রমযান

ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ হলো রোযা। বিশ্বের প্রায় সব ধর্মেই কোনো না কোনোভাবে এর চর্চা দেখা যায়। যদিও রোযা রাখার পদ্ধতি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শর্তের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়, তারপরও বলা যায় যে রোযার মূল বিষয়টি সব ধর্মেই এখনো কোন না কোন ভাবে টিকে আছে। যে ধর্মে এর স্পষ্ট উল্ল্যেখ দেখা যায়না সেখানে এর কারণ হতে পারে, সময়ের আবর্তনে ধর্মাবলম্বীদের রোযার বিষয়ে উদাসীনতা যা মানুষ এক পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেছে। এ সম্পর্কিত গৌতম বুদ্ধের ঘটনাটি খুব চমৎকার একটি দৃষ্টান্ত। সত্যানুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি কঠোর সিয়াম সাধনা করেন; কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তা ছেড়ে দেন। কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, কঠোর সাধনার ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তিনি শুধু স্বাস্থ্যগত কারণে রোযা রাখা বন্ধ করেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই এই ধারণায় উপনীত হওয়া যাবে না যে, তিনি রোযা পালনে বিশ্বাসী ছিলেন না। এ কারণেই হয়তো আজো বিভিন্ন স্থানে কিছু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে রোযা রাখতে দেখা যায়। ইসলামী রোযার সঙ্গে এর পার্থক্য থাকলেও তা যে এরই ভিন্ন একটি রূপ বা ধরন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ইসলামে, রোযা ইবাদতের অতি উন্নত একটি রূপ যা সম্পর্কে মানুষকে গভীরভাবে প্রণিধান করা আবশ্যক। রোযা মূলত দু’ধরনের। একটি ফরজ বা অবশ্যপালনীয় এবং অপরটি নফল বা ঐচ্ছিক। ফরজ রোযা আবার দুই রকম:

১. প্রতি বছর পুরো একটি মাস সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য রোযা রাখা আবশ্যক করা হয়েছে। যেহেতু রমযান মাসটি চান্দ্র মাস, তাই সৌর মাসের তুলনায় তা বর্ষপরিক্রমায় পরিবর্তিত হতে থাকে। সৌর বছর হয় ৩৬৫/৩৬৬ দিনে আর এর বিপরীতে ৩৫৪ দিনে চান্দ্র বছর হয়। তাই রমজযান মাস কখনও শীত ঋতুতে আর কখনও গ্রীস্মে আসে। ফলে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুসলমানদের জন্য এটি একটি সার্বজনিন ভারসাম্য সৃষ্টি করে। শীতের সময় দিন ছোট ও রাত বড় হওয়ায় রোযা রাখা সহজ সাধ্য হয়, আবার গরমের দিনে রোযা রাখা কিছুটা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এভাবে একজন মুসলমান জীবনের কিছু সময় অনায়াসে আবার কিছু সময় কষ্ট করে রোযা রাখার সুযোগ পায়।

সুবেহ সাদেক (ঊষার প্রথম আলোকরেখা দেখা দেওয়া ) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়সীমার মাঝে খাদ্য পানীয় পরিত্যাগ ও সঙ্গম বর্জনের নাম হলো রোজা। তবে মনে রাখতে হবে, কেবল বাহ্যিক ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করার নামই রোযা নয়। প্রতিদিন প্রত্যুষে রোযা শুরুর আগে, অর্থাৎ রাতের সময়টুকুও এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। রোযার মাসে রাত্রিকালীণ ইবাদতের অনেক বড় গুরুত্ব রয়েছে। একজন মুসলমানকে ব্যক্তিগত ইবাদতের জন্য [বিশেষত তাহাজ্জুদ নামায আদায় ও কুরআন তেলাওয়াতের জন্য ] সুবেহ সাদেকের কয়েক ঘণ্টা আগেই ঘুম থেকে উঠতে হয়। পবিত্র কুরআন রমযান মাসে অবতীর্ণ হওয়া আরম্ভ হয়। মহানবী (সা।) এ মাসে অজস্র ধারায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতেন তাই তাঁর আদর্শের অনুকরণে মুসলমানগণ দিবারাত্রের বিভিন্ন সময়ে কুরআন পাঠ করে থাকে। রাতের বড় অংশ আধ্যাত্মিকতার চর্চায় কাটানো উচিত এটিই রোযার আসল মাহাত্ম্য।

দিনের বেলায় খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকা ছাড়াও (রোযাদার) মুসলমানদের বৃথা কথাবার্তা, ঝগড়াঝাঁটি এবং এমনসব কাজকর্ম যা সত্যিকারের মুমেনের মর্যাদার পরিপন্থী, তা থেকে বিরত থাকতে বিশেষ নির্দেশ রয়েছে। কোনো প্রকার কামচরিতার্থ করা অনুমোদিত নয়। স্বামী স্ত্রীকেও কেবল সৌজন্যমূলক মানবিক সম্পর্ক ছাড়া তাদের বিশেষ প্রকারের সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি নেই।

ইসলামে দান-খয়রাত করা এবং দুঃস্থদের সেবা করার ব্যাপারে এতো বেশি গুরুত্বারোপ করা হয় যে, এটি এখন মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ; কিন্তু রমযানে মুসলমানদের এক্ষেত্রে প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধি করা আবশ্যক। মহানবী (সা.) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, গরীবদের জন্য খরচ করা তাঁর দৈনন্দিন অভ্যেস ছিল, যার তুলনা বায়ু প্রবাহের সাথে করা হয়েছে, যা অভাবগ্রস্তদের স্বস্তি ও প্রবোধের কারণ ছিল। হাদীস থেকে জানা যায়, রমযানের সময় সেই ‘বায়ু প্রবাহ’ প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় পরিবর্তিত হতো। অর্থাৎ, তিনি (সা.) অনেক বেশি মাত্রায় দান-খয়রাত করতেন। রমযান মাসে দান-খয়রাত করা এবং দুঃস্থদের সেবা করার ওপর এতো বেশি জোর দেওয়া হয়েছে যে, বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে মুসলমানরা রমযান মাসে এই জনহিতকর কাজে অনেক বেশি ব্যাপৃত থাকেন।

২. আরেক ধরনের ফরজ রোযা আল্লাহ্ তা’লা নির্ধারিত করেছেন কাফ্‌ফারা বা পাপের প্রায়শ্চিত্ব হিসেবে। ফরজ রোযা না রাখাটাও এই ধরনের গুনাহের অন্তর্ভুক্ত যার জন্য কাফ্‌ফারা দিতে হয় অর্থাৎ শাস্তি স্বরূপ রোযা রাখতে হয়।

নফল রোযার গুরুত্বও কম নয়। এটি মু’মিনের জীবনের একটি অংশ। যদিও বেশিরভাগ মুসলমান রমযানের ফরজ রোযার বাইরে রোযা রাখেন না, তারপরও কিছু লোক মাঝে মাঝে নফল রোযা রেখে থাকেন। বিশেষ করে যখন তারা বিপদে-আপদে নিপতিত হন তখনই তাদেরকে নফল রোযা রাখতে দেখা যায়। রোযাদারের দোয়া অনেক বেশি গৃহীত হয় তাই মুসলমানরা বিভিন্ন ধরনের বিপদাবলী থেকে বেঁচে থাকার জন্য নফল রোযা রাখেন। তবে মু’মিন মুসলমান কেবল আল্লাহ্ তা’লার বিশেষ সন্তুষ্টি অর্জন ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যেই রোযা রাখেন। রোযা রাখার নিষিদ্ধ কয়েকটি দিন ব্যতীত নফল রোযা রাখার ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ নেই। তবে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মহানবী (সা.) সারা জীবন অব্যাহতভাবে রোযা রাখাকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেছেন। একবার এরকম একটি ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে মহানবী (সা.) অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং যে লোক এভাবে রোযা রেখে জোর করে নাজাত বা মুক্তির চেষ্টা করছিল তাকে তিরস্কার করেন। তিনি (সা.) লোকটিকে বলেন, নিজেকে ক্লেশ ও কষ্টে ঠেলে দিয়ে তুমি কেবল আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টি লাভেই ব্যর্থ হবে না বরং তুমি তাঁর ক্রোধভাজনও হতে পার। মানুষ এক্ষেত্রে কঠোর পন্থা অবলম্বন করে নিজ আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের অধিকারের প্রতি অবহেলা করতে পারে তাই তিনি মধ্যমপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দেন।

মহানবী (সা.) সুনির্দিষ্টভাবে তাকে মানবীয় সম্পর্কের প্রতি সচেতন হওয়ার কথা স্মরণ করান: ‘তুমি আল্লাহ্ তা’লার অধিকার আদায় করো আর একইভাবে তাঁর সৃষ্টির প্রাপ্য অধিকারকেও ন্যায়সঙ্গতভাবে আদায় করো’। তবে রসূল (সা.) হযরত দাউদ (আ.)-এর মতো নফল রোযা রাখার অনুমতি দান করেন। রসূল করীম (সা.) তাদেরকে বলেন, হযরত দাউদ (আ.)-এর এটা নিয়ম ছিল যে, তিনি একদিনের বিরতিতে রোযা রাখতেন। এভাবে একটি প্রতিজ্ঞা অনুসারে হযরত দাউদ (আ.) সারা জীবনব্যাপী একদিন অন্তর একদিন রোযা রেখেছেন। মহানবী (সা.) সে ব্যক্তিকে বলেন,

‘আমি তোমাকে শুধু এতোটুকু অনুমতি দিতে পারি, এর বেশি নয়।’

রোযার বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা মু’মিনের আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে পরিশুদ্ধ করে থাকে। অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি সে ব্যক্তিগত সমাজের বঞ্চিত শ্রেণীর পেটের ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং অস্বাচ্ছন্দ্য কাকে বলে তা উপলব্ধি করতে পারে। বছরের অন্যান্য মাসে অনুমোদিত বিভিন্ন বিষয় থেকে রমযান মাসে রোযা রাখার মাধ্যমে সংযমের চর্চা মানুষের চারিত্রিক পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা রাখে।

চয়ন ও অনুবাদ-ডা. মুহম্মদ সেলিম খান

An Elementary Study of Islam by Hadhrat Mirza Tahir Ahmad (ra.)