হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)

খিলাফত কাল: ৬৩৪-৬৪৪ খ্রীস্টাব্দ

তাঁর ব্যক্তিগত নাম ছিল ‘উমর’, ‘ফারুক’ তাঁর উপাধি এবং ইব্‌ন আল খাত্তাব তাঁর পারিবারিক নাম। তিনি ৫৮১ খ্রীস্টাব্দে মক্কায় কুরাইশদের এক উচ্চ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তিনি সিরিয়া ও ইরাকে বাণিজ্য প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিতেন।

যখন হযরত মোহাম্মদ (সা.) তাঁর নবুয়তের দাবী ঘোষণা করলেন, হযরত উমর বিন খাত্তাব ইসলামের একজন কট্টর প্রতিপক্ষ হয়ে গেলেন। তিনি বিরোধিতায় এমন পর্যায়ে পৌঁছলেন যে, একদিন তলোয়ার হাতে মহানবী (সা.) কে হত্যা করার জন্য ঘর থেকে বের হলেন; পথিমধ্যে কেউ তাঁকে অবগত করাল যে, তাঁকে প্রথমে নিজ ভগ্নি ও ভগ্নিপতির সাথে সুরাহা করা উচিত, কেননা তারা ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি সরাসরি তাদের নিকট গেলেন এবং দরজার কড়া নাড়েন, তিনি ঘরের ভিতর থেকে পবিত্র কুরাআনের তেলাওয়াত শুনতে পাচ্ছিলেন। এতে তার রাগ আরো বেড়ে যায় এবং তিনি তার ভগ্নিপতিকে প্রহার করতে শুরু করেন এবং তার ভগ্নিকে আহত করেন, যে তার স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা করছিল। তার ভগ্নি তাকে দৃঢ়স্বরে বলল, “উমর ! আপনি আমাদের যত খুশি প্রহার করতে পারেন কিন্তু আমরা আমাদের বিশ্বাসকে কখনো পরিত্যাগ করছি না”। একথায় তিনি শান্ত হলেন এবং তাদেরকে কুরআনের কিছু অংশ পড়ে শুনাতে বললেন। তিনি কুরআনের আয়াত শুনে এতই বিচলিত হলেন যে তাঁর চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। তিনি সোজা মহানবী (সা.)-এর নিকট গেলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। যেহেতু তিনি মক্কার একজন বলবান, ভীতিহীন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন, সেহেতু তিনি মুসলমানদের জন্য উদ্যমের উৎস প্রতিপন্ন হলেন। হযরত উমরের এই অলৌকিক পরিবর্তন বস্তুত হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দোয়ার ফলশ্রুতি ছিলো।

হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর দ্বিতীয় খলীফা ছিলেন। তার খিলাফতকালে, মুসলমানদেরকে ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরের বিরূদ্ধে অনেক গুলো যুদ্ধ করতে হয়। যার ফলশ্রুতিতে এসব দেশের ব্যাপক এলাকা মুসলিম শাসনাধীনে চলে আসে। যখন ১৭হিজরীতে মুসলমানদের দ্বারা জেরূযালেম বিজিত হলো, তখন রোমানদের অনুরোধে তিনি সেই শহর পরিদর্শন করেন এবং মুসলমান ও জেরূযালেমের অধিবাসীদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। হযরত উমর (রা.) ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য এক চমৎকার প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান কিছু কৃতিত্ব হলো:

মজলিশে শূরা প্রতিষ্ঠা, যা খলীফাকে পরামর্শ দানকারী একটি মন্ত্রণা পরিষদ।

পুরো ইসলামী রাষ্ট্রকে প্রশাসনের সুবিধার্থে প্রদেশে বিভক্তিকরণ।

অর্থ বিভাগের প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে স্কুল এবং মসজিদ নির্মাণ।

ইসলামী হিজরী বর্ষপঞ্জীর প্রতিষ্ঠা।

হযরত উমর (রা.) তাঁর অধীনস্থ লোকদের মঙ্গলচিন্তায় এতটা উদ্বিগ্ন থাকতেন যে, তিনি রাতে ছদ্মবেশে মদীনা শহরে বেরিয়ে পড়তেন, নিজ চোখে এটা দেখার জন্য যে কার কোন সাহায্যের প্রয়োজন কিনা। একদা, রাতে প্রদক্ষিণের সময়, তিনি লক্ষ্য করলেন এক মহিলা একটি পাত্রে কিছু পাকাচ্ছিলেন যখন তার বাচ্চারা তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদ ছিল। তিনি মহিলা থেকে জানতে পারলেন যে, বাচ্চারা দু’দিন যাবত ক্ষুধার্ত র‌য়েছে এবং পাত্র আগুনের উপড় রাখা হয়েছে কেবল তাদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য। তিনি তৎক্ষণাৎ রাষ্ট্রীয় খাঞ্চাজিখানা/ ধনাগারে চলে যান এবং নিজে স্বয়ং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য বহন করে নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে, তাঁর একজন ভৃত্য তাঁর নিকট থেকে সেই বোঝা নিতে চাইলে তিনি তাকে বাধা দিয়ে বলেন: “বিচারের দিনে তো তুমি আমার বোঝা বহন করতে পারবে না।”

মহিলাটি, যে পূর্বে হযরত উমর (রা.) কে দেখেনি, এতই সন্তুষ্ট হলেন যে, তিনি উচ্চস্বরে এই বলে তাঁর জন্য দোয়া করেন, “আল্লাহ্‌ তা’লা উমরের পরিবর্তে আপনাকে খলীফা বানান”। এই কথা শুনে হযরত উমর (রা.) কাদঁতে শুরু করেন এবং কিছু না বলে সে স্থান ত্যাগ করেন।

৬৪৪ খ্রীস্টাব্দে, হযরত উমর (রা.) মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় এক পার্শী ভৃত্য দ্বারা ছুরিকাহত হন। এটা মারাত্নক প্রতিপন্ন হয় এবং এভাবে তিনি ৬৩ বছর বয়সে ২৬শে জুলহাজ্জ্ব, ২৩শে হিজরী সালে পরলোক গমন করেন।

তিনি প্রকৃতই একজন মহান খলীফা ছিলেন, তাঁর খিলাফতকাল নিঃসন্দেহে ইসলামের ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়।

তিনি সেই দশজন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সা.) যাঁদের বেহেস্‌তের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।

মূল ঊর্দু: মজিদ আ. মিয়া

বাংলা অনুবাদ: মুহাম্মদ সেলিম খান

প্রবন্ধ

জুমুআর খুতবা