হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)

খিলাফত কাল: ৬৩২-৬৩৪ খ্রীস্টাব্দ

হযরত আবু বকর (রা.)-এর ব্যক্তিগত নাম ছিল আব্দুল্লাহ, কিন্তু আরবের প্রথামত তিনি তাঁর ছেলের নাম বকর থেকে আবু বকর (বকরের পিতা) নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আবু কোহাফা এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল উম্মুল খাইর সালমা।

তিনি ৫৭২ খ্রীস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর একজন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তিনিই পুরুষদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দাবীর সত্যতাকে নিশ্চিত বলে গ্রহণ করেন এবং এভাবে ‘সিদ্দীক’ উপাধি লাভ করেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনা হিজরতের সময় তাঁর সহযাত্রী ছিলেন। তিনিই হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর একমাত্র সাহাবী, যিনি তাঁর সাথে সেই সফরে ‘সাওর’ গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।

হিজ্জ্বাতুল বিদা (বিদায় হজ্ব) এর পরে, যখন মহানবী (সা.) গুরুতরভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন, তিনি হযরত আবু বকর (রা.) কে দৈনন্দিন নামাযে ইমামতী করার নির্দেশ দেন। হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শোকাবহ ইন্তেকালের পর, হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। তাঁকে মহানবী (সা.)-এর আকস্মিক মৃত্যুতে উদ্ভূত একটি অত্যন্ত সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতির সামাল দিতে হয়।

সর্বপ্রথম সমস্যা এই ছিল যে, কিছু গোত্র প্রকাশ্যে ইসলামকে অস্বীকার করে বসে, কেবল এই কারণে যে, তাদের গোত্রীয় প্রধান মহানবী (সা.)-এর খলীফার প্রতি অনুগত্ থাকার আর প্রয়োজন মনে করেনি। শুধু তাই নয়, তারা বরং নবপ্রতিষ্ঠিত খিলাফতকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে মদীনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। হযরত আবু বকর (রা.) তাদের অভিসন্ধি জানতে পেরে, সৈন্য প্রেরণ করেন এবং তাদের বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন।

দ্বিতীয়ত: হযরত আবু বকর (রা.) বড় যে সমস্যার সম্মুখীন হন, তা ছিল যে, বহু লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করে, যা ইসলামী রাষ্ট্রের বিবিধ চাহিদা পূরণ এবং দরিদ্রদের তত্ত্বাবধানের জন্য জন্য অপরিহার্য ছিল। হযরত আবু বকর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে, প্রতিটি সক্ষম ব্যক্তিকে যাকাত দিতে হবে এবং তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।

সবচেয়ে ভয়াবহ সমস্যা এই ছিল যে কিছুসংখ্যক উচ্চাকাংখী ব্যক্তি মিথ্যা নবুয়তের দাবী করে বসে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। মোসায়লিমাতুল কাজ্জাব এবং আসওয়াদ আনসী বিপুল সৈন্য সমারোহ করে এবং কিছু সংখ্যক মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা দখল করে নেয়। হযরত আবু বকর (রা.) এইসব বিদ্রোহী মিথ্যা নবুয়তের দাবীকারকদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। রসদের স্বল্পতা সত্ত্বেও আল্লাহ্‌ তা’লা তাঁকে দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেন।

তাঁর খিলাফতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের একটি হলো পবিত্র কুরআনকে একস্থানে সংগৃহিত করা। যদিও মহানবী (সা.) স্বয়ং পবিত্র কুরআনের লিখন ও বিন্যস্তকরণ কাজ সুসম্পন্ন করেছিলেন,কিন্তু তখন পর্যন্ত তা বিবিধ চামড়ার টুকরা, বৃক্ষ পত্ররাজি এবং পাথরের ফালিতে লিখিত ছিল। হযরত আবু বকর (রা.) এই সকল বিছিন্নভাবে লিখিত অংশকে সংগ্রহ করে একত্রিত করেন এবং কুরআন সংরক্ষণের নিমিত্তে হিফযকারীদের ব্যবস্থাপনাকে পদ্ধতিগত ভাবে পূনর্বিন্যস্ত করেন।

মহানবী (সা.) তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোতে রোমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করার জন্য এক সৈন্য বাহিনী প্রস্তুত করেছিলেন, যারা উত্তর সীমান্তে উপদ্রব করছিল। এই সৈন্যবাহিনী তখনও মদীনাতেই অবস্থান করছিল, যখন মহানবী (সা.) পরলোকগমন করে গেলেন। হযরত আবু বকর (রা.) খলীফা হওয়ার পর মদীনার ভিতর এবং বাইরের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়লো। এই মহা বিপদের আশঙ্কা করে, মহানবী (সা.)-এর অনেক সাহাবী তাঁকে এই পরামর্শ দিলেন যেন এই সৈন্য বাহিনী রোমানদের বিরুদ্ধে তখনই প্রেরণ করা না হয়। কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) জোরের সাথে জবাব দিলেন, “আবু কোহাফার পুত্রের কি অধিকার আছে যে মহানবী (সা.)-এর দ্বারা সূচিত কোন কাজকে রোধ করে”। মুসলিম সেনারা হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর নেতৃত্বে বাহরাইনে এক বিদ্রোহকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। তারপর পারস্যরা পরাজিত হয়, যারা বাহরাইনের বিদ্রোহীদের মদদ করছিল। মুসলিম সৈন্যবাহিনী অতঃপর ‘আজনাদান’ এবং ‘ইয়ারমুকে’র যুদ্ধে রোমান পরাশক্তিকে পরজিত করে এবং এভাবে গোটা সিরিয়া ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রনে চলে আসে।

হযরত আবু বকর (রা.) পক্ষকাল অসুস্থ্য থাকার পর ৬৩৪ খ্রীস্টাব্দের ২৩ অগাস্ট পরলোকগমন করেন। তিনি ছিলেন সেই দশ আশীর্বাদপুষ্টদের একজন যাঁদেরকে মহানবী (সা.) সুসংবাদ দিয়েছিলেন যে তাঁদের জান্নাতে ভূষিত করা হবে। তিনি দু’বছরের কিছু অধিককাল খিলাফতের মসনদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

মূল ঊর্দু: মজিদ আ. মিয়া

বাংলা অনুবাদ: মুহাম্মদ সেলিম খান

জুমুআর খুতবা