। কিন্তু হায়! বিরুদ্ধবাদীরা বিরোধিতার ঝড় তোলে। একই সময় নিকটবর্তী স্থানে তাদের ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। ফলে উদ্ধুত পরিস্থিতিতে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারী করে। তাই জামাতের পরিকল্পিত জলসা করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের অভিশপ্ত মোল্লাদের প্রভাবে রাবওয়ার জলসা আশির দশক থেকে যেমন বন্ধ রয়েছে অনুরূপ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় জলসাও বিরোধিতার কারণে আশির দশক হতে উদযাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। যেন রাবওয়ার প্রতিচ্ছবি সুষ্টি হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও বড় বড় স্থানীয় জামাতে জলসা অনুষ্ঠিত হয়। অনিবার্য কারণে কোন বছর সম্ভব না হলেও অধিকাংশ বছর উদযাপিত হয়ে আসছে। তাই জলসার ইতিবৃত্ততে দেখা যায় তারুয়া জামাত ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর ১৯২৯ সালে প্রথম জলসা অনুষ্ঠিত হয়। ৩-৪ মার্চ, ১৯৩৯ সালে ৭ম, ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪০ সালে ৮ম, ১৭-১৮ মার্চ, ১৯৬৮ সালে ৩৮তম, ১৯৭৮ সালে ১৯-২০ ফেব্রুয়ারী ৪৪তম, ১৯৭৯ সালে ৪৫তম এবং ২১ফেব্রুয়ারী, ২০০৬ সালে ৬২তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়।

ক্রোড়া জামাতে ২৫-২৬ জুলাই, ১৯৬৯ সালে ১২তম এবং ৩১ মার্চ ২০০৬ সালে ৫৫তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আহমদনগর জামাতে ১১-১৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬০ সালে ১ম, ১০-১১মে, ১৯৬৮ সালে ৮ম এবং ১৪-১৫ এপ্রিল, ২০০৫ সালে ২২তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়।

সুন্দরবন জামাতে ৬-৭ মার্চ, ১৯৬৭ সালে ১ম, ১৯৭৫ সালে ২য়, ১৯৭৬ সালে ৩য়, এবং ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০৫ সালে ২৩ তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়।

চট্টগ্রাম জামাতে ১৭-১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৫ সালে ২৫তম এবং ৩-৪ মার্চ ২০০৬ সালে ২৬তম জলসা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানীয় জামাত ও আঞ্চলিক পর্যায়ে জলসা অনুষ্ঠান অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান বছর ৯-১১ ফেব্রুয়ারী, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ৮৩তম সালানা জলসা আল্লাহ্ তাআলার ফযলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ জলসায়ও যুগ-ইমাম আধ্যাত্মিক জগতের বাদশাহ আমীরুল মুমি’নীন হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই:) জলসার উদ্দেশ্যে এক অমূল্য বাণী প্রেরণ করেছেন। এটা আমাদের জন্য নসিহতমূলক, ঈমানবর্ধক ও জীবন চলার উত্তম পাথেয় ও আশার বাণী। হুযূর আকদসের প্রতিনিধি হিসেবে শুভাগমন করেছেন বাঙালি আহ্‌মদীদের গৌরব ও বাংলাদেশের সুসন্তান অষ্ট্রেলিয়া জামাতের আমীর ও মিশনারী ইনচার্জ মোহতারম মাওলানা মাহমুদ আহমদ সাহেব। তাছাড়া অন্যান্য বছরের ন্যায় কয়েকটি দেশের আমীর সাহেবও শুভেচ্ছা বাণী প্রেরণ করেছেন। ফলে সার্বিক আয়োজনে জলসা ঐশী প্রেমিকদের মিলন মেলায় পরিণত হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ্। এ জলসা সার্থক ও সফল হোক এ কামনা করি।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে জানুয়ারী ২০০৭