হযরত আলী বিন আবি তালিব (রা.)

খিলাফত কাল: ৬৫৬-৬৬১ খ্রীস্টাব্দ

হযরত উসমানের (রা.) শহীদ হওয়ার পর মদিনাতে একটি সর্বব্যাপী বিশৃংখলা এবং নৈরাজ্য বিরাজ করছিল।
পাঁচ দিন যাবত রাজনৈতিক ডামাডোলের পর, মিসরীয় বিদ্রোহীদের নেতা, ইবনে সাবা, হযরত আলী (রা.)-এর পক্ষে এই বলে রায় দেয় যে, তিনিই একমাত্র খলীফা হওয়ার অধিকারী কারণ হযরত মোহাম্মদ (সা.) যার সপক্ষে একটি ওসিয়্যত করেছিলেন।

২৩শে জুন ৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে, হযরত উসমানের (রা.) মৃত্যুর ছয় দিন পর, হযরত আলী (রা.) মহানবী (সা.)-এর চতুর্থ খলিফা নির্বাচিত হন এবং জনগণ তাঁর হাতে একে একে বয়’আত গ্রহণ করেন।

হযরত আলী (রা.), হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের ছেলে ছিলেন। তিনি মক্কায় মহানবী (সা.)-এর জন্মের ২০ বছর পর জন্ম গ্রহণ করেন। যখন হযরত আলী (রা.) জন্মগ্রহণ করেন, হযরত মোহাম্মদ (সা.) স্বয়ং তাঁর অভিভাবক হন, কারণ তাঁর পিতার আর্থিক অবস্থা তখন বেশ দুর্বল ছিল।

হযরত আলী (রা.) সেই রাতে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর বিছানায় শায়িত ছিলেন যখন তিনি (সা.) মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেন। মক্কার নেতারা মহানবী (সা.) কে গ্রেফতার এবং হত্যা করতে চেয়েছিল। পরবর্তী সকালে তারা মহানবী (সা.)-এর বিছানায় তাঁর পরিবর্তে হযরত আলী (রা.) কে দেখে ক্রোধান্বিত হয়।

হযরত আলী (রা.) একজন দুঃসাহসী এবং দক্ষ কৌশলী যোদ্ধা ছিলেন। তিনি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সাথে প্রায় সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মহানবী(সা.) এর কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। খেলাফতের নির্বাচনের পরপরই তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী, মদীনা থেকে ইরাকের কুফায় সরিয়ে নেন, যা ছিল অধিকতর কেন্দ্রীয় একটি স্থান।

তাঁর নির্বাচনের পরপরই তিনি জনগণের বিশেষ করে মহানবী (সা.)-এর প্রভাবশালী সাহাবী যেমন হযরত তালহা (রা.) এবং হযরত যুবাইর (রা.)-এর উত্থাপিত ‘হযরত উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের যথাশীঘ্র শাস্তির জনপ্রিয় দাবীর সম্মুখিন হন।

হযরত আলী (রা.) ঘোষণা করেন যে, তাঁর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রাষ্ট্রে শান্তি- শৃংখলা পুনঃস্থাপন করা এবং কেবল তারপরই তিনি হযরত উসমান (রা.)-এর হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখিন করতে পারবেন। কিন্তু হযরত তালহা (রা.) এবং হযরত যুবাইর (রা.), হযরত আলী (রা.)-এর এই সিদ্ধান্তে রাজী হননি; তারা সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করা শুরু করেন। হযরত আয়েশা (রা.), যিনি প্রকৃত অবস্থা অবগত ছিলেন না, তিনিও হযরত উসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে হযরত তালহা (রা.) এবং হযরত যুবাইর (রা.)-এর সাথে যোগ দেন। তিনজনে মিলে বসরার উদ্দেশ্যে এক সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন।

হযরত আলী (রা.) যুদ্ধ এবং রক্তপাত এড়াতে যারপরনাই চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, তাঁর এবং হযরত আয়েশা (রা.)-এর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়, যদিও, হযরত তালহা (রা.) এবং হযরত যুবায়ের (রা.) যুদ্ধের পূর্বেই সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং অন্য কোন শত্রুর দ্বারা নিহত হন। হযরত আয়েশার (রা.) সৈন্যরা পরাজিত হয় কিন্তু হযরত আলী (রা.) তাঁকে যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং তাঁর নিরাপত্তার খেয়াল রাখেন। তিনি তাঁর ভাই মোহাম্মদ বিন আবু বকর (রা.)-এর রক্ষাবেষ্টনীতে তাঁকে মদীনায় প্রেরণ করেন। এটি ‘উটের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত; কারণ হযরত আয়েশা (রা.) যুদ্ধের সময় উটের উপর সওয়ারী ছিলেন। পরবর্তীতে, হযরত আয়েশা (রা.) জীবনভর হযরত আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অনুতপ্তা ছিলেন।

উটের যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা.), হযরত মুয়াবিয়া (রা.) কে, যিনি তখনও তাঁর হাতে বয়’আত গ্রহণ করেননি, ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর নিকট আত্বসমর্পণ করার আহ্বান জানান। কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এই অজুহাতে তাঁর নিকট নিজেকে সমর্পণ করেনি যে, হযরত উসমান (রা.) যিনি উমাইয়া বংশোদ্ভূত ছিলেন, তার রক্তের প্রতিশোধ প্রথমে নিতে হবে।

আমীর মুয়াবিয়া (রা.), আমর বিন আস (রা.)-এর সহায়তায়, সৈন্য প্রস্তত করা শুরু করে। হযরত আলী (রা.), অন্য কোন বিকল্প না পেয়ে, মুয়াবিয়ার সাথে লড়ার জন্য সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হতে হয়। ৫৬৭ খ্রীস্টাব্দের জুলাই এ দুই সৈন্য বাহিনী ‘সিফফিনে’ যুদ্ধে উপনীত হয়। দু’পক্ষেই ব্যাপক হতাহত হয়; কিন্তু যুদ্ধ এই মতৈক্যে শেষ হয় যে, বিষয়টি একটি মধ্যস্থতা কমিটিতে নিষ্পত্তি হবে। এই কমিটিতে হযরত আলী (রা.)-এর পক্ষে আবু মুসা আল আসরি (রা.) এবং আমীর মুয়াবিয়ার পক্ষে আমর বিন আস (রা.) প্রতিনিধিত্ব করে। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই মধ্যস্থতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, কারণ আমর বিন আস (রা.) আবু মুসা আল আসরি (রা.)-এর সাথে গ্রহীত সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাড়াঁয়।

একটি বড় দল, যারা মধ্যস্থতার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল, হযরত আলী (রা.) থেকে সরে গিয়ে তাদের জন্য এক নতুন আমীর নির্বাচিত করে নেয়।এই দলটিকে ‘খারেজী’ অর্থাৎ ‘ব্যতান্ত্রিক’ বলা হয়ে থাকে। সর্বপ্রথম, হযরত আলী (রা.) তাদেরকে বুঝিয়ে রাজি করেনোর চেষ্টা করেন, কিন্তু তা নিস্ফল হয়; যা ভয়াবহ যুদ্ধে মোড় নিলে প্রচুর খারেজী নিহত হয়।

এই বিপর্যস্ত পরাজয়ের পর খারেজীরা হযরত আলী (রা.), হযরত মুয়াবিয়া (রা.) এবং আমর বিন আস (রা.) কে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরবর্তী দু’জন হত্যা প্রচেষ্টা হতে বেঁচে যেতে সক্ষম হলেও হযরত আলী (রা.) ফযরের নামাজের জন্য মসজিদে যাবার সময় আক্রমণকারীর দ্বারা গুরুতর আহত হন। দু’দিন পর এই অমিত সাহসী এবং ধর্মপ্রাণ খলীফা ৪০ হিজরীর ২০ রমযানে পরলোক গমন করেন। নিঃসন্দেহে, হযরত আলী (রা.) খেলাফতের পবিত্রতা এবং মর্যাদা রক্ষার খাতিরে তাঁর জীবন কুরবান করেন।

তিনিও সেই দশজন সৌভাগ্যশালীদের একজন মহানবী (সা.) যাঁদের বেহেস্‌তের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন।

মূল ঊর্দু: মজিদ আ. মিয়া

বাংলা অনুবাদ: মুহাম্মদ সেলিম খান

প্রবন্ধ


জুমুআর খুতবা