হযরত মসীহ মাওউদ (আ:)-এর সাহাবীগণের মালী কুরবানী


১১ই জানুয়ারী ১৯৫৮ ইং এ “আল্-ফযল”-পত্রিকাতে প্রকাশিত প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ

সৈয়্যদনা হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-কে আল্লাহ্‌ তাআলা এমন সত্যবাদী, মুখলেস, যোগ্য ফিদায়ী ও কুরবানীকারী দিয়েছিলেন যাঁরা প্রতি মহূর্তে নিজের শরীর, আত্মা ও সম্পদ তার (আঃ)-এর এক ইশারায় কুরবান করার জন্য তৈরী থাকতেন।
হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) বলেন,

“আমি কসম খেয়ে বলতে পারি যে, আমার জামাতে কমপক্ষে এক লাখ লোক এমন আছে যারা সত্য অন্তকরণে আমার উপর ঈমান এনেছে এবং সৎকর্মের উপর জীবন অতিবাহিত করছে….. আমি দেখছি যে আমার জামাত যেভাবে নেকী ও সততায় বৃদ্ধি পেয়েছে এটাও একটা মোযেজা, হাজার হাজার লোক মনের দিক দিয়ে ফিদায়ী, যদি এখন তাদেরকে বলা হয়, সমস্ত সম্পত্তি ছেড়ে দাও তাহলে তারা ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে”। (সিরাতুল মাহদী, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৬৫)

হযরত হাকীম মৌলভী নূরুদ্দীন সাহেব ভেরী (রাঃ):

সাইয়্যদনা হযরত হাকীম মাওলানা নূরুদ্দীন সাহেব সর্বক্ষণ জীবন, সম্পদ এবং সম্মান উৎসর্গ করে মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর দরবারে উপস্থিত থাকতেন। দেহ, মন ওসমপদ সব কিছু খোদার রাস্তায় কুরবান করে দিয়েছিলেন। তাঁর (রাঃ) এই ত্যাগের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) বলেন,

“তাঁর অর্থ দ্বারা যেভাবে আমি উপকৃত হয়েছি, আমি এর কোন নজির দেখি না, যা এর মোকাবেলায় বর্ণনা করবো। আমি তাকে চরিত্রের দিক থেকে অত্যন্ত প্রশস্থ হৃদয় নিয়ে ধর্মের খেদমতে ত্যাগী পেয়েছি। যদিও তার জীবনের প্রত্যেক দিন এ রাস্তায় ওয়াকফ, সে প্রত্যেক দিক থেকে ‘দ্বীনে হক্ব’ ও আত্মত্যাগের’ প্রকৃত সেবক। কিন্তু এ জামাতের সাহায্যকারীদের মধ্যে যে প্রথম স্থানে। মৌলভী সাহেবের পূর্বোল্লিখিত গুণগুলো যদিও নিজের উদারতার কারণে, এই বাক্যটি তার সত্যায়ন করে কিন্তু তারপরও তিনি বারোশত টাকা নগদ বিভিন্ন প্রয়োজনের সময় এ জামাতের সাহায্যে দিয়েছেন। আর এখন বিশ টাকা মাসিক হিসাবে দেওয়া নিজের উপর ওয়াজিব করে নিয়েছেন। আর এটা ছাড়াও আরো অন্যান্য মালি খেদমতে বিভিন্ন সময়ে তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।” (ইযালায়ে আওহাম-রূহানী খাযায়েন, খন্ড- ৩ পৃষ্ঠা -৫২০)

তারপর হুযূর (আঃ) আরও বলেন,

“আমি তাঁর কিছু ধর্মের খেদমতকে, যা তিনি সবার উপরে স্থান পাওয়া জন্য হালাল সম্পদ থেকে খরচ করেন সবসময় অবাকের সাথে দেখি, হায়! যদি এই খেদমত আমার দ্বারা হতো। তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ সমস্ত শক্তি এবং আসবাবপত্র দ্বারা যা তার সামর্থ্য এবং সহজ লভ্য ছিল সব সময় আল্লাহ্ রসূলের আনুগত্যের জন্য প্রস্তুত থাকতো। আর আমি অভিজ্ঞতা থেকে, শুধুমাত্র সু-ধারণা থেকে নয়, এ জানা প্রকৃত সত্যতা রাখে যে, তিনি আমার জন্য সম্পদ কেন বরং জীবন ও ইজ্জত দিতে কুন্ঠাবোধ করেন না। আর যদি আমি অনুমতি দিতাম তাহলে সব কিছুই এ রাস্তায় কুরবানী করে দিয়ে নিজের রুহানী বন্ধুত্বের ন্যায় প্রতিটি ক্ষণ সান্নিধ্যে থাকার হক আদায় করতেন”। (ফতেহ ইসলাম-রূহানী খাযায়েন, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৩৫)
হযরত খলীফাতুল মসীহ আওওয়াল (রাঃ) হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)-এর নিকট আরজ করেছিলেন,

‘আমি আপনার রাস্তায় কুরবান। আর যা কিছু আছে সেটা আমার নয় আপনার, হযরত পীর ও মুরশীদ আমি সম্পূর্ণ সততার সাথে আরজ করছি আমার সমস্ত সম্পদ ও অর্থ যদি ধর্মের প্রচারের জন্য খরচ হয় তাহলে আমি আমার উদ্দেশ্যে পৌঁছে গেছি।………আর সমস্ত কিছু এ রাস্তায় কুরবানী করার জন্য তৈরী আছি।” (ফতেহ ইসলাম, রূহানী খাযায়েন, খন্ড-৩, পৃঃ-৩৬)

হযরত নওয়াব আলী মুহাম্মদ আলী খান সাহেব মালিরকোটলা (রাঃ):

হযরত নওয়াব সাহেব (রাঃ) মালী কুরবানীতে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তিনি বিভিন্ন সময়ে জামাতকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করেছেন আর বিভিন্ন তাহ্‌রীকে অংশগ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বই সংকলণে সহায়তা, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য, মরকযের লাইব্রেরীতে বই দেওয়ান, দারুল যিয়ফার জমি দান, মিনারাতুল মসীহ কাদিয়ানের জন্য চাঁদা দেওয়া পত্রিকা আল হাকাম ও আল ফযলের জন্য সহযোগিতা, তাহ্‌রীকে জাদীদের পাঁচ হাজার সৈন্যে অংশগ্রহণ এবং গরীবদের প্রতিপালন প্রভৃতি। তাঁর মালী কুরবানীর একটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো,

“করম দীনের মামলার ম্যাজিস্ট্রেট আতমা রামের নিয়্যত ভাল ছিল না, সে হযরত আকদাস (আঃ) কে জেলের শাস্তি দেওয়ার জন্য চাচ্ছিল। সুতরাং ৮ই অক্টোবর ১৯০৪ইং সনে হযরত আকদাস (আ:)-কে পাঁচশত টাকা জরিমানা ও হযরত হাকীম মৌলভী ফজল দীন সাহেবকে দুইশত টাকা জরিমানা আর অনাদায়ে ছয় মাসের জেল ফয়সালা শুনিয়ে দিল। তার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, জরিমানা তাৎক্ষণিক আদায় হবে না আর জেলের শাস্তি হবে কিন্তু এই সাতশত টাকা জরিমানা তাৎক্ষণিক দিয়ে দেয়া হয়েছিল। যার ফলে তার সমস্ত উদ্দেশ্য মাটির সাথে মিশে গেল।। এটা আল্লাহ্‌ তাআলার বিশেষ ফযল ছিল যে, নওয়াব সাহেবের অন্তরে ঢেলে দেওয়া হয়েছে যে, ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ত ভাল নয়। আর তিনি সাবধানতা অবলম্বন করে নয়শত টাকা একদিন পূর্বেই নিজের এক লোকের মাধ্যমে গুরুদাসপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আর এটিই জরিমানা আদায়ের সময় কাজে এসেছে।” (রুফকায়ে আহমদ, খন্ড -২ মুদ্রন দ্বিতীয়, পৃষ্ঠা-৭৮৬)

হযরত হাকীম ফযল দীন সাহেব ভেরী (রাঃ):

হযরত হাকীম ফযল দীন সাহেব ভেরী (রাঃ)ও ধর্মের খেদমতের জন্য অগ্রগামী ছিলেন। ইজালায়ে আওহাম প্রকাশের সময় ছাড়াও তার পূর্বে তিনশত টাকা পাঠিয়ে ছিলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন হুযূর (আঃ)-এর টাকা প্রয়োজন তাৎক্ষণিক আরো একশত টাকা পাঠিয়ে দিলেন। হযরত মসীহ্ মাওউদ (আঃ) বর্ণনা করেন,

“খুশীর কথা হাকীম ফযল দীন সাহেব ত মৌলভী হাকীম নূরুদ্দিন সাহেবের রঙ্গে এমন রঙ্গীন হয়েছেন যে, অত্যন্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে আত্মদানের মাধ্যমে তাঁর থেকে উচুমানের সৎকর্ম সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং এ একশত টাকা কিছু অলংকার কেনা থেকেও বেশী যা শুধু আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য পাঠানো হয়েছে।” (ইজালায়ে আওহাম, রূহানী খাযায়েন, খন্ড-৩, পৃঃ-২৬৩)

হযরত শেঠ আব্দুর রহমান সাহেব (রাঃ):

মাদ্রাজী হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) বর্ণনা করেন,

“শেঠ সাহেব………….শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র ��ন্য আমাদের জামাতে কয়েক হাজার টাকা লাগিয়েছেন। আর করাবর এমন উৎসাহের সাথে খেদমত করেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ পরিপূর্ণ বিশ্বাসে বিশ্বাসী না হয় এমনভাবে খেদমত করতে পারে না। সে আমাদের দরবেশ খানার খরচের মধ্যে প্রথম স্থানের এক খাদেম আর আজ পর্যন্ত এ রাস্তায় একত্রে অনেক বড় পরিমাণ সংখ্যা দান করে আসছেন। এ ছাড়াও তাঁকে আমি দেখছি যে, তিনি একশত টাকা মাসিক সহযোগিতার জন্য নিজের উপর জিম্মা করে রেখেছেন……..তাঁর অর্থ দ্বারা যেভাবে আমি উপকৃত হয়েছি আর হচ্ছি আমি এর নজির দেখি না। এটা খোদার রহমত যে, তিনি এরকম ভালবাসা অন্তরের মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন। এই হাজী শেঠ আব্দুর রহমান সাহেব সেই ব্যক্তি যিনি আথমকে কসম দেয়ার সময় এর জন্য তৈরী ছিলেন যে, যদি আথম কসমের উপর টাকা চায় তাহলে নিজের পক্ষ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা দিতে চেয়েছিলেন।” (আনজামে আথম, রূহানী খাযায়েন, খন্ড-১১ পৃষ্ঠা-৩১২)

হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) হযরত শেঠ আব্দুর রহমান সাহেব মাদ্রজী (রাঃ)’র একজন বন্ধু হযরত শেঠ লাল জী ওয়ালজী সাহেবের উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,

“শেঠ আব্দুর রহমান সাহেব মাদ্রজীর অনেক বড় ব্যবসা ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর সমস্ত টাকা ধীরে ধীরে হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)কে দিয়ে দিয়েছেন। পরে যখন তিনি দেওলিয়া হয়ে গেলেন, তখন তাঁর এক বন্ধু শেঠ সাহেব তাঁকে বললেন আপনি হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) দ্বারা দোয়া করান এর মধ্যে অনেক বড় বরকত হয়। তারপর বললেন আমি তাঁকে মাসিক নজরানা স্বরূপ বড় অঙ্ক পাঠাতাম আপনিও তাঁকে নজরানা পাঠান। সুতরাং তিনি সাড়ে তিনশত টাকা মাসিক নজরানা স্বরূপ পাঠানো শুরু করলেন। মনে হয় তাঁর মধ্যে রূহানীয়্যত ছিল। তা না হলে সে, শেঠ আব্দুর রহমান সাহেব মাদ্রাজীকে বলতেন আপনি দোয়া করিয়ে কি নিয়েছেন। আপনারতো পূর্বের ব্যবসাও নাই। কিন্তু মনে হয় যে, তিনি খুব জানতেন, তিনি যে বরকত পেয়েছেন সেটা হচ্ছে আধ্যাত্মিক। আর তিনিও রূহানী বরকত পাবেন। এইজন্য তিনি শেঠ আব্দুর রহমান সাহেব মাদ্রাজীর নসিহতের উপর আমল করা শুরু করেছিলেন।” (দৈনিক আল্‌ ফজল, ১১ নভেম্বর, ১৯৫৮ইং)

হযরত চৌধুরী রুস্তম আলী সাহেব (রাঃ):

হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) বলেন,

“আমাদের এক বন্ধু চৌধুরী রুস্তম আলী সাহেব তিনি প্রথমে সিপাহী ছিলেন পরে কনষ্টোবল, পরে ইনেস্পক্টর, পরে, প্রসকিউটিং ইন্সপেক্টর হয়েছেন। সেই সময় বেতন খুব অল্প ছিল। এখনতো একজন সিপাহী দামী এলাউন্স অন্যান্য মিলিয়ে প্রায় ষাট টাকা মাসিক হারে পান। কিন্তু সেই সময় সিপাহীরা প্রায় এগারো টাকা পেতেন। থানাদার ৪০ টাকা আর ইন্সপেক্টর ৭৫ বা ১০০ টাকা পেতেন আর প্রসকিউটিং অফিসার ১০০ থেকে কিছু বেশি পেতেন। আমার মনে আছে তিনি তাঁর বেতনের একটি বড় অংশ হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)কে পাঠাতেন। একবার হঠাৎ করে নির্দেশ আসলো তাঁকে পদমর্যাদায় উন্নত করা হলো আর বেতনও বেড়ে গেল। তারপর তাঁর বেতনের যে বাড়তিটুকু ছিল সেটার সবটুকুই হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)কে পাঠিয়ে দিতেন।একবার তিনি হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ)কে যে, চিঠি লিখেছিলেন সেটি হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) আমাকে পড়তে দিলেন। আমি পড়ে বললাম এ চিঠিটি চৌধুরী রুস্তম আলী সাহেবের আর তিনি লিখেছেন যে, আমি তো প্রথমে একশত টাকা পাঠাতাম কিন্তু এখন আমার বেতন আরো ৮০ টাকা বেশি হয়েছে। আর আমি মনে করি যে, এটা শুধু হুযূর (আঃ)-এর দোয়ার বদৌলতে আর আপনার জন্য হয়েছে। এ জন্য এখন থেকে আমি আপনাকে ১৮০ টাকা মাসিক রূপে পাঠাবো। আমি এ বাড়তির হকদার নই বরং আমি তো মনে করি প্রথমের বেতনেরও হকদার নই। সেটাও খোদাতাআলা আমাকে আপনার খাতিরেই দিচ্ছেন।” (দৈনিক আল্‌ ফজল, ১১ নভেম্বর ১৯৫৮ইং)

হযরত ডাঃ খলীফা রশীদ উদ্দিন সাহেব (রাঃ):

হযরত ডাঃ খলীফ রশিদ উদ্দিন সাহেরের মালী কুরবনী উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) বলেন,

“তাঁর মালী কুরবানী এতটুকু বেড়ে গিয়েছিল যে , হযরত (আ:) সাহেব তাঁকে নির্দেশ শুনিয়ে দিয়েছিলেন যে, আপনার কুরবানীর প্রয়োজন নাই। হযরত (আ:) সাহেবের সেই যুগের কথা আমার স্মরন আছে যখন কিনা তাঁর (আ:) উপর গুরুদাসপুরে মামলা হচ্ছিল।আর তখন টাকার খুবই প্রয়োজন ছিল। হযরত (আঃ) সাহেব বন্ধুদের তাহরীক করলেন যেহেতু খরচ বাড়ছে, লঙ্গরখানা দুই জায়গায় হয়ে গেছে একটি কাদিয়ানে আরেকটি গুরুদাসপুরে, এছাড়াও মামলার খরচ হচ্ছে। এইজন্য বন্ধুরা সাহায্য সহযোগিতার দিকে দৃষ্টি দিন। যখন হযরত (আঃ) সাহেবের এ তাহরীক ডাক্তার সাহেবের নিকট পৌছলো তখন ঘটনাক্রমে এমন হলো যে, সেই দিনেই তিনি বেতন প্রায় ৪৫০ টাকা পেলেন। তিনি সমস্ত বেতন সে সময়েই তাঁর (আঃ)-এর খেদমতে পাঠিয়ে দিলেন। একজন বন্ধু জিজ্ঞেস করলো আপনি ঘরের প্রয়োজনের জন্য কিছু রেখে দিতেন। তখন তিনি বললেন খোদার (মামুর ) বলেছেন, ধর্মের জন্য প্রয়োজন, তাহলে আবার কিসের জন্য রাখতে পারি। মোট কথা ডা: সাহেব ধর্মের জন্য এতটুকু বেড়েছিলেন যে, হযরত (আ:) তাকে থামানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। আর তাঁকে বলতে হয়েছে যে, এখন তাকে কুরবানী করার প্রয়োজন নাই।” (দৈনিক আল্‌ ফজল, ১১ই জানুয়ারী ১৯২৭ইং)

হযরত মুন্সী জাফর আহমদ সাহেব কপুরথলী (রাঃ)

“একবার প্রথম যুগে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ:)-এর লূধিয়ানায় কোন জরুরী ইশতেহার ছাপানোর জন্য ষাট টাকার প্রয়োজন পড়লো। সেই সময় হুজুর (আ:)-এর কাছে এ টাকার ব্যবস্থা ছিল না আর প্রয়োজনটি তাৎক্ষনিক ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হুযূর (আ:) হযরত মুন্সী জাফর আহমদকে ডেকে বললেন এই সময়ে এটি গুরুত্বপূর্ন ও জরুরী দেখা দিয়েছে। আপনার জামাত কি এ টাকার ব্যবস্থা করতে পারবে? তিনি (রা:) বললেন পারবে। আর আমি গিয়ে টাকা আনছি। সুতরাং তিনি তখনই কপুরথালায় রওয়ানা দিলেন। আর জামাতের কোন লোককে বলা ছাড়াই স্ত্রীর একটি অলংকার বিক্রি করে দিলেন এবং ষাট টাকা নিয়ে হযরত (আ:) সাহেবের খেদমতে উপস্থাপন করলেন। হযরত (আ:) সাহেব খুব খুশী হলেন এবং কপুরথলা জামাতের জন্য দোয়া করলেন। (কেননা হুযূর (আ:) এটা মনে করেছিলেন যে, এই টাকাটা জামাত ব্যবস্থা করেছিল) কিছু দিন পরে মুন্সী আরোরা সাহেবও লুধিয়ানা গেলেন তখন হযরত (আ:) সাহেব খুবই আনন্দের সাথে বললেন “মুন্সী সাহেব আপনার জামাত খুবই প্রয়োজনীয় সময়ে সহযোগীতা করেছে ” মুন্সী সাহেব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন “হযরত (আ:) কোন সাহায্যটি? আমিতো কিছুই জানিনা! হুযূর (আ:) বললেন “এটাই যা হযরত মুন্সী জাফর আহমদ সাহেব কপুরথালা জামাতের পক্ষ থেকে ষাট টাকা নিয়ে এসেছিলেন” । মুন্সী সাহেব বললেন হযরত মুন্সী জাফর আহমদ সাহেব আমাকে তো এর সম্বন্ধে কিছুই বলেননি। আর না জামাতকে কিছু বলেছেন। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করবো আমাদেরকে কেন বলেননি। এরপর হযরত মুন্সী আরোরা সাহেব ছয় মাস পর্যন্ত হযরত মুন্সী জাফর আহমদ সাহেবের উপর এ জন্য নারাজ ছিলেন যে, আপনি কেন আমাকে এ খেদমত থেকে বঞ্চিত রেখেছেন।” (রুফাকায়ে আহমদ, খন্ড-৬পৃষ্ঠা-৭২)

হযরত মুন্সী শাদী খান সাহেব সিয়াল কোটী (রাঃ)

“হযরত মুন্সী শাদী খান সাহেব কাঠ বিক্রেতা সিয়ালকোট নিজের ঘরের সমস্ত আসবাব বিক্রি করে দিয়ে তিনশত টাকা হুযূর (আ:) এর খেদমতে পেশ করলেন। যার জন্য হুযূর (আ:) সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। যখন মিয়া শাদী খান সাহেব এটি শুনলেন তখন ঘরের যে চারপায়ীগুলো (চৌকির মত) ছিল সেগুলোও বিক্রি করে দিলেন এবং তার টাকাটাও হযরত (আ:) সাহেবের নিকট পেশ করলেন।” (তারিখে আহমদীয়াত, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা- ১২৬-১২৭)

হযরত মসীহ মাউদ (আ:) তাঁর জীবন কুরবানীর উপর সন্তুষ্টির স্বীকৃতি দিতে গিয়ে বলেন,

“দ্বিতীয় নিষ্ঠাবান যিনি এ সময়ে অনেক বড় বীরত্ব দেখিয়েছেন মিয়া শাদী খান কাঠ বিক্রেতা সাকিং সিয়ালকোট সে এখনই এক কাজে দেড়শো টাকা চাঁদা দিয়েছে। আর এখন সে কাজের জন্য আরো ২০০টাকা চাঁদা পাঠিয়ে দিয়েছে। সে এরকম একজন মুতাও������াক্কেল ব্যক্তি যদি তার ঘরের সমস্ত আসবাব দেখা যায় তাহলে মনে হয় সমস্ত সম্পত্তি ৫০টাকার বেশি হবে না। তিনি নিজের চিঠিতে লিখেছে যেহেতু অভাবের সময় আর দুনিয়াবী ব্যবসা স্পষ্ট ধবংস লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাই এর চেয়ে ভাল যে, আমরা দ্বীনি ব্যবসা করি। এ জন্য যা আমার কাছে ছিল পাঠিয়ে দিয়েছি”। (মাজমুয়ায়ে ইশতেহারাত,খন্ড-৩য় পৃষ্ঠা-৩১৫)

হযরত মুন্সী আব্দুল আজীজ সাহেব (রাঃ), উজলভী (রাঃ) ও সিখওয়ানা (রাঃ) ভাতৃবৃন্দ:

হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) এই চার জন বুযুর্গের মালী কুরবানী উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,

“আমি আমার জামাতের মহব্বত্ত এবং নিষ্ঠা দেকে আশ্চার্য হই, এদের মধ্যে থেকে অত্যন্ত স্বল্প উপার্জন কারী যেমন:- মিয়া জামাল উদ্দিন , খায়ের উদ্দিন এবং ইমাম উদ্দিন কাশ্মীরী আমার গ্রাম থেকে কাছে। এরা তিন জন গরীব ভাই, যারা সম্ভবত তিন বা চার আনার মজুরী করে। উৎসাহের সাথে মাসিক চাঁদায় অংশ গ্রহণ করেছে। এদের বন্ধু মিয়া আব্দুল আজিজ পাটোয়ারীর নিষ্ঠায় ও আমি আশ্চর্য হই, অল্প উপর্জন সত্ত্বেও এক দিন একশত টাকা চাঁদা দিয়ে বললো আমি চাই খোদার রাস্তায় খরচ হয়ে যাক । এ একশত টাকা সম্ভবত এ গরীব লোকটি কয়েক বছরে জমা করেছে। লিল্লিহি (আল্লাহর জন্য) জোশে এবং খোদার সন্তুষ্টির জোশে দিয়ে দিয়েছিলেন।” (জামিমা আনজামে আথম, রুহানী খাজায়েন, খন্ড-১১ পৃষ্ঠা- ৩১৩)
অক্টোবর ১৮৯৯ সনে তাঁর (আঃ)-এর ইশতেহার,

“মুন্সী আব্দুল আজিজ সাহেব পাটোয়ারী সাকিং উজলা জিলা গুরুদাসপুর অল্প উপার্জন সত্ত্বেও ১২৫ টাকা দিয়েছেন। মিয়া জামাল উদ্দিন কাশ্মীর সাকিন সিখওয়া জিলা গুরুদাসপুর আর তার দুই ভাই মিয়া ইমামুদ্দীন আর মিয়া খায়ের উদ্দিন ৫০ টাকা দিয়েছেন। এ চার জনের চাঁদার ব্যাপারটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ও ইর্ষারযোগ্য যদিও এটি দুনিয়াবী সম্পদের দিক থেকে অত্যন্ত কম অংশ মনে হয়।” (মজমুয়ায়ে ইশতেহারাত, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা- ১১৬)

হযরত মিয়া মুহাম্মদ হাসান (রাঃ)

“সাহেব বায়তুল মুবারক এর জন্য চাঁদার তাহ্‌রীক করার সময় হযরত আব্দুর রহমান সাহেব লিখেন এই চাঁদার তাহরীক করতে আমি এই কথার প্রকাশ করতেও খুশি হচ্ছি যে, জামাত এই দিকে এক সীমা পর্যন্ত দৃষ্টি দিয়েছে আর কিছু অনুসরণের যোগ্য দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে………. মিয়া মুহাম্মদ হাসান সাহেব দফতরী, দফতর ম্যাগাজিন কাদিয়ান যিনি পূর্বের ক্ষমতা অনুযায়ী নগদ চাঁদায় অংশগ্রহন করেছেন। তার বাচ্চা রহমত আলী দেখলো যে, আমার পিতা অর্থাৎ মিয়া মুহাম্মদ হাসান সাহেব বর্ণিত আমার মরহুমা মায়ের বাকী অলংকার চাঁদা দিয়ে দিয়েছেন। এজন্য মিয়া মুহাম্মদ হাসান সাহেব সমস্ত অলংকার সেই দিনেই বায়তুল মুবারকে চাঁদা হিসেবে দিয়ে দিলেন। যা একজন গরীব মানুষের শক্তির বাহিরে।” (আখবারে বদর, ১৬ই মে ১৯০৭ খৃঃ, পৃষ্ঠা-১০ কলাম-১ও ২)

হযরত হাফেয মঈন উদ্দিন সাহেব কাদিয়ানী (রাঃ)

“হযরত হাফেয মঈন উদ্দিন সাহেবের প্রকৃতিতে এ বিষয়ের বড় জোশ ছিল যে, তিনি জামাতের জন্য কুরবানী করেন। তাঁর নিজের অবস্থা তো এই ছিল যে, অত্যন্ত দরিদ্রতার সাথে (দিন) অতিবাহিত করতেন। এর মধ্যে দুর্বল হওয়ার কারণে কোন কাজ করতে পারতেন না হযরত আকদাস (আঃ)-এর পুরনো একজন সেবক হিসাবে কিছু লোক ভালবাসা ও আন্তরিকতার সাথে তাঁকে কিছু সাহায্য করতেন। কিন্তু হাফেয সাহেবের এ নীতি ছিল এ টাকাগুলোকে যা তিনি এ উপায়ে পেতেন কখনও নিজের প্রয়োজনে খরচ করতেন না। বরং এগুলোকে জামাতের খেদমতের জন্য হযরত আকদাস (আঃ)-এর নিকট পেশ করতেন। আর জামাতের কোন তাহরীক এমন ছিল না যাতে তিনি শরীক হতেন না। যদিও এক পয়সাই হোক না কেন। হাফেয সাহেবের ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে রেখে তাঁর এই কুরবানী সাধারণ হতো না। তিনি কয়েকবার ক্ষুধার্ত থেকেও ধর্মের খেদমত করতেন। হযরত মসীহ্ পাক (আঃ)ও তাঁর এই কুরবানীর প্রশংসা করতেন।” (রুফকায়ে আহমদ, খন্ড-১৩, পৃষ্ঠা-২৯৩)

পুরুষদের সাথে সাথে জামাতে আহমদীয়ার মুবারক মহিলারাও মালী কুরবানীর উচূ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর পরবর্তী বংশধরদের জন্য উৎকৃষ্ট নমুনা রেখে গেছেন। এরকম অসংখ্য নিষ্ঠাবান মহিলা আছেন কিন্তু উদাহরণস্বরূপ দু এক জনের উল্লেখ করছি।

হযরত আম্মাজান সৈয়্যদাহ নুসরত জাঁহা বেগম সাহেবা (রাঃ)

হযরত মসীহ মাওউদ (আঃ) বললেন,

“বয়াতকে বৃদ্ধি করা দরকার আর এর জন্য চাঁদার তাহরীক করা হলো। কিছু বন্ধু চাঁদা লেখানো শুরু করলো। তারপর হুযূর (আঃ) বললেন, আমি ভিতরে, জিজ্ঞেস করে আসি। এই বলে হুযূর (আঃ) ঘরে গেলেন কিছুক্ষণ পরে হুযূর (আঃ) ফেরৎ এসে বললেন, আমি ঘরে বললে তিনি (অর্থাৎ হযরত আম্মাজান) নিজের অলংকার বিক্রি করে এক হাজার টাকা চাঁদা দেওয়ার ওয়াদা করেছেন।” (রেজিষ্টার রেওয়ায়াতে রুফকা, নম্বর ৮, পৃষ্ঠা-১১৬)

হযরত করীম বিবি সাহেবা (রাঃ)

“মোহতরমা করীম বিবি সাহেবা স্ত্রী মুন্সী ইসাম উদ্দিন সাহেব, প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও সবসময় মালী কুরবানীর পথের খোঁজ করতেন। আর অপেক্ষায় থাকতেন কখন মালী কুরবানীর আওয়াজ আসবে আর তিনি সমস্ত কিছু কুরবানী করবেন। যখন হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রাঃ) ‘বায়তুল জিকির’ লন্ডনের জন্য মহিলাদের কাছ থেকে চাঁদার তাহরীক করলেন তখন তার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ অলংকার ছিল। তিনি শুধু একটি অলংকার নিজের মরহুমা মায়ের চিহ্ন স্বরূপ রেখে বাকীগুলো খুশির সাথে উপস্থাপন করে দিয়েছেন।

তিনি মুসিয়া ছিলেন আর ওসীয়্যতের সমস্ত চাঁদা হিসাব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিজের জীবনেই আদায় করে দিয়েছেন। হিস্যায়ে জায়েদাদ এর টাকা একবার আদায় করেছিলেন কিন্তু অফিসের ভুলের কারণে সমস্ত টাকা অন্য একটি খাতে জমা হয়ে গিয়েছিল। কিছু সময় পরে এ ভুলটি ধরা পরেছিল। এর সমাধান কাগজের সংশোধনের মাধ্যমে অতি সহজে করা যেত। কিন্তু তিনি এটা পছন্দ করলেন না যে, যদি ভুল ক্রমেই অন্য চাঁদায় টাকা চলে যায় তাহলে তাকে অন্যখাতে পরিবর্তন করা হোক। সুতরাং তিনি আবার ওসিয়্যতের চাঁদা আদায় করলেন। (রুফকায়ে আহমদ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা- ১৬২)
হযরত মুসলেহ মাওউদ (রাঃ) জামাতে আহমদীয়ার এই নিষ্ঠাবান এবং জীবন কুরবানকারী বন্ধুদের মালী কুরবানীর উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন,

স্মরণ রেখো! যারা আসবে তাদেরকে রিযিক খোদাতাআলা দিবে। কিন্তু প্রথম যারা আসবে তাদের জন্য অনেক বড় বরকত হবে। যে প্রথমে আসবে তার জন্য জান্নাতের দরজা প্রথমে খুলা হবে। আর যে পরে আসবে তার জন্য জান্নাতের দরজাও পরে খুলা হবে।”

পাক্ষিক আহ্‌মদী – সংখ্যা: ১৫ই-৩১শে নভেম্বর, ২০০৬ইং

অনুবাদ: মাওলানা রইস আহমদ, মুবাশ্বের মুরুব্বী