হযরত মির্যা তাহের আহমদ – খলীফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রাহে.)

খিলাফত কাল: ১০ই জুন ১৯৮২ইং – ১৯শে এপ্রিল ২০০৩ইং

আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিশ্রুত মসীহ্ হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আঃ)-এর প্রতিশ্রুত পুত্র হযরত মির্যা বশিরুদ্দিন মাহমুদ আহমদ, খলিফাতুল মসীহ্‌ সানী এবং মুসলেহ মাওউদ (রাঃ), ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯২৪ সালে হযরত সৈয়্যেদা মরিয়ম বেগম সাহেবার সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি হযরত ডাঃ আব্দুল সাত্তার শাহ এর কন্যা, যারা অভিজাত সৈয়দ পরিবারের সদস্য ছিলেন। তাঁর বিবাহের খুতবায় হযরত সৈয়দ সারোয়ার শাহ সাহেব, হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর একজন বিশিষ্ট সাহাবী, বলেনঃ

“আমি এখন বয়সের অন্তিম কালে উপনিত এবং খুব শীঘ্র দুনিয়া থেকে চলে যাব; কিন্তু যারা বেঁচে থাকবে তাঁরা সাক্ষ্য দিবে যে এই সৈয়্যেদার সাথে সম্পাদিত এ বিবাহ বন্ধনের ফলশ্রুতিতে এমন ধর্মসেবকের জন্ম হবে যেমনটি পূর্বেও হয়েছিল। এটি আমার দৃঢ় প্রত্যয়”।

আর এভাবেই সেই ধর্মসেবকের জন্ম হয় ১৮ই ডিসেম্বর ১৯২৮সালে। তিনি তাঁর বরেণ্য পিতার এবং ধার্মিকা মাতার দিকনির্দেশনায় এবং ঐশী অনুগ্রহে একজন ধর্মপরায়ণ এবং সাধু ব্যক্তি রূপে বয়ঃপ্রাপ্ত হন। একদা, তাঁর শৈশবে, তিনি স্বনামখ্যাত আহ্‌মদী পণ্ডিত মাওলানা আব্দুর রহীম নাইয়ার কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হন,

“তুমি ভাল কাজের বিনিময়ে কোন পুরস্কারটির সবচেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষা করো?”

“আল্লাহ্‌, কেবলই আল্লাহ্‌।”

এই ছিল দশ বছর বয়সের বালকের স্বতঃস্ফুর্ত জবাব।

এই আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিত্বের নাম রাখা হয় মির্যা তাহের আহমদ। তাঁর বিদ্যার্জনের বিশাল পরিধি সমভাবে আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব ব্যাপক বিষয়ে বিস্তৃত ছিল। তিনি গ্র্যাজুয়েশনের পর “জামেয়া আহ্‌মদীয়া”,রাবওয়া থেকে ‘শাহিদ’ ডিগ্রী লাভ করেন। অতঃপর ইউরোপে আড়াই বছর উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন।

উচ্চ শিক্ষা লাভ করার পর তিনি ধর্মের সেবার লক্ষ্যে নিজ জীবন উৎসর্গ করেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর এ তাঁকে ‘ওয়াকফে জাদীদের’ দায়িত্বভার দেওয়া হয়, বিভাগটি সর্বোচ্চ নৈতিক গুণাবলীর বিস্তার এবং আহ্‌মদীদের আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যে কাজ করে।

১৯৬০-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মজলিস খোদ্দামুল আহ্‌মদীয়ার নায়েব সদর (ভাইস প্রেসিডেন্ট) এবং সদর (প্রেসিডেন্ট) ছিলেন, সেই পদে থাকা কালীন তিনি উল্ল্যেখযোগ্য নেতৃত্বের গুণাবলী প্রদর্শন করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি মজলিস আনসারুল্লাহ্‌র সদর ছিলেন। হযরত খলিফাতুল মসীহ্ সালেসের সময়কালে তিনি ফযলে উমর ফাউন্ডেশনের পরিচালক ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক আহ্‌মদীয়া স্থপতি এবং প্রকৌশলী সংস্থার (IAAAE) পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আল্লাহ্‌ তা’লা তাঁকে বক্তৃতা ও লেখনীর অসাধারণ মেধা প্রদান করেছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী আহ্‌মদীয়া সাহিত্যে ভাণ্ডারকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর রচিত কিছু প্রসিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেঃ হযরত ফযলে উমরের জীবনী, আল্লাহ্‌র নামে রক্তপাত, মওদুদী ইসলাম, আহ্‌মদীয়াত দুনিয়াকে কি দিয়েছে? যুদ্ধক্ষেত্রে মহানবী (সাঃ)-এর নৈতিক উৎকর্ষতা।

হযরত হাফিয মির্যা নাসের আহমদ, খলিফাতুল মসীহ্‌ সালেস (রহঃ) ৯ই জুন ১৯৮২ সালে ইন্তেকাল করেন এবং পরবর্তী দিন হযরত মির্যা তাহের আহমদ সাহেব খলিফাতুল মসীহ্‌ রাবে (চতুর্থ) হিসেবে নির্বাচিত হন।

তাঁর সুযোগ্য দিকনির্দশনা এবং ঐশী সাহায্যে জামা’ত বড় বড় পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে চলে। সকল ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয় – ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে জামা’ত অগ্রসর হতে থাকে।

আল্লাহ্‌ তা’লা পবিত্র কুরআনে বলেন,

“সে নিশ্চিয়ই সফলতা লাভ করে যে নিজেকে পবিত্র করে”। (৯১:১০)

আর তাই আত্মার পবিত্রতা সাধনকে আল্লাহ্‌ তা’লার নবীদের অনুসারীদের একটি প্রধানতম দিকনির্দেশনা গণ্য করা হয়। হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রাহেঃ) জামা’তকে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে বিবিধ উপায়ে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেন, যার কিছু দিক এখানে উল্ল্যেখ করা হলোঃ

হুযূর বাজামা’ত নামায পড়ার গুরূত্বের উপর জোর দেন। তিনি এই ব্যাপারে তিন পর্যায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন – ১৯৮৩ সালের ১লা এপ্রিল তাঁর জুম’আর খুতবায় এবং ৮ই নভেম্বর পর্যন্ত আরও অনেক খুতবায় এ বিষয়ে জোর দেন। ১৯৮৮ সালের ১৭ই জুন তিনি আরও একবার নামাযের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তা’লার সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং তা সুদৃঢ়করণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। আল্লাহ্‌ তা’লার ফযলে এই প্রাণবন্ত উপদেশ সুফল দিচ্ছে এবং জামাতের সাধারণ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মানের উন্নতি সামগ্রিকভাবেই স্পষ্ট।

তথাকথিত আধুনিক সমাজ সমাধিকারের ধোঁয়া তুলে নারীজাতির মর্যাদাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে। যেভাবে ইসলাম নিয়ম কানুনের মাধ্যমে নারীজাতির সম্মান ও মর্যাদাকে সুরক্ষা করেছে তা অহেতুক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। হুযূর তাঁর প্রশ্নোত্তর সভা এবং সংবাদ সম্মেলনে কেবলই এই সমালোচনার খণ্ডন করেননি বরং সুস্পষ্টভাবে ইসলামে নারীদের প্রকৃত পদমর্যাদাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি আহ্‌মদী মহিলাদের যথাযথভাবে পর্দা পালনের এবং এভাবে ইসলামের মূল্যবোধের হেফাযত করার সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন।

১৯৮২ সালে আহ্‌মদীয়া জামাতার বার্ষিক জলসায় তিনি মহিলাদের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ধ্বংসাত্মক দিক সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং তাঁদের ইসলামী পর্দার তাৎপর্য ও গুরুত্ব অবহিত করেন।

তাঁর দিকনির্দেশনার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমাদেশের অধিকাংশ আহ্‌মদী মহিলাই এখন পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে পর্দা পালন করছেন।

ইসলাম পারিবারিক জীবনের বিষয়ে অত্যন্ত মহৎ শিক্ষা উপস্থাপন করেছে এবং মহানবী (সাঃ) এক্ষেত্রে নৈতিক উৎকর্ষের এক সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন। কিছু লোক এই সর্বোত্তম দৃষ্টান্তের অনুসরণ করেন না এবং এভাবে কুরআনের শিক্ষাকে লঙ্ঘন করে। ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৬ সালে হুযূর তাঁর জুম’আর খুতবায় আহ্‌মদীদের তাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে পুরোপুরিভাবে এই আচরণকে র্নিমূল করার এবং আত্মীয় ও পরিজনদের মাঝে উদারতাপূর্ণ আচার আচরণের লালন করার উপদেশ দেন। ফলশ্রুতিতে বহু পরিবার তাদের পূর্বতন আচরণ পরিহার করে। আহ্‌মদীরা একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে তুলনামুলক ভাবে অ-ইসলামী সামাজিক কুপ্রথা ও অন্ধবিশ্বাসের/কুসংস্কারের নিগড় থেকে মুক্ত। কখনও ত্রুটিবিচ্যুতি আসে এবং হুযূর তাই এসবের সমূলে উৎপাটনের উপর বিশেষ জোর দেন।

১৯৮৫ সালের ৮ই মার্চ এবং ১০ই মে’র খুতবায় হুযূর আহ্‌মদীদের সাধ্যাতীত মোহরানা প্রদান এবং নববর্ষ ও এরূপ প্রথাদি উপলক্ষ্যে তোহফা বিনিময় থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন।

মুসলমানরা বছরে দু’বার ঈদ করে থাকেন। ধনীরা সারারণতঃ তাদের নিজেদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যেই বিচরণ করে থাকেন। ১৯৮৩ সালে তাঁর ঈদের খুতবায় হুযূর জামাতের সম্পন্ন আহ্‌মদীদেরকে, তাদের গরীব ভাইদের ঘরে গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও উপহার প্রদানের জন্য বলেন। এই নির্দেশনা অনুসারণের ফলে আহ্‌মদীয়া সমাজে ঈদ উদযাপন তাৎপর্যপূর্ণভাবে উপভোগ্য হয়ে উঠছে এবং এটাই ইসলামী ঈদ উৎসবের সারবস্তু এবং প্রকৃত দর্শন।

কুরআনের শিক্ষায় সত্যিকার ভাবে লাভবান হতে হলে, আমাদের অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ (তাকওয়া পরায়ণ) হতে হবে। আল্লাহতা’লা বলেন,

“এটি ন্যায়নিষ্ঠদের জন্য এক দিকনির্দেশনা”। (কুরআনঃ ২:৩)

এক জমায়েতে মহানবী (সাঃ) নিজ বক্ষে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন,

“তাকওয়া এখানে থাকা উচিত”।

এই হাদীসের উল্ল্যেখ করে হযরত মসীহ্‌ মাউদ (আঃ) ঘোষণা করেন,

“তাকওয়া এমন একটি সদ্‌গুণ, যার মূল হৃদয়ে প্রোথিত হতে হবে”।

হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রহঃ) তাঁর বিভিন্ন জুম’আর খুতবায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। আল্লাহ্‌ তা’লার প্রতি সততঃ পরম শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয় ও অগাধ ভালোবাসাই তাকওয়াকে লালন করে থেকে।

ইসলামের প্রচার (তবলীগ) করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যক। বর্তমান সময়ে কেবল আহ্‌মদীয়া আন্দোলনই এই মহান কাজে সক্রিয় রয়েছে এবং এর বাস্তবতা আমাদের বিরুদ্ধবাদীরাও স্বীকার করেছেন। হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রহঃ) প্রচার ও প্রসারের এই কর্মসূচীকে ব্যাপক বিস্তৃতি দান করেছেন। আহ্‌মদীরা বর্তমানে সামগ্রিক ভাবে এই আহবানকে উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং এছাড়াও তবলীগের উদ্দেশ্যে রয়েছে রীতিমত পরিকাঠামোগতে একটি বাহিনী। সার্বিকভাবে এই পরিকল্পনা পৃথিবীর ১৫২টি (বর্তমানে ১৯০টি দেশে) বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে।

চতুর্থ খলীফার যুগে, জামা’ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব প্রতিপত্তির ফলশ্রুতিতে অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যায় অনুসারী লাভ করেছে, যাদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় রাজারা অন্তভূক্ত রয়েছেন।

১৯৮৭ সালে নাইজেরিয়া হতে আগত দু’জন রাজা বয়’আত গ্রহণ করে জামাতের অন্তর্ভূক্ত হন। এভাবে প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আঃ)-এর উপর নাযিল হওয়া ঐশীবাণী ‘রাজারা তোমার বস্ত্র থেকে কল্যাণ অন্বেষণ করবে’ আরও একবার পূর্ণতা লাভ করে। হুযূর ১৯৮৭ সালের লন্ডনে অনুষ্ঠিত সালানা জলসায় এই রাজাদ্বয়কে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পবিত্র বস্ত্রখণ্ড উপহার দেন।

প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আঃ) ইসলামের পূনর্জাগরণ এবং পবিত্র কুরআনের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে আল্লাহ্‌ তা’লা কর্তৃক মনোনীত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খিলাফতকালে বিভিন্ন ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করা হয়। এই কাজ এখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি লাভ করেছে। পৃথিবীর ৫৪টি ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ এবং প্রকাশনা সম্পূর্ণ হয়েছে। বিশ্বের ১১৮টি ভাষায় পবিত্র কুরআনের ৩০০ নির্বাচিত আয়াতের অনুবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে এই যুগান্তকারী কাজের তুলনা পাওয়া যায় না।

সর্বোচ্চ স্তরের উৎকর্ষতা এবং পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে নামায আদায়ের পর পরই আল্লাহ্‌ তা’লার রাস্তায় খরচ করার সদ্‌গুণকে সবচেয়ে অধিক প্রশংসনীয় বলে ঘোষণা করা হয়। এটা অনেক মহান এক আধ্যাত্মিক বিপ্লব যা হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর দ্বারা সাধিত হয় যে আহ্‌মদীরা সর্বদা আল্লাহতা’লার রাস্তায় অর্থব্যয়ের জন্য প্রস্তুত থাকেন বরং তা আগ্রহের সাথে করে থাকেন। এধরনের স্বতঃপ্রণোদিত কুরবানীর উদ্দীপনা জামাতের মধ্যে সর্বদা বেড়েই চলেছে এবং তা হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রহঃ)-এর যুগে আরও বেগবান হয়।

জামাতের বাৎসরিক বাজেট ১ বিলিয়ন মার্ক এ পৌছেঁছে। এ পরিমান কেবল অত্যাবশ্যকীয় চাঁদার। এছাড়াও চাঁদার আরও খাত রয়েছে যেমন ‘তাহরীকে জাদীদ’, ‘ওয়াকফে জাদীদ’, ‘সাইয়্যেদেনা বেলাল ফান্ড’ এবং ‘কুরআন প্রকাশনা খাত’। হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রহঃ) প্রতি বছর অনেক দেশ সফর করতেন। এ সফর তিনি জামাতের বহুমুখী কার্যাবলী পরিদর্শন, কাজে গতিসঞ্চার করা, বিস্তৃতি প্রদান এবং একে তরান্বিত করার লক্ষ্যে করতেন। পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকা, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা এবং কানাডার মতো দেশ সমূহ তাঁর সফরের কল্যাণে ধন্য হয়। খলীফা হওয়ার মাত্র দেড়মাস পরই হুযূর নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়া সফর করেন। তিনি বিগত ৭৫০ বছর পর স্পেনে প্রথম নির্মিত মসজিদ ‘মসজিদে বাশারত’ এর উদ্বোধন করেন। তিনি ১৮টি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন এবং সেখানে ইসলামের শিক্ষার পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ১৯৮৩ সালে সাত সপ্তাহ যাবত (২২শে অগাস্ট-১৪ই অক্টোবর) এক সফরে তিনি সিংগাপুর, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলংকা পরিদর্শন করেন। সিডনীতে ‘বাইতুল হুদা’ মসজিদ এবং মিশন হাউজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ছিল এই সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তিনি ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করেন, যাতে তিনি ইসলামের মূল্যবোধসমূহের বিস্তারিত বর্ননা করেন।

১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর, তিনি হল্যান্ড, জার্মানী এবং ফ্রান্স সফর করেন। বৃহৎ মিশন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর, হুযূর পুনরায় ইউরোপীয় দেশসমূহ সফর করেন। হল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং পশ্চিম জার্মানীতে নতুন মিশন হাউজের খোলার ঘোষণা দেওয়া হয়। একটি বিস্তৃত ও প্রশস্ত কেন্দ্র ‘নাসের বাগ’ এর উদ্বোধন করা হয়। হুযূর সাতটি ইউরোপীয় দেশ সফর করেন, পাঁচটি নতুন মিশন উদ্বোধন করেন এবং আরো চারটি নতুন মিশন প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখেন।

প্রশ্নোত্তর অধিবেশনসমূহ ছাড়াও তিনি চারটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।

১৯৮৬ সালে মধ্য অগাস্ট থেকে ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত, হুযুর কানাডা, হল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানী, সুইজারল্যান্ড, ইতালী এবং স্পেন সফর করেন, যাতে তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সাথে মিলিত হন এবং সংবাদ সন্মেলনও করেন। এই সফরকালে তিনি কানাডার প্রথম আহ্‌মদীয়া মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর রাখেন।

একই বছর তিনি ফ্রাঙ্কফোর্টে খোদ্দামূল আহ্‌মদীয়ার ইজতেমায় যোগদান করে একে আশীর্বাদপুষ্ট করেন এবং একই সাথে বেলজিয়াম ও হল্যান্ড পরিদশন করেন।

১৯৮৭ সালে তিনি দু’বার ইউরোপীয় দেশসমূহ, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা সফর করেন। এটি প্রকৃতই একটি ঐতিহাসিক সফর ছিল, যাতে তিনি বহু নতুন মিশনের উদ্বোধন করেন। তিনি বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীবিশিষ্ট প্রখ্যাত ব্যক্তিগণের সাথে মিলিত হন এবং তাদেরকে ইসলামের শিক্ষাসমূহ বোধগম্য উপায়ে অবগত করান। তিনি আমেরিকার বিভিন্ন বড় শহরে সাদরে গৃহীত হন এবং যেখানে সেই দিনটিকে ‘মির্যা তাহের আহমদ দিবস’ ঘোষণা করা হয়।

১৯৮৮ সালে তিনি পশ্চিম আফ্রিকায় প্রথম বারের মতো পদস্পর্শ করেন। ছয়টি দেশে পাঁচ সপ্তাহ ব্যাপী এই সফর ব্যাপকভাবে সফল ছিল। গাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, লাইবেরীয়া, আইভরি কোস্ট, ঘানা এবং নাইজেরিয়ার সর্বত্র তাঁকে জনাকীর্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং ঐতিহ্যবাহী রাজণ্যবর্গ তাঁর সাথে মিলিত হন। সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট আধঘন্টা যাবত তাঁর সাথে সাক্ষাতকারে মিলিত হন। যিনি তাঁকে ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার ব্যবহারের প্রস্তাব করেন এবং তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ কর্মরর্তাদের নিযুক্ত করেন। দেশব্যাপী সরকার তাঁর থাকার বন্দোবস্ত করেন।

তেমনিভাবে লাইবেরীয়ার সরকার দু’টি চালকসমেত গাড়ী সরবরাহ এবং সাথে সাথে পুলিশের একটি বাহিনী তাঁর নিরাপত্তার জন্যে নিযুক্ত করেন।

ঘানার প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রসিডেন্টের সাথে সাক্ষাত হয়।

প্রায় সকল দেশে রেডিও এবং টেলিভিশন হু্যুরের কর্মকান্ডের পর্যাপ্ত এবং প্রশংসাপূর্ণ প্রতিবেদন প্রচার করে।

জনগনের কল্যাণে জামাতের পরিচালিত হাসপাতাল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেবা বিপুলবভাবে প্রশংসিত হয়।

হু্যূর এই সফর থেকে ফিরে ঘোষণা করেনঃ

“আমি এই মহাদেশে অন্ধকার নয়, আলো প্রত্যক্ষ করেছি। অনেক বহিরাগতরা এখানে এসেছে এবং লোকজনদের শোষণ করেছে। আফ্রিকার সম্পদ অন্যত্র ব্যবহৃত হয়েছে।

আল্লাহতা’লা আমার মনে এই পরিকল্পনার প্রেরণা জাগিয়েছেন যে আহ্‌মদীয়া জামা’ত বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকে তহবিল সংগ্রহ করবে কিন্তু তা আফ্রিকার কল্যাণ্যে ব্যয় করবে”।

হুযূর একটি স্বতন্ত্র বিভাগ সৃষ্টি করেন এবং একে আফ্রিকার পুনর্জাগরণকে লালন করার এবং এর জনগনের পুনরূজ্জীবণের দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি আহ্‌মদী ডাক্তার, শিক্ষক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞগণকে আফ্রিকায় সেবা করার জন্য নিজেদের পেশ করার তাগিদ করেন।

একই বছর মার্চ/এপ্রিলে, হুযূর ফ্রাঙ্কফোর্ট এবং গ্লাসগো পরিদশন করেন। অগাস্ট/সেপ্টেম্বরে তিনি পূর্ব আফ্রিকা এবং মরিশাস সফর করেন। এটা ছিল সর্বপ্রথম কোন আহ্‌মদী খলীফার পৃথিবীর এ অংশে সফর। তিনি মরিশাস ছাড়াও কেনিয়া, উগান্ডা এবং তাঞ্জানিয়া পরিদর্শন করেন। এটাও ছিল এক অত্যন্ত সফল সফর। কিছু মসজিদের উদ্বোধন করা হয়। বহু আহ্‌মদী এ মহান ব্যক্তিত্বের সাথে সাক্ষাত লাভ করার এবং তাঁর মহিমান্বিত ধর্মোপদেশ থেকে উপকৃত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।

নিখিল বিশ্ব আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাতের ইমামের এসকল সফরের ফলশ্রুতিতে জামা’ত আধ্যাত্মিক ভাবে শক্তিশালী এবং উন্নীত হয়েছে এবং আহ্‌মদী জনতার মাঝে জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামেরব্যাপারে শিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে যে ভ্রান্ত ধারণা
নিবারণে ও এই সফর কার্যকর ভূমিকা রাখে। সময় সময় হু্যুরের ইসলামী শিক্ষার সঠিক ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা সমালোচকদের হতজবাব করেছে এবং তাদের কেউ কেউ তৎক্ষনাৎ বা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তাঁর আফ্রিকার এই সফরকালে শত শত ব্যক্তি আহ্‌মদীয়াত গ্রহণ করেছে।

যখনই আল্লাহ্‌ তা’লার কোন নবী আগমন করেন, তিনি এবং তাঁর অনুসারীরা বিরোধিতার এবং উপহাসের শিকার হন। প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আঃ)-এর অনুসারী আহ্‌মদীয়া জামাতের বেলায়ও এর শুরু থেকে একই ব্যাপার ঘটে।

১৯৭৪ সালে পাকিস্তান সরকার জামা’তকে নির্যাতন করা শুরু করে এবং যা ১৯৮৪ সালে জিয়াউল হকের কুড়িতম অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে এর চরমে পৌঁছে। আহ্‌মদীদেরকে নিদারূণ যন্ত্রণা দেওয়া হয় এবং অব্যাহতভাবে নির্যাতন চালিয়ে তাদের জীবন অসহনীয় করে তোলা হয়। কিন্তু তাঁরা বিস্ময়কর ধৈর্য এবং কুরবাণীর স্পৃহা প্রদর্শন করে। এ ধরনের বীভৎস নির্যাতনেও তাঁরা পাথরের মতো অবিচল থাকেন। তাঁদের অকুতোভয় স্থির সংকল্প ছিল তাঁদের দৃঢ়বিশ্বাসের বহিপ্রকাশ, যা তাঁরা খিলাফতরূপী আল্লাহতা’লার রজ্জুকে আকড়ে রাখার ফলশ্রুতিতে লাভ করেছিলেন।

বীরোচিত স্থৈর্য, সর্বোচ্চ স্তরের সদ্‌গুণ এবং বদান্যতার মাধ্যমে খেলাফতের দিকনির্দেশনায়, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত এবং উপহাসমূলক অপপ্রচারের মোকাবিলা করা হয়, যা প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

শান্তিপ্রিয় আহ্‌মদীদের উপর নির্যাতন আরো নিষ্ঠুরভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দু’ডজনের মতো আহ্‌মদীকে শহীদ করা হয়। আহ্‌মদীয়া জামাতের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতার প্রতি মিথ্যা অপবাদ এবং অভিশংসন আরোপ করা হয়।

পবিত্র বস্তুসমূহের অবমাননা এবং জামাতের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বগণের প্রতি কটূক্তি করা হয়। দুনিয়াব্যাপী এমনই নোংরা অপপ্রচার চালানো হয়। জামাতের নিকট যথেষ্ট সামর্থ নেই যে এসকল অপপ্রচারের প্রতিউত্তর প্রদান করে। তথাপি, আমাদের ইমাম, হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ (রহঃ) পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত ‘শ্বেতপত্র’কে অকাট্ট ভাবে খণ্ডন করেন। এ শ্বেতপত্রের জবাব লন্ডন থেকে ১৮ টি ধারাবাহিক পুস্তিকায় বের হয়, যা পরে একটি খণ্ডে প্রকাশ করা হয়।

তাদের সংস্কার সাধনের সকল প্রচেষ্টা বিফলতায় পর্যবসিত হয়, কোন উপদেশের প্রতি তারা কর্ণপাত করেনি, ঐশী শাস্তির সতর্কবাণীকে তারা তোয়াক্কা করেনি এবং অন্যান্য প্রচেষ্টাসমূহ বিফল হলে; হযরত খলিফাতুল মসীহ্‌ রাবে (রহঃ), ১৯৮৮ সালের ১০ই জুন, তাদের সকল শীর্ষনেতাদের ‘মুবাহেলার’ চ্যালেঞ্জ প্রদান করেন। বিষয়টি আল্লাহতা’লার সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেওয়া হলো, যিনি সর্বোত্তম বিচারক।

মুবাহেলার চ্যালেঞ্জের একমাস পর, মৌলভী আসলাম কোরেশীর পুনরাবির্ভাব ঘটে, যে নিজেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে লুকিয়ে রেখেছিল। এই অভিযোগ করা হয়েছিল যে তাকে আহ্‌মদীয়া জামাতের প্রধান অপহরণ এবং হত্যা করিয়েছে। আসলাম কোরেশীর পুনরাবির্ভাব জামাতের বিরূদ্ধবাদীদের জন্যে এক লজ্জাকর অপমান।

১৯৮৮ সালের ১৭ই অগাস্ট জেনারেল জিয়াউল হকের দৃষ্টান্তমূলক ধংসপ্রাপ্ত হওয়া (মুবাহেলা চ্যালেঞ্জের মাত্র নয় সপ্তাহ পর) আহ্‌মদীয়াতের সত্যতার জেনারেল আরও একটি বড় নিদর্শন।

ধন্য তাঁরাই যারা ঐশী নিদর্শনের প্রতি কর্ণপাত করেন এবং যুগের সংস্কারককে সনাক্ত করেন এবং মহানী (সাঃ) এর ঝাণ্ডার নিচে একত্রিত হন এবং যাঁরা খেলাফতের প্রতি কৃত অংগীকারে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকেন, আল্লাহ্‌ তাঁদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহের বৃষ্টি বর্ষণ করুন,আমিন।

বাংলা অনুবাদ: মুহাম্মদ সেলিম খান

পুস্তক