খলীফাতুল মসীহ্‌দের দৃষ্টিতে ঈদুল আযহিয়া

মাহমুদ আহমদ সুমন

ইসলাম ধর্ম বিকশিত হবার বহু পূর্ব থেকেই মর্ত্যবাসীদের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী ও ধর্মের অনুসারী বৃন্দ নানা ভাব ও ভঙ্গিতে ঈদ পালন করতো। কিন্তু তাদের ঈদের নির্দিষ্ট কোন শিক্ষা বা রীতিনীতি ছিল না। একমাত্র ইসলাম ধর্মে ঈদকে সার্বজনীন রূপে রূপায়ন করা হয়েছে এবং ঈদকে ইবাদতে শামিল করা হয়েছে।

ঈদুল আযহিয়া মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বা বড় ঈদ। ঈদুল আযহিয়ার নাম রাখার কারণ হলো এটি কুরবানীর ঈদ। এ ঈদ যিলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ হজ্জের ইবাদতের শেষে উপস্থিত হয়। (হজ্জ ৯ তারিখে হয়)। অনেকে এই ঈদকে ‘বকর ঈদ’ বা বকরী ঈদও বলে থাকেন। হযরত রসূল করীম (সা.) এই ঈদকে ঈদুল আযহিয়া বলেই উল্লেখ করেছেন। লেখার কলেবর না বাড়িয়ে প্রতিশ্রুত মসীহ্ মাওউদ ও ইমাম মাহদী (আ.)-এর খলীফারা ঈদুল আযহিয়া সম্পর্কে যে মত প্রকাশ করেছেন তা তুলে ধরছি।

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.)-এর দৃষ্টিতে ঈদুল আযহিয়া:

“কুরবানীর গোশ্ত আল্লাহ্ তাআলার নিকট পৌঁছায় না।” (সূরা হজ্জ: ৩৮)

কুরবানীর ব্যাপারে খোদা গোশ্তের বুভুক্ষ নন। খোদা পাওয়ার জন্য ‘তাক্ওয়া’ চাই। তিনি আমাদেরকে তাঁর পর্যন্ত পৌঁছাবার একটা উপায় শিক্ষা দিয়েছেন । ‘অধম উত্তমের জন্য কুরবানী করবে।’ তাক্ওয়া তবেই লাভ করা যায়, যদি সীমাতিরিক্ত প্রশংসা না করা হয়। ধর্ম-জ্ঞান লাভ কর। কিন্তু জ্ঞানলালনকে, শিক্ষা কার্যকর করাকে উপরে স্থান দিবে। আমি শুধু শিক্ষার্থীদেরই বলছি না। এখানে যারা আছেন, সকলেই জ্ঞান অন্বেষণ করছেন। সকলেই শিক্ষার্থী। এ খুতবাও এক শিক্ষা। দেখুন, খোদাতাআলা হযরত ইব্রাহীম আলইহিস্ সালামকে আদর্শরূপে উপস্থিত করছেন এবং বলছেন যে, ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালামের ধর্মকে ‘আত্মঘাতি’ ছাড়া কেউ ছাড়তে পারে না। ইব্রাহীম আলইহিস্ সালামকে খোদাতাআলা সম্মানিত করেছেন। তাঁর প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। তিনি আত্ম-সংস্কারকের অন্যতম।

যাবতীয় প্রেম, শত্রুতা ও কার্যে নীচকে উচ্চের জন্য কুরবান করবার প্রতি দৃষ্টি রাখবেন। তাহলে আপনারা ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালামের অনুরূপ পুরস্কার পাবেন। আজ্ঞাপালনকারীদের পথ অবলম্বন করবেন। আমি তো হযরত সাহেবের (অর্থাৎ হযরত মসীহ্ মাওউদ আলাইহিস্ সালাতু ওয়াস্ সালামের) মজলিসেও কুরবানীর শিক্ষাই গহণ করতাম। তিনি যখন কিছু বলতেন, তখন আমি অনুসন্ধান করতাম যে, আমার মধ্যে তো এ দোষ নেই?

খোদাতাআলার হুযুরে প্রিয় হওয়ার জন্য রসূলের অনুবর্তিতা অত্যাবশ্যক।

“বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তবে আমার আদর্শ পালন কর, আল্লাহ্ তাআলা তোমাদেরকে ভালবাসবেন।” (সূরা আলে ইমরান: ৩২)

সারা দুনিয়া কুরবান করে দিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের অনুবর্তিতা করতে হবে। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম কত বড় কুরবানী করেছিলেন যে, খোদাপ্রেম প্রাপ্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে তাঁকে বিশিষ্ট ‘মাহবুব’ বলে দেখা যাচ্ছ।

যে কুরবানী করে আল্লাহ্ তাআলা তার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেন। সে আল্লাহ্ তাআলার ‘অলি’ (বন্ধু) হয়ে পড়ে। তারপর তাকে ‘প্রেম-প্রকাশক’ করা হয়। তারপর আল্লাহ্ তাকে ‘উবুদিয়ত’ দেন। এ মাকামে পৌঁছিয়ে অনন্ত উন্নতি করা যেতে পারে। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকেও আল্লাহ্ তাআলা বলেছিলেন, “আস্লিম” (আত্মসমর্পন কর)। তিনি তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন, ‘আসলামতু লে রাব্বিল আলামীন’ (“আমি সর্বজগতের প্রতিপালকের নিকট আত্ম-সমর্পন করলাম”)

যাহোক ‘উবুদিয়ত’এর এ সম্বন্ধ দৃঢ় হওয়ার পর এতে ‘ইসমাত’ (নিষ্পাপ অবস্থা) জন্মে এবং খোদা তাআলা এরূপ ব্যক্তিকে তবলীগ করবার সুযোগ দেন। তারপর, তার এক প্রকার ধাত (স্বভাজাত চরিত্র) হয়ে পড়ে। কেউ মানুক বা না মানুক তার মধ্যে এক প্রকার সহানুভূতি জন্মে এবং হৃদয়গ্রাহী প্রত্যক্ষ বাক্য দ্বারা সে লোককে সৎকাজের উপদেশ দেয়। তারপর সময় আসে যখন প্রত্যাদেশ হয় যে, লোকের নিকট ‘এরূপ বল’। ব্যক্তি যত উন্নতিই করতে থাকে, খোদার অনুগ্রহ বাড়ে এবং মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেতেই থাকে।

কুরবানীর দৃশ্য বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর। নিজ নিজ আমল (কর্ম) পরীক্ষা করুন। কথা, কাজ, আনন্দ, আচরণ ও লোকের সাথে মেলামেশা সব বিষয়ই ভেবে দেখুন অধমকে উত্তমের জন্য বর্জন করছেন কিনা? যদি করেন, তবে ‘মুবারক’ (ধন্য)।

ত্রুটিযুক্ত কুরবানী আমাদের ছাড়তে হবে। আপনাদের কুরবানীতে কোন প্রকার খুঁত যেন না থাকে। শিং-কাটা, কান-কাটা না হয়। কুরবানীর তিনটি উপায় আছে।

(১) ইস্তেগফার, (২) দোয়া ও (৩) সৎ-সঙ্গ। মানুষ সঙ্গ দ্বারা মহাফল লাভ করে। সাধুসঙ্গ লাভ করবেন। কুরবানীর জন্য তিন দিন। যে আধ্যাত্মিক কুরবানী করে, সে জানে সবই তার জন্য সমান।

(ঈদুল আযহিয়ার খুতবা, ৩ জানুয়ারী, ১৯০৯)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.) এ দৃষ্টিতে ঈদুল আযহিয়া:

হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মরণে আজ কুরবানীর ঈদ; আমি কয়েকবারই বলেছি যে, জনসাধারণ যেভাবে বলে থাকে, হযরত ইসমাঈল (আ.) এর কুরবানী সেই রকমের ছিল না। লোকে বলে থাকে, হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে জবেহ্ করার জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাঁকে জমীনে শায়িত করেছিলেন, কিন্তু পরে খোদা তাআলার কাছ থেকে ইলহাম পেয়ে জবেহ্ করবার সংকল্প ত্যাগ করেন এবং আল্লাহ্‌র ইঙ্গিতে তাঁর স্থানে এক দুম্বা জবেহ্ করেছিলেন। আমি বার বার বলেছি যে, প্রকৃত অর্থে হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে মক্কার মরু প্রান্তরে ছেড়ে আসবার জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। কারণ পানি ও তরুলতাহীন প্রান্তরে বসতি স্থাপন করা এক মস্ত বড় কুরবানী-উদাহরণস্বরূপ যেমন দেখা যায় রাবওয়া মোকামে প্রথম প্রথম কতিপয় ব্যক্তি তাবু খাঁটিয়ে একে আবাদ করবার জন্য বসে গিয়েছিলেন। ঐসব ব্যক্তি প্রকৃত ভাবে তখন ইসমাঈলী সুন্নত পুরা করেছিলেন। তাদের এখানে বসবার একমাত্র উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, রাবওয়া যেন শীঘ্রই আবাদ হয়ে যায়। যদি তারা কুরবানী না করতেন এবং রাবওয়া মোকামে এসে বসতি স্থাপন না করতেন, তাহলে এই শহর প্রতিষ্ঠিত হতো না, এখানে বাজারও বসতো না, ঘরবাড়ীও স্থাপন হতো না এবং এই জায়গা পূর্বের মতই শূন্য প্রান্তর রয়ে যেতো।

…মোট কথা হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর কুরবানীর বিষয়টি ভুল আকারে প্রচারিত করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর স্বপ্নের অর্থ ছিলো যে তিনি স্বেচ্ছায় জেনে বুঝে যে মক্কা জল ও তরুলতাহীন এক প্রান্তর এবং যেখানে কোন আহার্য বস্তু পাওয়া যায় না- সেখানে যেন তিনি আপন স্ত্রী ও পুত্রকে ছেড়ে আসেন। তিনি এমনই করলেন। যখন হযরত ইসমাঈল (আ.) বড় হলেন, তখন তিনি তাঁর সাধুতা ও সততার দ্বারা নিজের চারদিকে এক দল লোক জমা করে নিলেন এবং তাদেরকে নামায, যাকাত, সদকা এবং খয়রাত বিষয়ে শিক্ষা দেন। ওমরা হজ্জের পন্থা প্রতিষ্ঠা করে মক্কাকে আবাদ করতে আরম্ভ করেন। তদনুযায়ী তাঁর কুরবানীর ফলে শত শত বর্ষ থেকে মক্কা আবাদ হয়ে আসছে।

…সুতরাং ঈদুল আযহিয়া কুরবানী নিঃসন্দেহে উক্ত কুরবানীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু এটা সেই কুরবানীর স্মরণে নয় যাতে হযরত ইব্রাহীম (আ.) বাহ্যিকভাবে হযরত ইসমাঈল (আ.) এর গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কুরবানীর ঈদ আমাদের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করে যে, আমরা যেন খোদার উদ্দেশ্যে এবং তারপর ধর্মের জন্যে জঙ্গলে প্রান্তরে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে খোদা তাআলার নাম ঘোষণা করি এবং মানুষকে তাঁর রসূলের কলেমা পড়াই যেভাবে আমাদের সম্মানিত সূফীগণ করে এসেছেন। যদি আমরা এমন করি তাহলে আমাদের কুরবানী হযরত ইসমাঈল (আ.) এর কুরবানীর সমতুল্য হবে।

(১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪ পাক্ষিক আহমদীর সৌজন্যে)

তিনি (রা.) আরো বলেন,

রোযার মাসের ঈদে তো এ বাণী দেয়া হয়েছে, মানুষকে সেই সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকা আবশ্যক যখন প্রভুর পক্ষ থেকে আহ্বানকারী আসে। তারা খাবার, পানীয়, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ব্যস্ত থেকে সময় বের করে তাঁর সাহায্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেভাবে তারা রমযান মাসে এর অনুশীলন করছিল। আর কুরবানীর ঈদে শিখানো হয়েছে কেবল বাহ্যিক পুরস্কারই নয় বরং অভ্যন্তরীণ পুরস্কারের থেকেও যদি পৃথক হতে হয় এবং নিজ প্রাণ উৎসর্গ করতে হয় তাহলেও কুন্ঠাবোধ করে না । যখন তোমাদের মাঝে এ অবস্থা সৃষ্টি হবে তখন তোমাদের ঈদই আসল ঈদ হবে।

সবচেয়ে পূর্ণ মু’মিন নবী হয়ে থাকেন। আর নবীদের নেতা হলেন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আমরা এ পরিপূর্ণ মানুষের সাথে পরিপূর্ণ রঙ্গে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হতে দেখি। তিনি এমন হিজরত করেন যা আর কেউ করে নি। নিজের প্রাণ খোদার পথে উৎসর্গ করেন তো এমনভাবে করেন যা আর কেউ করবে না। এর দৃষ্টান্তও তাঁর মাঝে অতুলনীয়। অবশিষ্ট নবীদের ধর্ম নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিন্তু আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ পুরস্কার লাভ হয় যে, তাঁর (সা.) সিলসিলা (জামাআত) কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। (আল্লাহ্) বলে দিয়েছেন, তোমার বাগান শুকিয়ে যাবে না। যখনই বিপর্যয় সৃষ্টি হবে তখন এক মালিকে পাঠানো হবে। তিনি একে পুনরায় সবুজ-শ্যামল করে দিবেন অর্থাৎ ধর্মের সংস্কারের প্রতি ইঙ্গিত, (সুনানে আবূ দাউদ, কিতাবুল মলাহেম) আল্লাহ্ তাআলা তাঁর (সা.) বাগানের পাদদেশে এমন সব নদ-নদী প্রবাহমান রেখে দিয়েছেন, এগুলো গাছ-গাছালির পাশ দিয়ে চলে এগুলোকে সবুজ-শ্যামল বানিয়ে দেয়। যে-ব্যক্তি এ শিক্ষার ওপর আমল করে সে সালেহ্, শহীদ ও সিদ্দীকদের দলভুক্ত হয়ে যায় আর নিজ যোগ্যতানুসারে ঐশী, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক পুরস্কার থেকে মর্যাদাপুর্ণ অংশ লাভ করে এবং এর বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়ালে সে পরাজিত হয়। দেখ, এক নিরক্ষর থেকে নিরক্ষর আহমদীকেও গয়ের আহমদী মোল্লা ভয় পায়। অতএব একজন আহ্বানকারীর আহ্বান শুনাটাই হলো সত্যিকারের ঈদ।

যেহেতু এটা ঈদ উৎসব তাই লোকেরা কুরবানী করবে। অতএব এটা বর্ণনা করে দেয়াও সমীচীন – “লা ইঁয়া নালাল্লাহা লাহূমুহা ওয়া লা দিমাউহা ওয়া লাকিইঁয়ানালুহুত্তাক্বওয়া মিনকুম” (সূরা হাজ্জঃ ৩৮) অর্থাৎ কুরবানীর মাংস ও রক্ত আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছে না। কেননা, রক্ত তো মাটিতে মিশে যায় আর মাংসও পৌঁছে না। কেননা, তা তো তোমরা খেয়ে ফেল। হাড়-গোড় দূরে ফেলে দেয়া হয়। তাহলে পরে এ কুরবানীর উপকার কী? ওয়া লাকিইঁ য়ানালুহু ত্তাক্ব্ওয়া মিনকুম– তোমাদের তাকওয়া খোদা পর্যন্ত পৌঁছে থাকে। আর এর উদ্দেশ্য এই, নিজ সত্তাকে কুরবানী করে দাও। কুরবানীর সময় মু’মিন অঙ্গীকার করে, যেভাবে এ ছাগল তার মাথা সামনে এগিয়ে দিয়েছে সেভাবেই নিজের আত্মার ধ্যান-ধারণা হে আমার প্রভু! তোমার ইচ্ছার মোকাবেলায় ছুরি দিয়ে কেটে ফেলছি আর এটাই সেই কথা যা খোদার প্রত্যেক আহ্বানকারী নিজ সময়ে আল্লাহ্ তাআলার লোকদের কাছে চেয়ে থাকেন এবং এটা সেই প্রকৃত ঈদ। প্রত্যেক মু’মিনের এটা প্রত্যাশা করা উচিত।

আল্লাহ্ তাআলা সৌভাগ্য দিলে আমরা আত্মার কুরবানী দিতে পারি। দুর্বলতা দূর হোক। পুণ্যবান বান্দাদের ভাল ভাল পুরস্কার লাভ হোক। আর আমাদের সেই ঈদের সৌভাগ্য লাভ হোক যাতে কোন দুঃখ না থাকে। এতে ঈদ পালনকারীদের মাথায় খোদার অনুগ্রহের ছায়া থাক। এ ঈদের দিনে কোন সন্ধ্যা না নামে, আমীন।

(আল্ ফযল ৩১, অক্টোবর, ১৯১৫ ‘খুতবাতে মাহমুদ’-এর বরাতে)

তিনি আরো বলেন,

আজ ঈদুল আযহিয়া। অর্থাৎ কুরবানীর ঈদের দিন। আমি দেখেছি, এমনিতে তো এ ঈদে কেবল হজ্জের উপলব্ধি ছাড়া মুসলমানের সৌভাগ্যশালী লোকেরাও অনেক কম কুরবানী করে থাকে। কিন্তু রসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোটি কোটি উম্মত লাভ হওয়ায় এ ঈদুল আযহিয়া এভাবে হয়ে গেছে। অতএব বলা হয় এখন মুসলমানদের সংখ্যা ৬০ কোটি (বর্তমানে ১২০/২৫ কোটি বলা হয়ে থাকে)। এ ৬০ কোটি মুসলমান থেকে প্রত্যেক কোটিতে একজন মুসলমানও সুন্নতে রসূল (সা.)-এর ওপর সঠিক ভাবে আমলকারী হলে ৬০ ব্যক্তি কুরবানীকারী হিসেবে বের হবে। আর এভাবে প্রতি লাখে এক ব্যক্তি সুন্নতে রসূল (সা.) এর ওপরে আমল করলে ৬ হাজার মুসলমান কুরবানীকারী বের হয়ে আসবে। আর এভাবে এ ঈদ প্রকৃত অর্থে ঈদুল আযহিয়াতে পরিণত হয়ে যায়। যদিও রসূল করীম (সা.) এ ঈদের নাম ঈদুল আযহিয়া রেখে বলেছেন, তাঁর উম্মতকে আল্লাহ্ তাআলা এত বৃদ্ধি করবেন যে, এ উপলক্ষে এদের থেকে খুব কম কুরবানীকারীও যদি হয় তাহলে তাদের কুরবানীর একটি বড় স্তুপ হয়ে যাবে। অতএব এ ঈদ বড়ই জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ হবে যার দৃষ্টান্ত দুনিয়াতে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। এ উপলক্ষে লোকেরা ছাগল, দুম্বা প্রভৃতি কুরবানী করে থাকে কিন্তু কুরআন করীম বলে “লাইয়ানালাল্লাহা লুহুমুহা ওয়ালা দিমাউহা ওয়া লাকিইয়া নালুহু তাক্ওয়া মিনকুম” অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলার কাছে এসব কুরবানীর মাংস বা রক্ত পৌঁছে না বরং কুরবানীকারীদের তাক্ওয়া পৌঁছে থাকে (২২: ৩৮)। অতএব আসল কুরবানী হতো তা, যা মানুষ নিজের ও নিজের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করে থাকে আর এটাই শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ঈদুল আযহিয়া আমাদেরকে এটাই শিখায়। অতএব দেখে নাও যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) হযরত ইসমাঈল (আ.) ও হযরত হাজেরা (রা.)-কে এক পানি বিহীন মরুভূমিতে ছেড়ে আসলেন (১৪: ৩৮) তখন যদিও তিনি স্বয়ং সেই মরুভূমি থেকে বাইরে চলে গেলেন কিন্তু তাঁর কুরবানী ছিল এই, তিনি নিজের স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে আলাদা রেখে দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। তাঁর স্ত্রীর কুরবানী ছিল এই, তিনি নিজের স্বামীর পৃথক হওয়ার কারণে দুঃখ-কষ্ট পেয়েছিলেন। আর নিজের পুত্রের কষ্ট দেখেছিলেন এবং পুত্রের কুরবানী ছিল এই, তিনি নিজের ইচ্ছায় এমন এক মরুভূমিতে বসবাস করলেন যেখানে অনেক দূর দুরান্তেও মানুষ দেখা যেত না। তিনি একাই কেবল ক্ষুধা ও পিপাসার কষ্ট সহ্য করেননি বরং মা-বাবার কষ্টও দেখেছেন। অতএব সেই কুরবানী কোন একক ব্যক্তির ছিল না। হযরত ইব্রাহীম (আ.), হযরত হাজেরা (রা.) ও ইসমাঈল (আ.)-কে এক পানি প্রভৃতি শূন্য মরুভূমিতে ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে এক কুরবানী করতে হয়েছিল। আমি মনে করি প্রকৃতই আজ প্রত্যেক মুসলমান যদি এ অর্থে ঈদ পালন করতে থাকে আর দুম্বা ও ছাগল কুরবানীর সাথে সাথে নিজেদের আর নিজেদের সন্তান সন্তুতির কুরবানী করতে থাকে তাহলে বিশ্বের কোন শক্তি তাদেরকে ধ্বংস করতে পারবে না।

ঈদুল আযহিয়া আমাদের মাঝে এরকম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে চায়। আমরা আমাদের মাঝে যদি ইব্রাহীমি আত্মা সৃষ্টি করে নেই আর পাকিস্তানীরা খোদার পথে মৃত্যুকে বরণ করে নেয় তাহলে তারা অবশ্যই পৃথিবীর ওপর বিজয় লাভ করতে পারে। কিন্তু শর্ত এই, যেভাবে হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্ত্রী ও পুত্রের কী হবে এর কোনই পরওয়া করেন নাই সেভাবে তাদের স্ত্রী পুত্রের কী হবে পাকিস্তানীরাও এটা মনে করবে না। খোদা তাআলা যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে নিজের স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে পানিবিহীন মরুভূমিতে ছেড়ে আসার আদেশ দিয়েছিলেন তখন তিনি এ প্রশ্ন করেননি, হে খোদা! সেখানে তাদের কিভাবে চলবে। বরং তিনি কোন প্রশ্ন না করে খোদা তাআলার আদেশ পালন করেছিলেন আর বলেছিলেন, তারা ক্ষুধায় মারা গেলে মরুক গে। রোদ্রে পুড়লে পুড়ুক গে। আমাকে খোদা তাআলার আদেশ পালন করতেই হবে। পাকিস্তানীদের মাঝে যদি এ আত্মা সৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে তাদের স্ত্রী পুত্রের মরতে হলে মরতে দিতে হবে। তারা জন্মভূমির সুরক্ষার খাতিরে কোন প্রকার বাহানা দেখাবে না। তাহলে দেখতে থাক সফলতা কিভাবে তাদের পদচুম্বন করে। এভাবে এ আত্মা আমাদের জামাআতের লোকদের মাঝেও যদি সৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে আমাদের তবলীগ খুবই ব্যাপকতা লাভ করতে পারে।

…অতএব তোমরা এমন ঈদ উৎসব পালন কর যেভাবে আল্লাহ্ তাআলা আদেশ দিয়েছেন। পরে দেখবে, খোদা তাআলার পক্ষ থেকে কল্যাণরাশি কিভাবে অবতীর্ণ হতে থাকে। খোদা তাআলার রসূল (সা.)-এর প্রতি দুরূদ পাঠাও আর বার বার দুরূদ পড় যা নামাযে তোমাদেরকে শিখানো হয়েছে।

(১৯ জুলাই, ১৯৫৬ রাবওয়ায় প্রদত্ত, আল ফযল, ১০ জুন, ১৯৫৯)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.)-এর দৃষ্টিতে ঈদুল আযহিয়া:

আল্লাহ্ তাআলা আপনাদের সকলের জন্য এ ঈদ এ রঙ্গে মুবারক করেন যে, এ ঈদের সাথে যে সকল কুরবানী ও আত্মত্যাগের সম্পর্ক এবং ঈদের ফলশ্রুতিতে ‘কুরবে ইলাহী’ (ঐশী নৈকট্য) প্রাপ্তির যে সকল পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে তা যেন আল্লাহ্ তাআলা আমাদের জন্য খুলে দেন এবং স্বীয় রহমত ও কল্যাণরাজী দ্বারা আমাদের অভিষিক্ত করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এক রুইয়া (স্বপ্ন) দেখেন এবং তদনুযায়ী এটা বাহ্যত: পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে জবাই করার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা বল্লেন যে, তোমাকে স্বপ্নে যে আদেশ দান করা হয়েছে, তা সন্তানের বাহ্যিক হত্যা বা আত্মহত্যা নয় বরং নফ্‌স এবং সন্তানের কুরবানীর নির্দেশ বহণ করে। মৃত্যুর বিবিধ রূপ ও আকার প্রকৃতি আছে। মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায় অথবা কোন ঘাতকের হাতে প্রাণ হারায়, ইত্যাদি ভিন্ন কারণে জীবন সূত ছিন্ন হয়ে পড়ে। যে মৃত্যু শাহাদত রূপে আসে কিংবা যে মহান কুরবানী হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর নিকট চাওয়া হয়েছিল, তার মোকাবেলায় অপরাপর মৃত্যু কোনই মর্যাদা বা মূল্যবোধ রাখে না। এতদভিন্ন প্রত্যেক মৃত্যুই এক সাময়িক বা তাৎক্ষণিক ব্যাপার, কিন্তু এটা আজীবন ও সার্বক্ষণিক মহান কুরবানীর ব্যাপার, যা মানবাত্মা, তার বিবেক ও আবেগে এক আলোড়ন এবং জগতে এক বিপ্লব সৃষ্টি করে। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা বলেন, আমরা এক স্বর্গীয় উপকরণ স্বরূপ ‘যিবহে আযীম’ বা মহান কুরবানীকে নির্ধারণ করেছি। ইহা এক দিকে যেমন যিবহে আযীম, অন্যদিকে নাযাতেরও কারণ। ইহা মৃত্যুও বটে, আবার জীবনেরও উৎস। সেজন্য “তারাকনা আ’লাইহে ফিল আখেরীন” আমরা এ রীতিকে পরবর্তী জাতিসমূহেও পরিচালিত করেছি, এবং হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে তার পূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং তা চরম শিখরে উপনীত হয়…।

…হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং তাঁর সন্তান ও বংশধরের মাধ্যমে কুরবানীর এই রীতি ও আদর্শ কায়েম করা হয়েছে এবং এতে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অতি মহৎ। সমস্ত প্রাণীই তাঁর জন্য উৎসর্গ হবে, যেমন হজ্জের সময়ে সহস্র সহস্র বা লক্ষ লক্ষ সংখ্যক পশু এ মহান কুরবানী বা আত্মত্যাগের স্মৃতিচারণ হিসাবে প্রতি বৎসরই কুরবানী হচ্ছে। এতে মানুষকে এ সবক বা শিক্ষাই দেওয়া হয়েছিল যে, পৃথিবীর প্রত্যেক সৃষ্টি ও সকল প্রাণীই মানুষের উদ্দেশ্যে কুরবানী হবে, এবং মানুষ খোদার বান্দায় পরিণত হওয়ার জন্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে এরূপ এক জীবন অবলম্বন করবে যার মধ্যে প্রতি মহূর্তে সে এক মৃত্যু নিজের ওপর গ্রহণ করবে। সে তার নফ্‌সকে বিলীন করবে, তবেই তাকে খোদা তাআলার তরফ থেকে এক নতুন ‘নফ্‌স’ বা আত্মা দান করা হবে, যার মধ্য হতে সদা ‘রাজিতু বিল্লাহি রাব্বান’ ধ্বনী উত্থিত হবে। তার নিজের বলে কিছু থাকবে না-না তার নিজস্ব ইচ্ছা ও বাসনা-কামনা, না তার কোন নিজস্ব কথা, না চোখ, না কান। সে খোদা তাআলার কান দিয়ে শুনবে, তাঁর চোখ দিয়ে দেখবে, তাঁর জিহ্বা দিয়ে কথা বলবে। এটা এ অর্থে নয় যে, খোদা তাআলা তাঁর সত্তায় পার্থিব ও বাহ্যতঃ অবতীর্ণ বা রূপান্তরিত হবেন, বরং এটা উত্তেজনাকে এবং তার সকল প্রকার শক্তি, ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে তার রবের জন্য কুরবান করবে। তাহলে খোদা তাআলা তাকে এক নতুন জীবন দান করবেন। সেই নতুন জীবনে অভিষিক্ত হয়ে তার দ্বারা যে কার্যই সম্পাদিত হবে এবং যে সকল শক্তির অভিব্যক্তি ঘটবে তার সম্বন্ধে আমরা আলঙ্করিক বা রূপকের ভাষায় এটা বলতে পারি যে, মানুষ খোদা তাআলার চোখ দিয়ে দেখছে, খোদা তাআলার কান দিয়ে শুনছে, খোদা তাআলার ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়ে অনুধাবন বা প্রত্যক্ষ করছে এবং খোদা তাআলার মুখ দিয়ে তার ভাষণ নিঃসৃত হচ্ছে, অর্থাৎ তার নিজস্ব কোন কিছুই নাই, সব কিছুই সে খোদা তাআলার কাছে সমর্পন করে দিয়েছে। মানুষের এক মৃত্যু তো সাময়িক ভাবে আসে, যা এক মুহূর্তের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু এক মৃত্যু এরূপ আছে, যা মানুষের সমগ্র জীবনকে স্বীয় বেষ্টনীর মধ্যে ধারণ করে। এটাই সেই মৃত্যু যার উৎস হতে অনন্ত জীবনের ধারা উৎসারিত হয়…।

…আল্লাহ্ তাআলার এটাই ফয়সালা যে, সকল মানুষকে একই পতাকার নীচে সমবেত করা হবে। পতাকা হলো হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পতাকা। সমগ্র মানবজাতিকে, তারা দুনিয়ার যে কোন দুর-দুরান্ত অংশেই বাস করুক না কেন, একমাত্র হাত বা মুঠির মধ্যে একত্রিত করা হবে। সেই হাত ও মুঠিই হলো হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাত ও মুঠি, যার সম্বন্ধে খোদা তাআলা বলেছেন যে, ওটা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত নয় এটা আমার হাত। খোদা তাআলার এ হাতের প্রভাব ও পবিত্র শক্তি, ক্ষমতা ও পরাক্রম বর্তমানেও ঠিক সেভাবেই প্রকাশিত হবে যেভাবে ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রকাশিত হয়েছিল।

এ বুনিয়াদী সত্য এবং এ শুভ সংবাদ, আমরা যারা আহমদীয়াতের দিকে আরোপিত হই, আমাদের নিকট কুরবানী চায়-সেই কুরবানী, যা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পুত্রগণ এবং বংশধরগণ খোদা তাআলার সমীপে পেশ করেছিলেন। হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রূহানী পুত্র ও সন্তানগণের নিকটও সেই কুরবানীরই তাকীদ ও দাবী জানায়। এ কুরবানীর জন্য আপনারা প্রস্তুত হন, যাতে আপনারা আল্লাহ্ তাআলার হুকুমত ও কল্যাণরাজীর ওয়ারিশ হতে পারেন। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের সকলকে প্রকৃত কুরবানী পেশ করার তৌফিক দিন।

(১৬ জানুয়ারি, ১৯৭৩ মসজিদে আকসা, রাবওয়া, সাপ্তাহিক বদর, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭৩)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর দৃষ্টিতে ঈদুল আযহিয়া:

আমরা যে পশু কুরবানী করে থাকি তা করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের মধ্যে অধিকাংশই এটা ভুলে যাই যে, প্রত্যেক এই কুরবানীর মাঝে এক পয়গাম (গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা) নিহিত থাকে। আর মৌলিক ও মোক্ষম পয়গাম হচ্ছে এই যে, এইসব কুরবানী (পশুর) মাংস এবং রক্ত আল্লাহ্‌র কাছে যাবে না। তা তোমরা নিজেদের মধ্যেই বন্টন করবে। বড় জোর গবীব ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়ে তার কিছুটা কল্যাণ সাধন করবে এবং এর বিনিময়ে তোমরা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভ করবে। অথবা নিজেদের নিকটাত্মীয় ও প্রিয়জনদের মাঝে মাংস বন্টন করবে। আর ধারায় ‘ইতায়ে-যিল্কুরবা’ (আত্মীয়স্বজনকে দান করার ন্যায় অন্যদেরকেও দান করা) সম্পর্কীয় আদেশটির কিছুটা বাস্তবায়ন ঘটবে। (তাতে সন্দেহ নেই)। কিন্তু এসবই তোমাদের নিজেদের (সীমিত গন্ডীতে) ফায়দার বিষয়। বস্তুত: কুরবানী প্রদানকারী ব্যক্তির তাক্ওয়া (খোদা ভীতি ও প্রীতিমূলক আন্তরিক নিষ্ঠা) খোদা তাআলার সান্নিধ্যে পৌঁছে থাকে। আর এই কুরবানীগুলি যদি তাকওয়া শূন্য হয়, তাহলে এগুলো হয়ে থাকে নিরেট গতানুগতিক প্রথা। এরচে বেশী এগুলোর কোনই মূল্য নেই। আমি অনুভব করেছি, অধিকাংশ কুরবানী প্রদানকারী পশু যবাই পর্যন্তই নিজেদের দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখেন এবং মনে করেন যে, ঐদিন তারা কেবল কতগুলো পশু কুরবানী দিয়ে যাতে এর ফায়দা উঠাতে পারেন। অথচ কুরবানীর যে (যবাই করা সংক্রান্ত আত্মোৎসর্গের) রূহ্ বা চেতনাবোধ রয়েছে, তা তাদের অন্তরে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে ও তা তাদের হৃদয়কে স্পর্শও করে না। অথচ এর মাঝে এক পয়গাম নিহিত রয়েছে। বস্তুত: সে পয়গামটি ইঙ্গিত দিচ্ছে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দিকে। তিনি (আ.) যে তাঁর পুত্র ইসমাঈলের গলায় ছুরি চালাতে অবিচল উদ্যোগ দেখিয়েছিলেন পিতা ও পুত্র (আলায়হুমাস্ সালাম) উভয় নিজ নিজ ভূমিকা পালনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন এবং ঐভাবে নিজেদের কুরবানী দিতে আল্লাহ্‌র সমীপে সমর্পণ করেছিলেন, সেই কুরবানীরই স্মৃতি বহন করে থাকে ঈদুল আযহার এই কুরবানী।

উল্লেখিত সেই কুরবানীর প্রাণ যদি এই কুরবানীগুলোতে সক্রিয় না হয় তাহলে এর কোনও ফায়দা নেই। তা কেবল খাবার-দাবার ও কাবাব তৈরীর একটা সাময়িক প্রথা হিসেবেই অনুষ্ঠিত হয়। এর অধিক কোন মূল্য থাকে না। … আজ এবং ভবিষ্যতেও যখন কুরবানীর পশুর গলায় ছুরি চালানো হয় তখন এদের ছট্ফট্ করতে দেখে আপনারা নিজেদের অন্তরে এই (স্থির) ধারণা পোষণ করবেন যে, আপনাদের আত্মারও অনুরূপভাবে আল্লাহ্‌র হুযূরে কুরবান হওয়া উচিত। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না ওগুলো ছট্ফট্ করতে করতে (অবশেষে) স্থির ও শীতল হয়ে পড়ে, অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না তা খোদা তাআলার সমীপে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত হয়ে প্রশান্তি লাভ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের কুরবানীর রূহ্ আল্লাহ্‌র নিকট গৃহীত হতে পারে না। তখন ঐ রূহ্ ও আত্মচেতনা থেকে মানবজাতি যে ফায়দা লাভ করবে, তা (যদিও) এমনই হবে, যেমন মানুষেরা আপনাদের কাছ থেকে বাহ্যত: মাংস ইত্যাদি পেয়ে থাকে, কিন্তু উল্লেখিত আপনাদের খোদার সমীপে সমর্পিত ও প্রশান্ত আত্মা থেকে মানবজাতি আরও উন্নত ও উৎকৃষ্ট সব রকম ফায়দা লাভ করতে থাকবে। এটা সেই কেন্দ্র বিন্দু যা আপনাদের সব সময় স্মরণ থাকা উচিত এবং আমারও স্মরণ থাকা উচিত। কিন্তু আমরা প্রায়শ: এই জাতীয় মৌলিক বিষয়গুলো ভুলে যাই।

…আমি আশা রাখি, এই কুরবানীর ঈদ অনেক অনেক আনন্দ এবং ঐশী-নৈকট্য লাভের কারণ হবে। এরপর সবশেষে আমি আপনাদের সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, নিজেদের গরীব ভাইদের-দুর্বলদের এবং অসহায়দেরকে কুরবানীতে অবশ্যই স্মরণ রাখুন। নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের এবং নিজেদের জন্যও এক তৃতীয়াংশ স্বচ্ছন্দে রাখুন এবং বন্টন করুন। কিন্তু কিছু অংশ জামাআতের কাছে জমা দিন, যাতে তা গরীব-মিসকীনদের মধ্যে তারা বন্টনের ব্যবস্থা করতে পারেন এবং কিছু অংশ আপনারা নিজেরা আপনাদের চেনা-অচেনা দরিদ্রদের মধ্যে সরাসরিও বন্টন করুন। তাদের আর্থিক অভাব-অনটন লাঘব করতে যদি আপনি সচেষ্ট হন, তা হলে আমি আপনাদের নিশ্চিত আশ্বাস দিচ্ছ যে, তাদের দারিদ্র ও অভাব-অনটনের ওপর আপনাদের দৃষ্টি পড়ার দরুন আল্লাহ্ তাআলার দৃষ্টি আপনাদের ওপর পড়বে এবং আপনাদের দুর্বলতাকে আল্লাহ্ দূর করবেন। অতএব, অনেক বড়ো ব্যবসা! গরীবদের তালাশ করা এবং তালাশ করে তাদের কাছে পৌঁছা এটা হাত ছানি দিয়ে আমন্ত্রণ জানায়, আল্লাহ্ যেন আপনাদেরকে তালাশ করেন এবং আপনাদের কাছে পৌঁছেন। এমনটি হওয়া নিঃসন্দেহে অবধারিত।

(ঈদুল আযহিয়ার খুতবা, ইসলামাবাদ, টিলফোর্ড, ০৪/০৪/১৯৯৮)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ খামেস (আই.)-এর দৃষ্টিতে ঈদুল আযহিয়া:

ঈদুল আযহিয়া উপলক্ষ্যে আজ এবং কালকে পৃথিবীতে অগণিত প্রাণী জবাই হবে। কিন্তু এই কুরবানী এবং ঈদের আনন্দ এটাই কি একমাত্র এর উদ্দেশ্য? ছাগল, ভেরা যা জবাই করা হবে, কাবাব বানানো, খাওয়া, বন্ধু-আত্মীয়স্বজনকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করা এটিই কি কুরবানীর উদ্দেশ্য? এটি কি এমন কাজ, যে কাজে আল্লাহ্ অনেক বেশি সন্তুষ্ট হতে পারেন? বা আল্লাহ্ কি মুসলমানদের বলেছেন যে, আমি আজকে তোমাদের প্রতি একান্ত আনন্দিত, তোমরা ছাগল, ভেরা, গরু বিভিন্ন প্রাণী জবাই করছো তাই। শুধু ঈদগাহে এসে দুই রাকাত ঈদের নামায পড়াই কি যথেষ্ট? আর ইচ্ছা বা অনিচ্ছ সত্বেও খুতবা শুনে নিলাম তারপর ঘরে ছুটে গেলাম আর বিভিন্ন প্রাণী জবাই করবো আর মাংস খাবো। যে দেশগুলোতে বিভিন্ন প্রাণী জবাইয়ের অনুমতি আছে সেখানে নিজেরাই জবাই করে। ইউরোপে এইভাবে অনুমতি নেই কিন্তু এখানে কোন কোন জায়গায় মানুষ কুরবানীর পশু জবাই করে থাকে। তো জবাই করার পর আমরা যদি মনে করি আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি বা করে ফেলেছি। এটা মনে করা যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানে আমি দেখেছি, আমরা ঈদের নামায পড়ে যখন ফিরে আসতাম তখন দেখা যেত যে অনেকেই ঈদের নামাযের ৫/৭ মিনিট পরেই অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের ভিতরেই নিজেদের কুরবানীর পশু জবাই করে ফেলত। এর মধ্যেই দেখা যায় অনেকে গাভীর চামড়াও পৃথক করে ফেলেছে, মাংস কাটতেও দেখা যায়। এতে বুঝা যায় এরা হয়তো ঈদের নামায পড়ে না বা খুতবা শুনে না। কুরবানী পশু জবাই নিয়ে তারা চিন্তিত থাকে যে আমরা তাড়াতাড়ি যাব আর কুরবানীর পশু জবাই করে মাংস খাব।

…কুরবানী করার পিছনে কেবল এটিই উদ্দেশ্য নয় যে পশু কুরবানী করতে হবে তারপর তার মাংস খেতে হবে বরং এই কুরবানী ঈদের পিছনে কুরবানীর একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা হযরত ইব্রাহীম (আ.) থেকে শুরু হয়েছে এবং তাঁর সাথে তাঁর স্ত্রী সন্তানও এ কুরবানীতে অংশ নিয়েছেন। আর যার চূড়ান্ত পরিনতি বা পরিসমাপ্তি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সত্তায় ঘটেছে এবং তাঁর সাহাবীরাও (রা.) তাঁর কল্যাণ থেকে অংশ লাভ করে এর উন্নত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সুতরাং আমাদেরকে এটি দেখতে হবে প্রতি বছর ঈদ আসে তাতে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক মান কিভাবে উন্নত করতে পারি। আমাদের কুরবানীর মান আমরা কিভাবে উন্নততর করতে পারি নতুবা আল্লাহ্ তাআলা তো আমাদের এই ছাগল, দুম্বা, গরু জবাই করার প্রতি তো কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে সে উদ্দেশ্যের পরিপূর্ণকারী দেখতে চান। নতুবা এ পশু কেবল জবাই করার উদ্দেশ্যে করা হয় কুরবানীর উদ্দেশ্যে নয়।

…সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, আমরা প্রতি বছর যখন ঈদুল আযহা উদযাপন করি তখন আমরা যেন এটা সন্ধান করি যা এই কুরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্য। এ কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য কী তা আল্লাহ্ তাআলা এ আয়াতে বর্ণনা করেছেন, বলা হয়েছে “ওয়ালা কি ইয়ানালুহু তাক্ওয়া মিনকুম” আল্লাহ্ তাআলার কাছে তোমাদের তাক্ওয়াই শুধু পৌঁছে। কুরবানীর দর্শনকে বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) বলেন, খোদা তাআলা এই শরীয়তে অর্থাৎ ইসলামে অনেক জরুরী নির্দেশ বর্ণনা করেছেন। মানুষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, সে যেন তার নিজের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য এবং পুরোসত্তাসহ আল্লাহ্ তাআলার পথে উৎসর্গ হয়। সুতরাং বাহ্যিক কুরবানীকে এই অবস্থার একটা নমুনা করা হয়েছে, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হল সেই কুরবানী যার সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কুরবানীর মাংস আল্লাহ্ তাআলার কাছে পৌঁছে না আর রক্তও না কিন্তু তোমাদের তাক্ওয়া খোদা তাআলার কাছে পৌঁছে অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা তা গ্রহণ করেন।’

অর্থাৎ আল্লাহ্কে ততটা ভয় কর যেন তাঁর পথে তোমরা মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। যেভাবে নিজ হাতে পশু জবাই কর একই ভাবে তোমরাও আল্লাহ্ তাআলার পথে জবাই হয়ে যাও।… সুতরাং সকল পাপ থেকে বাঁচার জন্য নাজাত বা মুক্তি তখনই লাভ হয় যদি তাক্ওয়া থাকে, খোদার ভয় ভালবাসা যদি কামেল হয় তাহলেই এটি সম্ভব।… হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) বলেছেন, মুক্তির জন্য কোন রক্তেরও প্রয়োজন নেই আর কোন ক্রুশে মৃত্যুরও প্রয়োজন নেই বরং আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন যে, শুধু একটি কুরবানী আমাদের প্রয়োজন, আর তা হলো নিজের নাফ্‌সের কুরবানী, প্রবৃত্তির কুরবানী। এমন কুরবানীর অন্য ভাষায় যার নাম হল ইসলাম। ইসলামের অর্থ হল জবাই হওয়ার জন্য নিজের ঘাড় আল্লাহ্‌র সামনে রেখে দেয়া। পুরো সন্তুষ্টির সাথে নিজের আত্মাকে আল্লাহ্ তাআলার আস্তানায় সমর্পণ করা এই প্রিয় নাম সমস্ত শরীয়তের প্রাণ এবং সমস্ত শিক্ষার প্রাণ আর এটিই হল ইসলাম।

আল্লাহ্ তাআলার যে নির্দেশ তার ওপর পুরোপুরি আমল করার জন্য প্রস্তুত থাকা আর প্রস্তুত হওয়ার জন্য বড় থেকে বড় কুরবানী বা ত্যাগ স্বীকার জন্য প্রস্তুত হওয়া। হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) বলেছেন, জবাই হওয়ার জন্য আনন্দের সাথে সানন্দে নিজের ঘাড়কে পেশ করা কামেল ভালবাসাকে চায় এবং কামেল ভালবাসার জন্য অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। ইসলাম শব্দ এদিকেই ইঙ্গিত করে যে সত্যিকারের ত্যাগের বা কুরবানীর জন্য কামেল অন্তর্দৃষ্টি এবং কামেল ভালবাসার প্রয়োজন অন্য কোন কিছুর প্রয়োজন নেই।

… আমাদের এইসব পশু কুরবানী তখনই আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হবে যখন কেবল তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করা হবে।

(ঈদুল আযহিয়ার খুতবা, মসজিদ বায়তুল ফুতুহ্, লন্ডন, ২০-১২-২০০৭)

হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কুরবানী সম্পর্কে বলেন:

খোদা তাআলা ইসলামী শরীয়তের মাঝে বহুবিধ আহকাম ও অনুশাসনের দৃষ্টান্ত ও নমুনা স্থাপন করেছেন। সুতরাং মানুষের প্রতি নির্দেশ হচ্ছে, সে যেন তার সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা এবং তার সমস্ত অস্তিত্ব সহকারে খোদা তাআলার পথে উৎসর্গীকৃত হয়। এতএব, বাহ্যিক কুরবানীগুলোকে উক্ত নির্দেশকৃত অবস্থার জন্য নমুনা বা প্রতীকস্বরূপ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য এই কুরবানী বা আত্মোৎসর্গই বটে। যেমন কিনা আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘লাইঁ ইয়ানালাল্লাহা লুহুমুহা ওয়া লা দিমাউহা ওয়া লাকিইঁ ইয়ানালুহুত্ তাক্ওয়া মিনকুম।’ অর্থাৎ আল্লাহর কাছে তোমাদের কুরবানীগুলোর মাংস পৌঁছে না এবং সেগুলোর রক্তও পৌঁছে না। কিন্তু তোমাদের তাক্ওয়া পৌঁছে থাকে। অর্থাৎ তাঁকে এত ভয় কর যেন তাঁর পথে মৃত্যুই বরণ করো এবং তোমরা যেমন নিজ হাতে কুরবানীর পশু যবাই করে থাক, তেমনি ধারায় তোমরাও খোদার পথে যবাই হয়ে যাও। যখন কোন তাক্ওয়া এর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হয়ে থাকে, তখন প্রতীয়মান হবে যে, তা এখনও অপূর্ণ।

পাক্ষিক আহ্‌মদী - সংখ্যাঃ ৩০শে নভেম্বর, ২০০৮ইং