প্রসঙ্গঃ কুরবানী

আলহাজ্জ মোহাম্মাদ মুতিউর রহমান

কুরআন করীমে কুরবানীর পটভূমিঃ

“এরপর সেই পুত্র (অর্থাৎ ইসমাঈল) যখন তার সাথে দৌড়াবার বয়সে উপনীত হলো তখন সে (অর্থাৎ ইবরাহীম) বললো, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখছি, আমি যেন তোমাকে জবাই করছি। অতএব তুমি চিন্তা কর, ‘তোমার কি অভিমত?’সে বলল, ‘হে আমার পিতা! তুমি যে আদেশ পেয়েছ, তা-ই কর,ইনশাআল্লাহ্ তুমি আমাকে অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মাঝে (দেখতে) পাবে।’
এরপর তারা যখন উভয়েই (আল্লাহ্‌র সমীপে) আত্মসমর্পণ করলো এবং সে তাকে জবাই করার জন্যে কপালের ওপুর উপুর করে শোয়ালো, তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম, ‘হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে অবশ্যই পূর্ণ করেছো।’ আমরা এরূপেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি নিশ্চয় এটা ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমরা এক মহান কুরবানীর দ্বারা এ ফিদিয়া (মুক্তিপণ) দিয়েছিলাম। আর আমরা পরবর্তীগণের মাঝে তাকে (সুখ্যাতিতে) প্রতিষ্ঠিত করলাম। ইবরাহীমের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক! এরূপেই আমরা সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয় সে আমাদের মু’মিন বান্দাদের একজন ছিল।”

(সূরা সাফ্‌ফাতঃ ১০৩-১১২)

কুরবানী সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হেওয়া সাল্লামের কয়েকটি হাদীস:

ফিকাহ্ আহ্‌মদীয়ার প্রতি এক নজর

“সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী সুন্নতে মুয়াকিদা ও ওয়াজিব । (ইবনে মাজাহ্, পৃষ্ঠা ২২৬, তিরমিযী আবওয়াবুল আযহিয়া পৃষ্ঠা ১৮১) এতে একটি হিকমত ও প্রজ্ঞা এই, কুরবানী দাতা ইঙ্গিতের ভাষায় একথা স্বীকার করে, যেভাবে এ নিম্নস্তরের পশুটি আমার জন্যে উৎসর্গীকৃত হচ্ছে সেভাবে উচ্চ স্তরের সত্তার উদ্দেশ্যে আমার জীবনকে উৎসর্গ করতে হলো আমি সন্তুষ্টচিত্তে উৎসর্গ করবো। মোট কথা কুরবানী একটি প্রতীকী ভাষা। এর তাৎপর্য হলো এই, যিনি পশু জবাই করেন তিনি নিজের সত্তাকে কুরবানী করার জন্যে প্রস্তুত আছেন।

কুরবানীর জন্যে উট, গুরু, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা থেকে যে কোন পশু জবাই করা যেতে পারে। উট ও গরু সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে এবং ভেড়া ছাগল প্রভৃতি এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে দেয়া যথেষ্ট। আর মানুষ কুরবানী করার নিয়্যত ও উদ্দেশ্যে নিজ পরিবারকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

কমপক্ষে উট ৩ বছরের, গরু ২ বছরের, ভেড়া ছাগল প্রভৃতি এক বছর বয়সের হতে হবে। দুম্বা যদি মোটা তাজা হয় তাহলে ৬ মাসের বয়সের টিতেও কুরবানী বৈধ হবে। কুরবানীর পশু দুর্বল ও ত্রুটিযুক্ত হওয়া উচিত নয়। লেংড়া, কান কাটা, শিং ভাঙ্গা এবং অন্ধ পশু কুরবানী করা বৈধ নয়। এভাবে রুগ্ন জীর্ণ শীর্ণ পশুকেও কুরবানী করা বৈধ নয়।
কুরবানীর সময় হলো ১০ই যিলহাজ্জ ঈদের নামাযের পর থেকে আরম্ভ করে ১২ই যিলহাজ্জ সূর্য ডুবার আগ পর্যন্ত। কুরবানীর মাংস সদকা নয়। অতএব কুরবানীদাতা এ মাংস নিজেও খেতে পারেন এবং আত্মীয়স্বজনও খেতে পারেন। এত্থেকে গরীবদের অংশ দেয়া উচিত। তিন ভাগ করাই উত্তম। এক ভাগ নিজেদের এক ভাগ আত্মীয় স্বজনের এবং এক ভাগ গরীবদের মাঝে বন্টন করা হয় ।”

(ফিকাহ্ আহ্‌মদীয়া থেকে পৃষ্ঠা: ১৮১-১৮৩)

কুরবানীর শিক্ষা ও তাৎপর্য

আজ থেকে থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগের কথা। আল্লাহ্‌র এক নবী ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)। অতি বৃদ্ধ বয়সে জন্ম নিয়েছে একটি ছেলে। এ ছেলে আল্লাহ্‌র মহাদান। তাই খুবই আদরের। নাম তার ইসমাঈল। তিনি যখন তাঁর পিতার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে উপনীত হলেন তখন আল্লাহ্‌র আদেশে হযরত ইবরাহীম (আ.) ইসমাঈল (আ.)-কে জবাই করতে উদ্যত হলেন। একথা আমরা প্রবন্ধের প্রথমে উদ্ধৃত কুরআনের আয়াত থেকে জানতে পারি। আল্লাহ্ তাঁকে (আ.) ডেকে বললেন, হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছো। তিনি ছেলেকে জবাই করলেন না অথচ কিভাবে স্বপ্ন বাস্তবায়িত করলেন এ বিষয়ে আমাদের ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

প্রথম কথা হলো, ধর্মের নামে নরবলি দেয়ার প্রথা বহু আগ থেকে চলে আসছিল। আল্লাহ্ তাআলা রক্ত- পিপাসু নন যে তাঁর প্রিয় সৃষ্টির রক্তে তিনি তুষ্ট হবেন। হযরত ইবরাহীম (আ.) স্বপ্নের নিজ ব্যাখ্যানুযায়ী সন্তান কুরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন। আল্লাহ্ তাআলা নরবলি প্রথাকে চিরতরে রহিত করার জন্য এ জবাই হতে দিলেন না। পরে ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ্‌র আদেশে পশু জবাই করলেন। নরবলি পশু বলিতে রূপান্তরিত হলো।

দ্বিতীয়ত হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর এক-অদ্বিতীয় (বাইবেলে আছে, হযরত ইবরাহীম তাঁর এক- অদ্বিতীয় পুত্র ইসহাককে কুরবানী করছিলেন। হযরত ইসমাঈল প্রথম সন্তান তাই যতদিন ইসহাক জন্মগহণ করেন নি হযরত ইসমাঈলই এক-অদ্বিতীয় সন্তান ছিলেন এবং ইসমাঈলকেই কুরবানী করা হয়েছিল। এখানে বাইবেল ভুল শিক্ষা দিচ্ছে) পুত্র ইসমাইলকে শিশু বয়সেই আল্লাহ্ তাআলার আদেশে মক্কার নিবিড় অরণ্যে তাঁর মাতা হযরত হাযেরা সহ পরিত্যাগ করে এসেছিলেন। এর ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে সেখানে আল্লাহ্‌র পবিত্র ও প্রাচীন কা’বা ঘরের সংস্কার হলো এবং মক্কা নগরী প্রতিষ্ঠিত হলো। আর সেখানে হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশে আবির্ভূত হলেন বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম। এ মহান পরিকল্পনাকে দৃষ্টিপটে রেখে মহান আল্লাহ্ তাআলা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এ মহান কুরবানীকে তাঁর কাছ থেকে কুরবানী গ্রহণ করেছিলেন। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এ মহান কুরবানীকে দুনিয়ার সামনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আল্লাহ্ তাআলা স্বপ্নে এ আদেশ দিলেন আর অমনি হযরত ইবরাহীম (আ.) আসলামতুলি রাব্বিল আলামীন বলে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। মহান কুরবানীর এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর সৃষ্টি হলো দুনিয়াতে। পিতামাতা কর্তৃক অতি আদরের দুলাল দুলালীকে খোদার পথে উৎসর্গ করে দেয়ার প্রথা চালু হলো। এরই অনুকরণে আজ আমরা দেখি আহ্‌মদী জামাআতে ওয়াকফে জিন্দেগী ও ওয়াকেফীনে নও স্কীমের অধীনে সন্তানদের কুরবানী করতে। এ কুরবানী মরার উদ্দেশ্যে নয় বরং একটি জাতি গোষ্ঠীকে জীবিত করার উদ্দেশ্যে।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এ কুরবানীর আত্মা এবং শক্তি নিজেদের মাঝে সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলয়হে ওয়া সাল্লাম তাঁর (সা.) উম্মতকে পশু কুরবানীর আদেশ দিলেন। তাই বিশ্বের প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমান প্রত্যেক বছর ১০ই যিলহাজ্জ তারিখে কুরবানী করে থাকে। হযরত ইসমাঈল (আ.) যেভাবে পিতার ছুরির নিচে মাথা পেতে দিয়েছিলেন, কুরবানীর পশু যেভাবে ছুরির নিচে মাথা পেতে দেয় তেমনই প্রত্যেক মুসলমানের এ প্রতিজ্ঞা হওয়া আবশ্যক যেন ধর্মের খাতিরে ইসলামের পথে তারা নিজেদের এ ভাবে কুরবানী করে দিতে পারে। আবার কুরবানীর পশুর মত নিজেদের পশুত্বকে বলি দেয়ার শিক্ষাও আমরা কুরবানী থেকে পেয়ে থাকি। কেবল গোশ্ত খাওয়াই এ কুরবানীর উদ্দেশ্য নয়। আর এতে আল্লাহ্‌রও কোন উপকার নেই। আল্লাহ্ স্বয়ং বলেছেন,

লা ইয়ানা লাল্লাহা লুহুমুহা ওয়া লা দিআউহা ওয়া লাকিইঁয়ানালাহু তাক্ওয়া মিনহুম

অর্থাৎ ওগুলোর মাংস বা ওদের রক্ত কখনো আল্লাহ্‌র কাছে পৌছে না, বরং তাঁর কাছে তোমাদের পক্ষ থেকে তাক্ওয়া পৌঁছে।

(সূরা হাজ্জঃ ৩৮)

সুতরাং ইবরাহীম (আ.)-এর সুন্নত অনুযায়ী নবী করীম (সা.)-এর নির্দেশে কুরবানী পালনের মাধ্যমে প্রতি বছর মুসলিম নিজের মাঝে তাক্ওয়াকে আর একবার ঝালিয়ে নেন যেন প্রয়োজনের দিনে আল্লাহ্‌র পথে কুরবানীর পশুর ন্যায় নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন।

প্রসঙ্গত কুরবানীর শিক্ষা ও তাৎপর্য না বুঝার কারণে কেউ কেউ কটূক্তি করে থাকেন। তাদের দৃষ্টিতে কুরবানী একদিকে যেমন অপচয় অর্থাৎ একদিনে সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ পশু জবাই করে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিনের ঘাটতি সৃষ্টি করা হচ্ছে অন্যদিকে একটা অবোধ পশুকে আল্লাহ্‌র নামে নৃশংসভাবে হত্যা (!) করার ফলে আর একজনের পুণ্যের হাড়ি ভরতি হচ্ছে।

আপাত দৃষ্টিতে উপরোক্ত উক্তি সঠিক বলে মনে হলেও গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে এটা বোকার উক্তি বলে প্রতীয়মান হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, আল্লাহ্ তাআলা যেসব বস্তু হালাল (বৈধ) করেছেন এর মাঝে যথেষ্ট পরিমাণে বরকত ও প্রবৃদ্ধি রেখে দিয়েছেন। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই গরু ছাগল প্রভৃতির বাচ্চা উৎপাদনের হার কুকুর শূকর ইত্যদির চেয়ে কম-বারেও আর সংখ্যায়ও। কুরবানী এবং মাংস নিষেধ দিবস (Meat less day) ছাড়াও প্রতিদিন বিশ্বে লক্ষ লক্ষ গরু ছাগল ইত্যাদি জবাই হচ্ছে। তবুও আমরা দেখতে পাই পশু পালকের পালন নিঃশেষ হয় না। অথচ বহুগুণে কুকুর শূকর পয়দা হলেও (মুসলমানের জন্যে এগুলো যদিও নিষিদ্ধ) এদের সংখ্যা তুলনামূলক কমই দেখা যায়। রাস্তা ঘাট তো কুকুর শূকর প্রভৃতিতে ভরতি থাকার কথা। যেভাবে গুরু ছাগল প্রভৃতি খাওয়া হয় আল্লাহ্ যদি এগুলোতে বরকত না দিতেন তাহলে এ প্রজাতিগুলো বহু আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিত কেননা এদের খাবার সংকট দেখা দিত।

প্রকৃতির দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই ‘বড়’র বাঁচার জন্যে ‘ছোট’ সব সময় প্রাণ দিচ্ছে। ছোট মাছ বড় মাছের জন্যে জীবন দিচ্ছে। বাঘ, সিংহ প্রভৃতি পশু ছোট ছোট নীরিহ প্রাণী খেয়ে বেঁচে আছে। যারা অতি দরদ দেখিয়ে গুরু ছাগল জবাই করার ব্যাপারে কটূক্তি করেন তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, জীব হত্যা করতে পারবেন না, একথা পালন করলে তারা কি বাঁচবেন? বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, গাছ লতা-পাতা এদের সবার প্রাণ আছে। এদের ওপর আমরা সবাই নির্ভরশীল। তাদের সাথে অসংখ্য জীবাণু আত্মবলি দিচ্ছে। এ কি তাদের জানা আছে। প্রকৃত কথা এই, ক্ষুদ্র’র আত্মত্যাগের মাধ্যমেই বৃহৎ’-এর জীবন আর এর মাঝেই ক্ষুদ্রের জীবনের সার্থকতা রেখে দিয়েছেন আল্লাহ্ তাআলা।

মানুষ সৃষ্টির সেরা। তার সেবায় জীব-জন্তু বৃক্ষ তরুলতা থেকে আরম্ভ করে সব কিছু নিয়োজিত এদের কুরবানীতে মানব জীবন বাঁচে এবং এদের জীবন হয় সার্থক। এ উদ্দেশ্যেই আল্লাহ্ এদের সৃষ্টি করেছেন। তবে এদের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য রয়েছে আমরা তা যেন ভুলে না যাই। অতএব প্রকৃতির মাঝে কুরবানী ও ত্যাগের মহিমাই যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ভাবেই আল্লাহ্ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন।

কুরআন হাদীস এবং বুযুর্গানে দীনের ভাষ্য থেকে যতটুকু জানা যায় কুরবানীর পেছনে যে উদ্দেশ্যটি কাজ করা আবশ্যক তা হলো তাক্ওয়া বা খোদার সন্তুষ্টি। হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর একমাত্র পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে খোদার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করতে উদ্যত হয়েছিলেন। যে কুরবানীর পেছনে এ উদ্দেশ্য ও আত্মা কাজ করে না সে কুরবানী, কুরবানীর আওতায় পড়ে না। আমরা অনেক সময় দেখি নাম ফলানোর জন্যে বা লোক দেখানো ভাব নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভাবে কুরবানী করা হয়। উদ্দেশ্য থাকে গরুর একটা ‘রান’ অমুক বেয়াইর বাড়ীতে, অমুকটা অমুক সাহেবকে দিতে হবে ইত্যাদি। আমরা অনেক সময় দেখেছি সেই ‘রান’টা খুব সাজিয়ে ঢোল বাদ্য সহকারে যথাস্থানে পাঠানো হয়। এটা ঢাকার পয়সাওয়ালা লোকদের মাঝেই বেশি দেখা যায়। আল্লাহ্‌র কাছে এ কতটা গ্রহণীয় তা তিনিই ভাল জানেন।

সামর্থ্য ও বিত্ত বানরাই কুরবানী দিয়ে থাকেন। লক্ষ থাকে যেন ফ্রিজ ভরে রাখতে পারেন এবং অনেক দিন ধরে কুরবানীর মাংস খেতে পারেন। এমনও বলতে শুনা গেছে, এতে নাকি সওয়াব বেশি। গরীবদের ২/১ টুকরা দিয়ে ফ্রিজ ভরে রাখার প্রবণতা গৃহীণিদেরই একটু বেশি। কিন্তু এটা উচিত নয়। যে গরীব জন গোষ্ঠী সারা বছর তেমন মাংস খেতে পারে না সেই দরিদ্র গোষ্ঠী কুরবানীর সময় একটু বেশি করে মাংস খেয়ে সারা বছরের প্রোটিনের অভাব কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবে কুরবানীর এটা একটি বড় উদ্দেশ্য। সামর্থ্যবানগণ তো প্রত্যেক দিনই মাংস খেয়ে থাকেন। কুরবানীর মাংসের মূল্য সাধারণ সময়ের মূল্যের চেয়ে বেশ একটু বেশিই হয়ে থাকে। সুতরাং বেশি দামের মাংস দিয়ে ফ্রিজ ভরতি না করে আগে কম দামের মাংস দিয়ে ফ্রিজ ভরতি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি? আর গরীবদের একটু মাংস বেশি দিয়ে পুণ্যের খাতায় পুণ্য বেশি লেখানো কি বোকামীর কাজ হবে?

মাংস বন্টনের ব্যাপারে জামাআতে আহ্‌মদীয়াতে সুষ্ঠু ব্যবস্থা রয়েছে। কেননা, এখানে রয়েছে খিলাফতের নেযাম। যারা কুরবানী করেন তারা এক তৃতীয়াংশ মাংস জামাআতের ব্যবস্থাপনার কাছে জমা করে দেন। যারা কুরবানী দিতে পারেন না জামাআত আগেই তাদের তালিকা তৈরী করে রাখে আর যথারীতি মাংস বন্টন করে সম্ভব হলে বাড়ী বাড়ী পৌঁছে দেয়া হয়। কোন আহ্‌মদীকে মাংস সংগ্রহ করতে বাড়ী বাড়ী যেতে হয় না। কি সুন্দর ঐশী ব্যবস্থা! খিলাফত আছে বিধায় এ সুন্দর ব্যবস্থা। আল্লাহ্ তাআলা একে চিরস্থায়ী করুন!

এখন হযরত মসীহ্ মাওউদ ও ইমাম মাহ্‌দী (আ.)-এর মলফুযাত থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবন্ধের ইতি টানতে যাচ্ছিঃ

“আসলে এ দিনে গভীর রহস্য এটা ছিল যে হযরত ইবরাহীম (আ.) যে কুরবানীর বীজ বপন করে গিয়েছিলেন এবং গোপনভাবে বপন করেছিলেন আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম এর বায়ু হিল্লোলিত সবুজ শ্যামল ক্ষেত দেখিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (আ.) নিজ পুত্রকে খোদা তাআলার আদেশে জবাই করতে অস্বীকৃতি জানান নি। এতে গুপ্তভাবে এ ইঙ্গিত ছিল, মানুষ যেন দেহমনে খোদার হয়ে যায়। আর খোদার আদেশের সামনে সে তার প্রাণ, নিজ সন্তান-সন্ততি ও তার নিকট আত্মীয় স্বজনের রক্তও তুচ্ছ মনে করে। রসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের যুগে তিনি এমন এক পরিপূর্ণ পথনির্দেশনার দৃষ্টান্ত ছিলেন যে অনেক বেশি কুরবানী দেয়া হয়েছে, রক্তে জঙ্গল প্লাবিত হয়ে গেছে যেন রক্তের নদী প্রবাহিত হয়েছে। পিতা নিজ পুত্রকে, পুত্র নিজ পিতাকে হত্যা করেছেন। এতে তারা আনন্দ পেতেন যে ইসলাম ও খোদার পথে টুকরো টুকরো হয়ে কিমা করা হলেও তাদের আনন্দ হতো। কিন্তু আজ চিন্তা করে দেখ, হাসি-খুশী খেলা তামাশা ছাড়া আধ্যাত্মিকতার কোন অংশ বাকী আছে কি? এ ঈদুল আযহিয়া পূর্বের ঈদের চেয়ে শ্রেয়। সাধারণ লোকও একে বড় ঈদ বলে থাকে। কিন্তু চিন্তা করে বল, ঈদের কারণে কতজন এমন আছে যারা নিজেদের আত্মশুদ্ধি ও নির্মল চিত্ততার প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি দিয়ে থাকে এবং আধ্যাত্মিকতা থেকে অংশগ্রহণ করে থাকে? রমযানের ঈদ প্রকৃতপক্ষে একটি সাধনার ফলশ্রুতি এবং ব্যক্তিগত সাধনা। আর এর নাম বজলুর রূহ অর্থাৎ আত্মাকে বিক্রি করা। আর এ ঈদ যাকে বড় ঈদ বলা হয় এর মাঝে এক মহা সাফল্য নিহিত আছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, এর প্রতি দৃষ্টি করা হয়নি”।

(মলফুযাত ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩১-৩২, ১৯৮৪ সনে মুদ্রিত)

পাক্ষিক আহ্‌মদী – সংখ্যাঃ ৩০শে নভেম্বর, ২০০৮ইং