হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আউয়াল (রাঃ) অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর আলোকমালা থেকে এক ঝলক


মাওলানা আহমদ সাদেক মাহমুদ, অবসর প্রাপ্ত মুরব্বী সিলসিলা

হযরত হাজীউল হারামাঈন হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ) বর্তমান যুগের দৃষ্টান্ত স্থানীয় সেই সব ধর্ম প্রাণ ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের প্রথম সারিতে পরিগণিত, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা আখেরী যুগে আবির্র্র্ভূত ইমাম মাহদী ও প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ (আঃ)-এর সমর্থন ও সহায়তার উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে গড়ে তুলেন এবং এ মহাসৌভাগ্যের দ্বারা ভূষিত হওয়ার জন্য তাদেরকে অসাধারণ গুণাবলীতে গুণান্বিত করেন। হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) তৎকালীন ভারতবর্ষ তথা মুসলিম বিশ্বে স্বীকৃত একজন সর্বমান্য বিদগ্ধ আলেম ও উঁচু মানের সিদ্ধ পুরুষ এবং বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন সুদক্ষ হেকীম তথা চিকিৎসাবিদ ছিলেন। কাশ্মীর রাজ্যে তিনি ১৮৯২ ইং পর্যন্ত রাজচিকিৎসক হিসেবে বহুল জনকল্যাণ ও বরকতমন্ডিত জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘মিরকাতুল ইয়াকীন ফি হায়াতি নূরুদ্দীন’ গ্রন্থের ইংরেজী ভাষার সংস্করণও রয়েছে। আগ্রহশীল পাঠকগণ এতে তাঁর সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে পারবেন।

হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) পশ্চিম পাঞ্জাবের অন্তর্গত ভেরা নগরে ১৮৪১ ইং সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং বংশগতভাবে তিনি মক্কামুয়ায্‌যামার বিখ্যাত গোত্র তথা কোরেশ বংশের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তাঁর বংশ তালিকায় ৩৪তম উর্ধ্ব ধাপে তাঁর পূর্ব পুরুষ হচ্ছেন হযরত আব্দুল্লাহ্‌ বিন উমর বিন খাত্তাব (রাঃ)। তাঁর উর্ধ্বস্তন পূর্ব পুরুষদের অনেকে শাসক ছিলেন এবং অনেকে ওলী আল্লাহ হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন।

নবীদের আরদ্ধ কাজের পূর্ণতার জন্য সাহায্যকারীদের প্রয়োজন হয়ে থাকে। হযরত রসূল করীম (সাঃ) দোয়া করতেন,

‘হে আল্লাহ্‌ ! উমর বিন খাত্তাব অথবা আম্‌র বিন হিশাম (আবুজাহল) -এদের কোন একজন অবশ্যই ইসলামকে দান কর।’

হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের অনেক শক্তি যোগায়। তাঁরা ‘দারে-আরকাম’ থেকে বের হয়ে প্রকাশ্যে মসজিদে-হারামে (বায়তুল্লায়) নামায আদায় করেন। হযরত নবী করীম (সাঃ)-এর অনুগত দাস ও মহান প্রেমিক হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)ও অনুরূপ দোয়াই করতেন তিনি বলেন,

“আমি রাত দিন খোদা তাআলার সমীপে কান্নাকাটি করে নিবেদন করতে থাকি, ‘হে আমার প্রভু-প্রতিপালক! কে আমার সহায়ক ও সাহায্যকারী? আমি যে একা নিঃসঙ্গ।’… অবশেষে আল্লাহ্‌ তাআলা আমার বিনীত দোয়া কবুল করলেন। রাব্বুল আলামীনের রহমত উথলে উঠলো এবং তিনি আমাকে একজন ‘মুখলেস’ নিষ্ঠাবান হিতাকাংখী ও সিদ্দীক দান করলেন, যিনি আমার সহায়ক ও সাহায্যকারীদের চক্ষুবিশেষ এবং ধর্মের উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রাণ আমার বন্ধুদের নির্জাস। এই সহায়কের নাম তার নূরানী (আলোকোজ্জ্বল) গুণাবলীর ন্যায় ‘নূরুদ্দীন’, জন্মস্থানের দিক দিয়ে তিনি ভেরাবাসী এবং বংশের দিক দিয়ে হাশেমী ও কোরেশীয়। তিনি ইসলামের সরদার (তথা শীর্ষ নেতা)-দের অন্তর্ভুক্ত।” (আইনায়ে কামালতে ইসলাম)

হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) তাঁর মহতী ধর্মসেবা, ত্যাগতিতিক্ষা ও অসাধারণ গুণাবলীর কারণে হযরত আকদাস মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর অতি প্রিয় ছিলেন। হযরত আকদাস (আঃ) তাঁর অগাধ ভালবাসা ও আন্তরিক আনুগত্যের যে অসাধারণ চিত্র তুলে ধরেছেনঃ

“মৌলবী নূরুদ্দীন সাহেব সেভাবেই আমাদের অনুবর্তিতা করেন যেভাবে মানুষের শিরা তার হৃদপিন্ডের ক্রিয়া ও গতিকে অনুসরণ করে থাকে।”

হযরত আকদাস (আঃ)-এর দৃষ্টিতে হযরত মাওলানা নূরুদ্দীনের যে কী অসামান্য মর্যাদা ছিল তা তাঁর (আঃ) রচিত এ পংক্তি দুটিতে প্রকাশ পায় ।

“চেখোশ বুদে আগার হর্‌ ইয়েক্‌ আয্‌ উম্মত নূরে দীঁ বুদে
হামীঁ বুদে আগার হর্‌ দিল পুর আয্‌ নূরে ইয়াকীঁ বুদে।”

অর্থাৎ, কতো ভাল হতো যদি উম্মতের প্রত্যেক সদস্য নূরুদ্দীনে পরিনত হতো।
তেমনটি অবশ্যই হতে পারতো যদি এদের প্রত্যেকের হৃদয় দৃঢ়বিশ্বাসের আলোকে উদ্ভাসিত হতো॥

১৪ মে ১৮৮৭ ইং হযরত মৌলবী আব্দুল করীম সাহেবের নামে এক চিঠিতে হযরত আকদাস (আঃ) লিখেছেনঃ

“নিঃসন্দেহে প্রিয় ভ্রাতা মৌলবী হেকীম নূরুদ্দীন সাহেব অতি প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। …..তিনি আল্লাহ তাআলার ফযলে সেই সব দুর্লভ ব্যক্তিদের অন্তর্ভু্‌ক্ত, যাঁরা জগতে অতি বিরল। দৃঢ় মনোবল, উচ্চ সাহসিকতা, দৃঢ়চিত্ততা, অকপটতা, সরলতা, আন্তরিকতা, বিশ্বস্ততা ও সত্যপ্রিয়তার উচ্চমানের গুণাবলীর পাশাপাশি তার মাঝে এমন নম্রতা, উদারতা, বিনয় ও অমায়িকতা পরিলক্ষিত হয় যে এসব ক্ষেত্রে, প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক মু’মিনকেই ঈর্ষা করা উচিত। ‘যালিকা ফায্‌লুল্লাহি ইউতিহি মাইঁইয়াশাউ’ (এগুলি আল্লাহ্‌র সেই সব অনুগ্রহ, যা তিনি যাকে চান দান করেন)।”

আর্যসমাজী পন্ডিত লেখরাম রচিত ‘তাকযীবে বারাহীনে’ পুস্তকে উত্থাপিত আপত্তি খন্ডনে ‘তাসদীকে বারাহীন আহ্‌মদীয়া’ পুস্তক প্রণয়নের জন্য ২৬ জুলাই ১৮৮৭ইং তারিখের পত্রে হযরত আকদাস মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) হযরত নূরুদ্দীন (রাঃ)কে সম্বোধন করে লিখেনঃ

“শক্তিশালী দৃঢ়বিশ্বাসের ধারায় খোদা তাআলা আমার হৃদয়ে একথা প্রোথিত করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ্‌ জাল্লাশানুহু নিজ ধর্মের সাহায্যের জন্য আপনার হৃদয়ে যে পরিমাণ জোশ ও উদ্দীপনা দিয়েছেন এবং আমার সহানুভূতিতে আপনাকে অনুপ্রাণিত ও প্রস্তত করেছেন যে, এহেন গুণাবলীতে গুণান্বিত রূপে অন্য কোন ব্যক্তিকে দেখা যায় না।”

আরেক পত্রে হযরত আকদাস (আঃ) লিখেছেনঃ

“আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ, সাহাবা কিরাম রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুমের আদর্শের ধারায় জনাব খাঁটি হৃদয়ে এবং পূর্ণ জোশ ও উদ্দীপনার সাথে ইসলামের সাহায্যের ক্ষেত্রে এমন মশগুল যে পত্র প্রেরণে আমার উদাসীনতা সত্ত্বেও তা অব্যাহত রেখেছেন।” (মক্তুবাতে আহ্‌মদীয়া, ৫ম খন্ড)

হযরত মাওলানা হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ) এর মালী কুরবানী সম্পর্কে হযরত আকদাস (আঃ) ‘আইনায়ে কামালতে ইসলাম’এর আরবী অংশে লিখেছেনঃ

“মা নাফায়নী মালু আহাদিন কামালিহিল্লাযী আ’তাহু লি-ওজ্‌ হিল্লাহি ও ইউতি মিন সিনীনা।”

অর্থাৎ “আমাকে কারও অর্থ এত উপকার করেনি যতো এবং যে পরিমাণ অর্থ তিনি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দিয়েছেন এবং বহু বছর ধরে দিয়ে যাচ্ছেন।”

হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর আর্থিক সেবা সম্পর্কেও হযরত নবী আকরাম (সাঃ)-এর অনুরূপ প্রশংসামূলক উক্তি রয়েছেঃ

“মা নাফা আ’নী মালু আহাদিন কাত্তো মান নাফা’আলী মালু আবি বাকরিন।’ (জমে তিরমিযী)

অর্থাৎ “আবূ বকরের অর্থ সম্পদের দ্বারা আমার যে পরিমাণ উপকার হয়েছে অন্য কারও অর্থসম্পদে তেমন হয়নি।”

আগেই যেমন উল্ল্যেখ করা হয়েছে, হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ) এক অতি সম্ভ্রান্ত ও পূণ্যবান পরিবারের ক্ষণজন্মা সন্তান। তাঁর পিতা ও মাতা কুরআন করীমের হাফেয ও প্রেমিক ছিলেন। তাঁর ক্রমাগত ধারায় উর্ধ্বতন ১৩ ধাপ পর্যন্ত তাঁর পিতৃপুরুষও কুরআনে হাফেয ছিলেন। আবার তিনি নিজেও কুরআনে হাফেয ছিলেন। তদুপরি কুরআন করীমের প্রতি তাঁর অনুরাগ ও ভালবাসা ছিল অতি গভীর ও কল্পনাতীত। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন কুরআন মজীদের অতিউঁচুমানের সূক্ষ্মতত্ত্বদর্শী ও জ্ঞানবিশারদ তফসীরকারক। হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর কুরআন তফসীর ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শোনার পর তিনি (রাঃ) বলেন, কুরআন মজীদের ওরূপ মাহাত্ম্যপূর্ণ তত্ত্ব-তথ্য ও সৌন্দর্য তিনি অন্য কোথাও খুঁজে পান নাই। প্রকৃতপক্ষে হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর সাহচর্য ও সংস্পর্শ তাঁর (রাঃ) ক্ষেত্রে সোনায় সোহাগা হয়ে যায়।

কুরআন করীমের জ্ঞানভান্ডার বিতরণ ও বিস্তারের জন্য যে অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আউয়াল নূরুদ্দীন (রাঃ)-এর স্বভাবজাত করা হয়েছিল, এর দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তাঁর এ উক্তিটির প্রতি একটু লক্ষ্য করুনঃ

“খোদা তাআলা আমাকে বেহেশ্‌তে ও হাশরে নিয়ামতসমূহ দান করলে আমি সর্বপ্রথম তাঁর কাছে কুরআন মজীদ চাইবো যাতে, হাশরের ময়দানেও আমি কুরআন পড়তে, পড়াতে এবং শোনাতে পারি।”

ভেরা, জম্মু কাশ্মীর, কাদিয়ান – যেখানেই বাস করেছেন, সেখানেই তিনি (রাঃ) নিয়মিত কুরআনের দরস দেওয়া অব্যাহত রাখেন। কাদিয়ানে দেয়া তাঁর দরসে-কুরআনের নোটস্‌ (অনুলিপিসমূহ) পত্র-পত্রিকায় সংরক্ষিত হয়ে ‘হাকায়েকুল কুরআন’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

২৭শে মে, ১৯০৮ ইং তারিখে খিলাফতের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর তাঁর প্রথম ভাষণে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। হযরত নবী করীম (সাঃ)‌-এর তিরোধানের পর ‘জামআ’ কুরআন’ (কুরআনের সব পান্ডুলিপি একত্রীকরণ ও একই দলিলে সংরক্ষণ) প্রসঙ্গে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও সাহাবা কিরামের অসামান্য খেদমত ও অবদানের কথা উল্ল্যেখ করে তিনি বলেনঃ

“নবী করীম (সাঃ)-এর পর আবু বকর (রাঃ)-এর সময়ে সাহাবা কিরামকে বহুবিধ প্রশংসনীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও সাধ্য-সাধনা করতে হয়েছে। সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি তাঁরা করেন তা হলো ‘জাম্‌’আ কুরআন (কুরআন একত্রীকরণ ও সংরক্ষণ)। এখন বর্তমান অবস্থায় ‘জাম’আ হলো, এর চর্চা ও এর হুকুম-আহকাম পালন করা ও করানোর প্রতি যেন সবিশেষ মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে।” (হায়াতে নূর)

এ উদ্দেশ্যটি দৃষ্টি-পটে রেখে তিনি কুরআন মজীদের দরস ও কুরআন শেখা ও শেখানোর বিষয়টিকে বয়আতের একটি বাড়তি শর্ত হিসেবে নির্ধারণ করেন।

সূরা জুমুআর ‘ওয়া আখারিনা মিনহুম…..’ আয়াতটিতে আল্লাহ্‌ তাআলা শেষযুগে আগমনকারী রসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর আধ্যাত্মিক প্রতিবিম্ব ও প্রতিনিধি ইমাম মাহদী প্রতিশ্রুত মসীহকে সাহাবা কিরাম তুল্য (তাঁদের গুণে গুণান্বিত, তাঁদেরই প্রতিবিম্ব স্বরূপ) সাথী দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তদনুযায়ী আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে বহুল সংখ্যক সাহাবাতুল্য সাথীদের মাঝে যেমন ‘ফযলে উমর’ দ্বিতীয় খলীফা মুসলেহ্‌ মাওউদ দান করেছিলেন, তেমনি অনন্য সাধারণ সাদৃশ্যপূর্ণ আরেক ব্যক্তিত্ব তথা খলীফাতুর রসূল হযরত আবু বকর সিদ্দীকতুল্য খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল হযরত মাওলানা হেকীম নূরুদ্দীনও প্রদান করেন। সুতরাং হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) রচিত আরবী ভাষায় ‘সিররুল-খিলাফাহ’‘হামামাতুল বুশরা’, ‘আত্‌ তবলীগ’ গ্রন্থাবলীতে হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত নূরুদ্দীন (রাঃ) উভয়ের সম্পর্কে পরিচিতিমূলক বর্ণনায় তাঁদের মাঝে দৃশ্যমান একই রকম মহৎ গুণাবলী উল্ল্যেখ করে এ গুঢ়তত্ত্বটিও বর্ণনা করেন যে, রসূল করীম (সাঃ) তাঁর সকল সাহাবা কিরামের মধ্যে কেবল হযরত আবু বকর (রাঃ)কেই ‘সিদ্দীক’খেতাব বা অভিধায় অভিহিত করেন, যা তাঁর (রাঃ) অনন্য মর্যাদার প্রমাণ বহণ করে। অনুরূপভাবে একই রকম গুণাবলীর উল্ল্যেখ করে হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ) হযরত মাওলানা হেকীম নূরুদ্দীনের সত্ত্বায় তাঁকে এক ‘সিদ্দীক’ দান করায় আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

হযরত নবী আকরাম (সাঃ) এক বিখ্যাত হাদীসে তাঁর নবুওয়াতী জীবন অতিবাহিত হওয়ার পরে পরে ‘আলা মিনহাজিন-নবুওয়াত’ অর্থাৎ নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার; অতঃপর এর জায়গায় বিচ্ছিন্নতাকারী রাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এবং পরিশেষে ‘পুনরায় নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত’ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দান করেন (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ৪র্থ খন্ড এবং মিশকাত, বাবুল ইনযার ওয়াত্‌ তাহ্‌যীব)

উল্ল্যেখযোগ্য যে, উক্ত হাদীসে উল্লেখিত পুনরায় আলা মিনহাজিন নবুওয়াত খিলাফত প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সকল হাদীসবিদ ইমামগণের অভিন্ন অভিমত অনুযায়ী তা প্রতিশ্রুত মসীহ্‌ ও ইমাম মাহদী (আঃ)-এর আবির্ভাবের মাধ্যমেই সংঘটিত হবে বলে স্বীকৃত।

নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুত প্রথম ধারায় হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং দ্বিতীয় ধারায় হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন (রাঃ)-এর ১ম খলীফা হিসেবে নিযুক্ত হওয়া এ দু’জনের পারস্পরিক সাদৃশ্যের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। উভয় বুযুর্গ নিজ নিজ ‌ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একই ধারায় প্রথম বয়আতকারীও বটে।

হযরত আবু বকর (রাঃ) কে সাহাবা কিরাম রসূল প্রেমিক হিসেবে এবং ইসলাম সেবা ও ত্যাগ-তিতিক্ষায় সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু এতো উচ্চ মর্যাদা ও গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)পরম বিনয়ী ছিলেন এবং নিজেকে ‘খিলাফত’ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্য বলে মনে করতেন না। সুতরাং রসুল করীম (সাঃ)-এর তিরোধানের পর খিলাফত বিষয়ে নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কিরাম যখন ‘সাকীফা বনী সায়েদা’য় সমবেত হয়েছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সেখানে উপস্থিত হয়ে খিলাফতের বয়আতের জন্য হযরত উমর ও হযরত আবু উবায়দাহ্‌ বিন জাররাহ্‌র নাম পেশ করলেন। কিন্তু তারা উভয়ে হযরত আবু বকরের হাত ধরে বয়আত গ্রহণের জন্য সবিশেষ অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন। অতঃপর উপস্থিত বাকী সবাই বয়আত হওয়ার জন্য হযরত আবু বকরের দিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছুটে গেলেন। এভাবে সূরা নূরের ‘আয়াত ইস্তেখলাফ’ এবং উল্লেখিত হাদীসের ঐশী প্রতিশ্রুতি অনুয়ায়ী ইসলামের প্রথম ধারায় খিলাফত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সবার ঐকমত্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলো। এর পরে পরে ইসলাম ও খিলাফতের বিরুদ্ধে পাহাড়সম বিদ্রোহাত্মক ফেতনা ও বাধা-বিঘ্নগুলো সাফল্যের সাথে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করে খলীফাতুর রসুল হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ইসলামের ভিত্তিকে সুদৃঢ় এবং এর অগ্রযাত্রাকে সুগম করার অসামান্য সৌভাগ্য ও গৌরব লাভ করলেন।

অবিকল একই দৃশ্য ইসলামে খিলাফত প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় ধারায় খলীফাতুল মসীহ্‌ আওওয়াল হযরত মাওলানা হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ)-এর ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। তিনিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিনা বাক্যব্যয়ে প্রথম বয়আতকারী ছিলেন এবং তার অগাধ জ্ঞান-গরিমা, ��াক্‌ওয়া তাহারাতে উচ্চমর্যাদা ও যুগইমাম মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর একনিষ্ঠ আনুগত্য এবং সিলসিলা আহ্‌মদীয়ার অদম্য মহতী সেবার কারণে তিনি জামাআতের সবার শ্রদ্ধার পাত্র ও শীর্ষস্থানীয় বুযুর্গ ছিলেন। আবার হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর ন্যায় তিনিও পরম বিনয়ী ছিলেন এবং খিলাফতের গুরুভার গ্রহনে তিনিও সম্মত হচ্ছিলেন না। কাদিয়ানে জামাআতের প্রতিনিধিগণের (সদর আঞ্জুমানে আহ্‌মদীয়ার সকল সদস্য সহ) মৌখিক অনুরোধ ছাড়াও উপস্থিত সকল আহ্‌মদীর পক্ষ থেকে লিখিত অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি খিলাফতের পদবির জন্য সাহেবযাদা মির্যা মাহমুদ আহমদ, হযরত মির্যা নাসের নওয়াব, হযরত নওয়াব মোহাম্মদ আলী খান, হযরত মৌঃ মোহাম্মদ আহ্‌সান মহোদয়গণের নাম পেশ করলেন। কিন্তু সম্মিলিত ভাবে সমগ্র জামাআত তাঁর হাতেই বয়আত হয়। এমনি ধারায় হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর পবিত্র শবদেহ সমাহিত হওয়ার পূর্বেই তাঁর রচিত ‘আল-ওসীয়্যত’ পুস্তকে লিপিবদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী দ্বিতীয় ঐশী কুদরতের বিকাশ তথা খিলাফত প্রতিষ্ঠার কল্যাণে সমগ্র জামাআত একাত্ম ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়।

হযরত মসীহ্‌ মাওউদ (আঃ)-এর তিরোধানের পর বিরুদ্ধবাদী ও সমালোচকদের বদ্ধমূল ধারনা ছিল, আহ্‌মদীয়া জামাআত নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না। কিন্তু খিলাফতের বরকত ও আশীর্বাদে জামাআতের ঐক্য ও উন্নতি ক্রমবর্ধমান হতে থাকলো। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি (অর্থাৎ মাওলানা মুহাম্মদ আলী প্রমুখ) প্রথমে ধর্মবিশ্বাস ও ভাবধারণার সংস্কার ও পরিবর্তনের দুরভিসন্ধির সূচনা করলেন এবং এর কিছুদিন পরই তারা খিলাফতের পদবি বিলোপ ও অবসানের কুমতলবে মাঠে নামলেন। ‘সিদ্দীকে সানী’ খলীফাতুল মসীহ্‌ আউয়াল হযরত মাওলানা হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ) প্রচন্ড শক্তি ও সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে উক্ত বিভ্রান্তিকর ধ্যান-ধারণা ও অশুভ তৎপরতার মোকাবেলা করলেন এবং তাঁর স্বার্থক প্রচেষ্টা, গভীর তত্ত্বপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী ভাষণ খুতবা ও সদোপদেশাবলীর মাধ্যমে খিলাফতের দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও চিরস্থিতিশীলতার লক্ষ্যে ক্রমাগত বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সারগর্ভ অবদান রাখলেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯১৪ইং সালে তাঁর ইন্তেকালের সময়ে জামাআতের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দ্বিতীয় খলীফাতুল মসীহ্‌ হযরত মির্যা মাহমুদ আহমদ (রাঃ)-এর হাতে বয়আত গ্রহণের মাধ্যমে চিরপ্রতিশ্রুত খিলাফতের ঐশী ব্যবস্থাকে আরও শক্তভাবে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। বিরুদ্ধবাদী সমালোচকদের বিরূপ ধারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো। ষড়যন্ত্রকারীদের সব দুরাশা শূন্যে বিলীন হলো। আজ আল্লাহ্‌ তাআলার ঐশী পরিকল্পনায় খিলাফতে আহ্‌মদীয়ার শতবার্ষিকীর শুভলগ্ন। আহ্‌মদীয়া মুসলিম জামাআত বংশপরাম্পরায় হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ আউয়াল মাওলানা হেকীম নূরুদ্দীন (রাঃ)‌-এর অক্লান্ত পরিশ্রম, কল্যাণময় চেষ্টা-প্রচেষ্টা পবিত্র প্রশিক্ষণ ও পথপ্রদর্শনের জন্য, খিলাফতের ভিত্‌কে সুদৃঢ় করার জন্য তার কাছে চির ঋণী থাকবে। ‘নাওওয়ারাল্লাহু মারকাদাহু ওয়ারফা’ দারাজাতাহু।

আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদিঁও ওয়া আলা আলে মুহাম্মদিওঁ ওয়া আলা আলিহী।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - ৩১শে মে, ২০০৮ইং