পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী হযরত হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ)

মোহাম্মদ হামীদ উল্লাহ্‌ সিকদার

হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ)-এর বাল্যকালেই বই পড়া এবং বই সংগ্রহ করার দিকে গভীর আগ্রহ জন্মে। তিনি বাজে কথা বলা ও শুনা পছন্দ করতেন না। তিনি বার বৎসর বয়সে তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে লাহোর গমন করেন এবং সেখানে অসুস্থ্য হলে পরে হেকীম গোলাম দস্তগীরের চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করেন। তাঁর আচার-ব্যবহারে তিনি অভিভূত হন এবং চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যায়নের মনস্থ করেন। কিন্তু তাঁর বড় ভাই মুন্‌শী মুহাম্মদ কাশ্মীরি নামে একজন ফার্সী শিক্ষকের তত্বাবধানে ফার্সী ভাষা শিক্ষার জন্য তাঁকে পাঠান। ফার্সী শিক্ষক শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন এজন্য শিক্ষার পাশাপাশি শিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও আচার রীতি নীতি সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত হন। তাঁর শিক্ষক তাঁকে খুব আন্তরিকতার সাথে ফার্সী ভাষা শিক্ষা দেন যাতে তিনি ফার্সী ভাষার বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। লাহোরে দুই বছর অবস্থানের পর নিজ গ্রাম ভেরাতে প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর তাঁর বড় ভাই মৌলভী সুলতান আহমদ তাঁকে আরবী ভাষা শিক্ষা দান করেন। ১৮৫৭ সালের এক পুস্তক ব্যবসায়ী এবং তাঁর পিতার বন্ধু তাঁকে কুরআন মজীদের তরজমা শিখার জন্য অনুরোধ করেন এবং একটি ছাপানো কুরআন মজীদ উপহার দেন যাতে পাঁচটি বিশেষ অধ্যায় এবং তার উর্দ্দু তরজমা ছিল। এটাই তাঁর পরবর্তী জীবনের আল্লাহ্‌ প্রদত্ত আশির্বাদ হিসাবে দেখা দেয়। ঐ পুস্তক ব্যবসায়ী তাঁকে “তাকভিয়াতুল-ঈমান” এবং “মাশারীকূল আন্‌ওয়ার” নামে কুরআন মজীদের দুইটি আংশিক তফ্‌সীর পড়ার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি মনোযোগ সহকারে সম্পূর্ণ পুস্তক দুটি পাঠ করেন এবং এই ঘটনাই তাঁর কুরআন মজীদের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসার ভিত্তিস্বরূপ, যা তাঁর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

১৮৫৭ সালে সতের বৎসর বয়সে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিনি রাওয়াল পিন্ডিতে গমন করেন এবং একুশ বৎসর বয়সে ডিপ্লোমা লাভ করেন ও একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি চার বৎসর পর্যন্ত ঐ পদে নিয়োজিত ছিলেন।

হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ) তৎকালীন বিখ্যাত হেকীম লঁক্ষ্ণৌর অধিবাসী জনাব আলী হোসেন সাহেবের কাছে শিক্ষা লাভ করেন এবং নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং জ্ঞানের দ্বারা চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হন। একদিন তিনি হেকিম সাহেবেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “জ্ঞানের দ্বারা কি লাভ হয়?” জবাবে হেকীম সাহেব বললেন, “জ্ঞান দ্বারা মানুষের নৈতিকতা সাধিত হয়।” তিনি সেখানে মুফ্‌তী সাদুল্লার কাছে “মুতানাব্বী” পাঠ করেন। এর কিছু কাল পর তিনি মক্কা শরীফে গমন করেন এবং সেখানে তিন জন অসাধারণ জ্ঞানী লোকের সান্নিধ্যে ছিলেন। শেখ মুহাম্মদ খাজ্‌ রাজীর কাছে হাদীস আবু দাউদ শরীফ, সৈয়দ হোসেন এর কাছে হাদীস মুসলিম শরীফ এবং মৌলভী রহমতুল্লার কাছে মুয়াত্তা-শরীফ পাঠ করেন। তাঁরা তিনজনই সেই সময়ের মক্কা শরীফের বিখ্যাত আলেম ছিলেন।

কাশ্মীরের মহারাজার চিকিৎসক হেকীম ফিদা মুহাম্মদ খান অবসরে যাওয়ার পর মৌলানা নুরুদ্দীন প্রধান চিকিৎসক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইতিমধ্যে চিকিৎসক হিসেবে এবং জ্ঞানী লোক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে তিনি বহু আধ্যাত্মিকতা-সম্পন্ন জ্ঞানী লোকের সান্নিধ্যে আসেন এবং লক্ষ্য করেন যে ইসলাম ধর্মের বিরোধীদের ব্যাপারে তাঁদের কোন রকম মাথা ব্যথা নাই। ইসলামের সুরক্ষার জন্য এবং অন্যান্য ধর্ম থেকে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের কোন উদ্যোগ ছিল না। এহেন অবস্থায় তিনি আরবী ভাষার একটি ছোট পুস্তক রচনা করেন যার মূল বক্তব্য ছিল যে, “আল্লাহ্‌ তাআলা এমন কাউকে দাঁড় করান যিনি ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করবেন ও ইসলাম ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এমন এক আধ্যাত্মিক বিস্ফোরন ঘটাবেন যাতে মন্দ লোক এবং ইসলামের শত্রুগণ বিনাশ হবে।” এই উদ্দেশ্যে তিনি পবিত্র মক্কা ও মদীনা শরীফে গিয়েছেন, দূর-দূরান্ত পরিভ্রমণ করেছেন, অনেক জঙ্গল ও মরুভূমি অতিক্রম করেছেন, বহু ধার্মিক ও জ্ঞানী ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছেন। কিন্তু ইসলামের শত্রুদের মোকাবিলায় দাঁড়াবার মত যোগ্য কোন ব্যক্তিকে পান নি। এমন লোক কাউকেও পাওয়া যায়নি যে, ইসলামের সত্যিকার বাণী খৃষ্টান, আর্য্য, ব্রাহ্ম্য, দার্শনিক, নাস্তিক এবং ইসলাম বিরোধী অন্যান্যদের কাছে পৌঁছায়। পক্ষান্তরে তৎকালীন সময়ে ভারতের দশ লক্ষের মত মুসলিম ছাত্র ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দিয়ে পশ্চিমা-শিক্ষার দিকে অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং অমুসলিমদের সাহচর্যের প্রতি বেশী আকৃষ্ট হয়। প্রায় ছয় কোটির অধিক ইসলাম বিরোধী বই পুস্তক, বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়েছিল। এই সময় তিনি আল্লাহ্‌ প্রেরিত লোকের ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন।

হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ) কুরআন, হাদীস, ফিকাহ্‌ শাস্ত্র, দর্শন ইত্যাদি ছাড়াও অন্যান্য ধর্ম ও আকিদা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রাখতেন। কাশ্মীরে থাকাকালীন তিনি নিয়মিত কুরআন মজীদ এবং হাদীসের দরস দিতেন এবং মুসলিম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এতে যোগদান করত। এটা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলত। হেকীম সাহেব ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন আকর্ষণীয় দিকগুলি তুলে ধরতেন আর উপস্থিত ব্যক্তিরা বিস্ময়ের সাথে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা অনুভব করতেন, এ রকম এক সভায় এক নাস্তিক বললো,

“অতীতের মানুষ ততোটা জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন ছিল না, তাই অতীতের নবীরা মানুষের এই দূর্বলতা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন এবং মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছেন যে আল্লাহ্‌ মানুষের সাথে কথা বলেন। বর্তমানে মানুষ বেশী শিক্ষিত এবং এই চালাকী ধরে ফেলেছে তাই বর্তমানে এই রকম দাবী করার লোক নাই যে আল্লাহ্‌ তার সাথে কথা বলেন।”

এই মন্তব্যের পর সে প্রস্থান করল এই ভেবে যে হেকীম সাহেবের কোনো জওয়াব নাই। এমন সময়েই তাঁর হাতে একটি বিজ্ঞাপন এসে পৌঁছলো, বিজ্ঞাপনের লেখক দাবী করেছেন তিনিই সেই ব্যক্তি যার সঙ্গে বর্তমান যুগে আল্লাহ্‌ তাআলা কথা বলেন। এটা ছাড়াও ইসলামের সত্যতা প্রমাণের জন্য এবং এই বিষয়ক যে কোন সন্দেহ দূর করবার জন্যও তিনি (দাবীকারক) প্রস্তুত। যে ঐশী-আলোর জন্য তিনি সারা জীবন অপেক্ষা করছিলেন তা তিনি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পেয়ে গেলেন। নাস্তিককে ডেকে তিনি বল���েন,

“দেখ জ্ঞান বিজ্ঞানের এই যুগে এই তো একজন যিনি দাবী করেছেন আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে কথা বলেন। আর দাবীর সত্যতা পরীক্ষার জন্য যে কেউ এক বছর তাঁর সাথে বসবা�� ��রুক। উক্ত সময়ে সেই ব্যক্তি অবশ্যই কোন না কোন ঐশী নিদর্শন দেখতে পাবে। এর অন্যথা হলে দাবীকারক ক্ষতিপূরণ দিবেন”।

হেকীম সাহেব নাস্তিককে বললেন সে যদি যথার্থই সত্যন্বেষী হয়ে থাকে তা হলে তার উচিত হেকীম সাহেবের সাথে কাদিয়ান যাওয়া। যা হোক নাস্তিক রাজী হলেন না। হেকীম সাহেব ১৮৮৫ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কাদিয়ান রওয়ানা হলেন। তখন তার বয়স ৪৩ বৎসর ছিল।

১৮৮৯ সালের ২৩ মার্চ তারিখে লুধিয়ানায় মুন্‌শী আহমদ জান (রাঃ) সাহেবের বাড়ীতে সর্বপ্রথম বয়আত গ্রহণ আরম্ভ হয়। ৩১৩ জন বয়আতকারীর মধ্যে হযরত হাজীউল হারামাঈন, শরীফাঈন হাফেজ হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ) বয়’আত গ্রহণ করেন হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পবিত্র হস্তে।

১৮৮৬ সালে লাহোরে বিভিন্ন ধর্মের উপর যে ঐতিহাসিক জলসা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এর ছয় জন মডারেটরের মধ্যে হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ)ও একজন ছিলেন। ঐ জলসায় তিনি দুইবার বক্তব্য রাখেন যাতে তিনি কলেমা শাহাদত ও সূরাতুন নাস এর আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা দান করেন।

সর্বাপেক্ষা বড় বিষয় হলো তিনি হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পবিত্র হস্তে সর্বপ্রথম বয়আত গ্রহণ করেন এবং খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল হওয়ার সম্মান অর্জন করেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর জ্ঞানার্জনের অদম্য আগ্রহ ছিল এবং বিশাল একটা লাইব্রেরী ছিল। বহু দুষ্প্রাপ্য বই এবং বইয়ের পান্ডুলিপিও ছিল। সেগুলি তিনি দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি তাঁর এক শিষ্য গোলাম নবীকে ভূপালের নবাব সিদ্দীক হাসান খান এর পুত্র নূরুল করীম খানের কাছে প্রেরণ করেন। নূরুল করীম খানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে “শওকানী’র একটি ধারা ভাষ্য ছিল যা ছয় খন্ডে সমাপ্ত। তা জনাব গোলাম নবী এক বৎসরে কপি করে আনেন। এই কাজ শেষ হবার পরে তাঁকে ইমাম ইবনে কাইয়াম এর পুস্তক “শিফাউল আলিল্‌ কি মাছাইলিল্‌ কাজেই ওয়াল্‌ কদর ওয়াত্তালিল্‌” পুস্তকটি হাতে কপি করার জন্য মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন, যা আটশত পৃষ্ঠার ছিল এবং তা কপি করে আনতে আঠারো মাস লেগেছিল।

হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল (রাঃ) বলেছেন, তিনি বহু চেষ্টা করেও একটি পাপ থেকে মুক্ত হতে পারছিলেন না। তা হল জ্ঞানের অহঙ্কার। কিন্তু হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের পর তার সেই অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে গেছে। তাঁর জীবনের প্রসিদ্ধ দিক ছিল আল্লাহ্‌ তাআলার সাথে গভীর সম্পর্ক, ভালবাসা এবং ভরসা। তার যৌবনের শুরুতেই ঐশী তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয়েছিল আর এই কারণেই তিনি খোদার হয়ে গিয়েছিলেন।

আহ্‌মদীয়া জামাআতের প্রথম খলীফা হওয়ার পরও তিনি (রাঃ) কুরআন শরীফের জ্ঞান-ভান্ডার বিতরণের কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি বলেছেন,

“স্মরণ রেখো! যতক্ষণ পর্যন্ত কুরআনের উপর আমল না হবে এ দুর্ভোগ ও পতন যা মুসলমানদের চিরসঙ্গী হয়েছে তা কখনো দূর হবে না। কিন্তু কুরআনের উপর আমল করবার জন্য কুরআনের তত্ত্ব বা মূল বিষয়ে জ্ঞান থাকা দরকার। এই তত্ত্বজ্ঞান তাক্‌ওয়া ব্যতীত আসতে পারে না এবং মুজাহিদ না হলে তাক্‌ওয়াশীল হওয়া যায় না।”

কুরআন, হাদীস ও চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর ছাত্র ছিল হাজারের ওপর। ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ সানী (রাঃ)। তাঁকে তিনি যত্ন সহকারে কুরআনের তরজমা, হাদীস বোখারী শরীফ ও মাওলানা রুমীর মসনবী শরীফ পড়াতেন।

তাঁর খিলাফতকালীন সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম ছিল,

১। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রখ্যাত মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ সাহেব সেলসেলা আলীয়া আহ্‌মদীয়াতে দাখিল হওয়া এবং তাঁর সান্নিধ্যে শত শত লোক বয়আত গ্রহণ। তৎকালীন সময়ে এদেশে তাঁর সমকক্ষ কোনো মাওলানা ছিল না।

২। লন্ডনে একটি ইসলামী মিশন প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এইজন্য খাজা কামালউদ্দিন এবং চৌধুরী ফতেহ্‌ মোহাম্মদ সাহেব লন্ডন গমন করেন।

৩। বৃটিশ সাম্রাজ্যের মহামান্য সম্রাট পঞ্চতম জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠান ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর তারিখে দিল্লীতে অনুষ্ঠানের ঘোষণা করা হলে উক্ত অনুষ্ঠানে হযরত হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ) ভারতের গভর্ণর জেনারেলের মাধ্যমে সম্রাট পঞ্চম জর্জের নিকট শুক্রবার জুমুআর নামায এবং খুতবা শুনার জন্য চাকুরীজীবি ও ছাত্রদের দুই ঘন্টা ছুটির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা যেতে পারে। সেই মোতাবেক তিনি একখানা স্মারকলিপি তৈরী করেন। অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের মাধ্যমে তা পেশ করা হলে সরকার তা মেনে নেন।

১৯১৪ সালের জানুয়ারীর প্রথম হতে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। পাঁজরে ব্যাথা, বমির ভাব এবং মাঝে মাঝে সামান্য জ্বর। শরীর দুর্বল ছিল। কিন্তু তিনি সব সময় হাসি খুশী থাকতেন এবং কুরআন মজীদের শিক্ষা দানে ব্যাপৃত ছিলেন। পরে শরীর এতই দূর্বল হল যে তিনি মসজিদে আকসায় যেতে না পারায় মাদ্রাসার আঙ্গিনায় কুরআন ক্লাশ চালু রেখেছিলেন এবং পরে তাঁর বড় ছেলের বাসার একটি কক্ষে ক্লাস নেওয়া চালু করলেন। যা তাঁর বাসার কাছেই ছিল। তিনি বসেই কাজ চালাচ্ছিলেন, ডাক্তার নিষেধ করলে তিনি বললেন যতক্ষণ কথা বলতে পারেন ততক্ষণ তিনি আল্লাহ্‌র বাণী শিক্ষা দিতে থাকবেন। সন্দেহ করা হচ্ছিল তিনি ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছেন। লাহোর হতে ডাক্তার কর্নেল মেল ভাইল,ডাক্তার সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন তারা খলীফাতুল মসীহ্‌কে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেন। এতে তিনি বলেন আমি যে রোগে আক্রান্ত তা নির্ণয় করা এতই সহজ যে আমি যখন চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলাম কেউ ক্লিনিকের দরজায় দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ জানালে আমি তার আওয়াজ শুনে না দেখে সনাক্ত করতে পারতাম সে কোন রোগে ভুগছে ।

হযরত খলীফাতুল মসীহ আওওয়াল (রাঃ) ১৯১৪ সালের ৪ মার্চ শেষ ওসীয়্যত নিজ হাতে লিখলেন।

“মহান আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি যিনি অযাচিত-অসীম দাতা, পরম দয়াময়। আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন মাবুদ নাই; মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর প্রেরিত পুরষ। আমার সন্তানরা ছোট এবং আমার কোন অর্থ নাই। আল্লাহ্‌ই তাদের হেফাযত করবেন। এতীম ও গরীবদের জন্য রক্ষিত ফান্ড হতে যেন তাদের জন্য খরচ করা না হয়। সক্ষম ব্যক্তিরা প্রয়োজনে ধার দিতে পারেন। আমার সম্পত্তি এবং পুস্তকাদিসমূহ সন্তানদের উপকারের জন্য ট্রাষ্টের আওতায় নেওয়া যেতে পারে। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের শিক্ষাদান চালু থাকবে। ওয়াসসালাম। নুরুদ্দীন ৪/৩/১৯১৪

তাঁর ইন্তেকালের পর ভারতের প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। তন্মধ্যে প্রধান দুইটি পত্রিকার খবর সংক্ষেপে উল্ল্যেখ করা হল,

(১) “জমিদার” পত্রিকায় লেখা হয়েছিলঃ

“এই মৃত্যু সংবাদে সমস্ত মুসলমান বিশেষ করে আহ্‌মদীগণ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়েছেন। মৌলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) অত্যন্ত জ্ঞানী, শিক্ষিত এবং পন্ডিত শ্রেণীর ধর্মোপদেষ্টা ছিলেন। আমরা আল্লাহ্‌ তাআলার কাছ থেকে এসেছি এবং তাঁর কাছেই ফেরত যাব। মতবাদের দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মৌলানা নূরুদ্দীন এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞানী ছিলেন যে সমস্ত মুসলিম তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত। এমন অসাধারণ প্রতিভা শত বর্ষেও জন্মায় না।

এই মহান ধর্মোপদেষ্টার মৃত্যুতে যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার জন্য আমরা শোক প্রকাশ করছি। আমরা সকল আহ্‌মদী এবং মৌলানা নূরুদ্দীনের (রাঃ) পরিবারের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করছি এবং দোয়া করি আল্লাহ্‌ তাআলা যেন তাঁদের এই মর্মান্তিক শোক সইবার তৌফিক দান করেন।”

(২) “কার্জন গেজেট” পত্রিকার সম্পাদক সাহেব লিখেছেনঃ

“আমরা মৌলবী নূরুদ্দীন সাহেবকে যে কেবল ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম তা নয়। তাঁর সাথে জম্মুতে আমাদের কয়েক বৎসর যাবত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও ছিল। প্রতি সন্ধ্���ায় আমরা একত্র হতাম। তিনি উত্তম হৃদয়ের পরোপকারী মানুষ ছিলেন। তিনি তীক্ষ্ণ রস বোধসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি লম্বা সুন্দর দেহাবয়ব ও ঘনদাঁড়ি বিশিষ্ট ছিলেন। রাজ্যের সকল স্কুল ও হাসপাতালগুলি পরিশ্রম ও সততার সাথে তত্ত্বাবধান করতেন। তিনি উচ্চ বেতন পেতেন যার অধিকাংশই দরিদ্র ছাত্রদের মধ্যে ব্যয় করতেন। এভাবে তিনি আজীবন শত শত মানুষের জন্য অর্থ ব্যয় করেছেন। কাশ্মীরি এক ব্রাহ্মণ যূবা তাঁর তবলীগে মুসলমান হন যার নাম শেখ আব্দুল্লাহ্‌। আলীগড়ে এডভোকেট হিসাবে প্র্যাকটিস শুরু হওয়া পর্যন্ত তাঁর লেখা পড়া সহ যাবতীয় খরচ তিনি বহন করেন। পরবর্তী সময়ে এই শেখ আব্দুল্লাহ্‌ আলীগড়ে মহিলাদের জন্য “খাতুন” নামে একটি পত্রিকা বের করেন যা মহিলাদের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।

খলীফা হযরত নূরুদ্দীন (রাঃ)-এর দুইটি বিষয়ে গভীর আগ্রহ ছিল, ১। দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য ও সহযোগিতা ও ২। দুষ্প্রাপ্য পুস্তকাদি সংগ্রহ করা। তাঁর আয়ের মোট অংশ এই দুই কাজেই ব্যয় হত। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, ন্যায়-পরায়ণ এবং দায়িত্ব-জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর অধীনস্তগণ তাঁর প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন। তিনি আরবী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন এবং অবসর সময় বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের দরস দিতেন।

সেই সময়ে ভারতের বিখ্যাত পন্ডিত, রাজনীতিবিদ কংগ্রেসের এক সময়ের সভাপতি এবং পরবর্তীতে ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ “আল্‌-বালাগ্‌” পত্রিকার ‘বিদায় নূরুদ্দীন’ শিরোনামে লিখেছেন,

“আহ্‌মদীয়া জামাআতের প্রধান মাওলানা নূরুদ্দীনের মৃত্যুতে আমরা শোক জানাচ্ছি। তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি এবং বহুবিধ বিষয়ে বিশাল বাস্তব-অভিজ্ঞতা ও ধার্মিকতার সমন্বয়ের এক বিশাল ভান্ডার ছিলেন।

তাঁর জীবনের পরবর্তী অংশ তিনি আহ্‌মদীয়াতের জন্য উৎসর্গ করেন। আধ্যাত্মিকতার চরম উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে দিবারাত্র অক্লান্তভাবে পরিশ্রম করতেন। তাঁর অনুসারীদের তুলনা কেবল প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল। মুসলমানদের প্রচলিত বিশ্বাস হযরত ঈসা (আঃ) স্ব-শরীরে বেহেশ্‌তে বিদ্যমান রয়েছেন। মসীহ্‌ এবং মাহদী ভিন্ন লোক। ঈসা (আঃ) স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন এবং মসীহ্‌ ও মাহদী একই ব্যক্তি এই বিশ্বাস পোষণ করায় ভারতীয় আলেম সমাজ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং এর প্রতিক্রিয়া ভয়ঙ্কর ঝড় এবং বজ্রপাত সাদৃশ্য ছিল। মাওলানা নূরুদ্দীনকে এই ঝড় তাঁর বিশ্বাস হতে একটুও টলাতে পারেনি। তিনি পর্বতের ন্যায় অটল ছিলেন এবং তা মৃত্যু পর্যন্ত বলবৎ ছিল। আমি তাঁর ভিতর এক আশ্চর্যজনক তীব্র আলো দেখতে পেয়েছি যা আমার হৃদয়ের জমাট বাঁধা ভাবাবেগকে ভালবাসার অশ্রুতে রূপান্তরিত করেছে।

এই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব আজ আমাদের চক্ষুর অন্তরালে কিন্তু তাঁর অনুসরণ আমাদেরকে সত্যের পথে দৃঢ়তা দান করবে। আল্লাহ্‌ তাআলার অশেষ কৃপা আম্বরের-সুগন্ধি দ্বারা তাঁর কবর ঢেকে দিন। আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে তাঁর সন্তুষ্টির বাগিচায় সর্বোচ্চ ভবনে স্থান দিন, আমীন।”

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে, ২০০৮ইং