কাফের আখ্যা দেয়ার ফেতনা এবং আহমদীদের হত্যা করার ফতওয়া


ইসলামী বিশ্বে পরস্পরকে কাফের আখ্যা দেয়ার ফেতনা এতই ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে, কোন দল বা সম্প্রদায় ইহা হতে নিস্তার পায় নি। পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুসলমান সাংবাদিক মৌলানা আবদুল মজীদ সালেক সাহেব এই – বিষয়ের উপর গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করার পর জামেউশ শাওয়াহেদের ২য় পৃষ্ঠায় বলেন: “ইসলামী বিশ্ব এবং ইসলামের ইতিহাসের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এবং মুসলমান ভ্রাতৃত্বের প্রত্যেক দল কোন না কোন সম্প্রদায়ের তথাকথিত আলেমদের দৃষ্টিতে কাফের, ধর্মত্যাগী এবং ইসলাম বহির্ভূত। শরীয়ত এবং তরীকার জগতে কোন পথাবলম্বী বা কোন জাতি ও কুফরী ফতওয়া হতে নিষ্কৃতি পায়নি”

(মুসলমানে কি তকফীর কা মসআলা মাওলানা আবদুল মজীদ সালেক, পৃঃ ৭-৮, নক্‌শ প্রেস লাহোর, আঞ্জুমান তাহাফফুযে পাকিস্তান, লাহোর)
অত্যন্ত বেদনাদায়ক এই দীর্ঘ ও কষ্টকর ইতিহাসের বর্ণনা তো এই সংক্ষিপ্ত পুস্তিকায় প্রকাশ করা অসম্ভব, তবুও দৃষ্টান্তস্বরূপ নিম্নলিখিত কিছু ফতওয়া উপস্থাপন করা হচ্ছে, যদ্বারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা কিছুটা অনুধাবন করা যাবে।

বেরেলভীদের বিরুদ্ধে দেওবন্দীদের ফতওয়া

দেওবন্দী আলেম সমাজের মতে সকল বেরেলভী মুশরেক কাফের (অংশীবাদী ও অস্বীকারকারী); উদাহরণস্বরূপ লিখেন যে, “যে ব্যক্তি রসূল করীম (সঃ)-কে অদৃশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত বলে বিশ্বাস করে, হানাফী নেতৃবর্গের মতে সে নিশ্চিত অংশীবাদী এবং কাফের”।
(ফতওয়া রশীদিয়া কামেল মুবাওয়েব, রশীদ আহমদ গাংগোহী, পৃঃ ৬২ প্রকাশক মোঃ সাঈদ এণ্ড কোম্পানী, কুরআন মহল, মৌলভী মুসাফের খানার বিপরীতে, করাচী)

শিয়ারাও কাফের

শিয়াদের বিরুদ্ধে নামীদামী দেওবন্দী আলেম সমাজের ইহা সর্বসম্মত ফতওয়া যেঃ
‘শিয়ারা শুধু ধর্মত্যাগী, কাফের বা ইসলাম বহির্ভূতই নয় বরং ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু এবং এমন শত্রু যে তদ্রুপ শত্রু অন্যান্য সম্প্রদায়ে অল্পই পাওয়া যাবে। মুসলমানদের উচিত এরূপ মানুষের সাথে সকল প্রকারের ইসলামী রীতি-নীতির সম্পর্ক বর্জন করা, বিশেষ করে বিয়ে-শাদীর সম্পর্ক।’
(উলামায়ে কেরাম কা মুক্তাফেকা ফতওয়া, দরবারায়ে এরতেদাদ শিয়া এসনা আসারিয়া, প্রকাশক মৌলভী মুহাম্মদ আবদুশ শুক্কুর লাখনৌ, সফর ১৩৪৮ হিজরী)

 

আহলে হাদীসগণও কাফের

‘দেওবন্দের সত্তরজন আলেম দস্তখত করে আহলে হাদীসদিগকে কাফের ফত্ওয়া দিয়েছে এবং লিখেছে যে, তাদের সাথে মিলা-মিশা, তাদেরকে মসজিদে প্রবেশ করতে দেয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ এবং ধর্মের জন্য আশংকা ও অশান্তির কারণ’ (ইশতেহার মতলুয়া ইলেকট্রিক আবুল আলায়ী প্রেশ,আগ্রা)

 

জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ফতওয়া

দারুল উলুম দেওবন্দের পক্ষ থেকে জামাতে ইসলামী সম্পর্কে এই ফতওয়া দেয়া হয়েছে যেঃ ‘এই জামায়াত নিজেদের পূর্বসূরী (মির্জায়ী)দের চেয়েও মুসলমানদের ধর্মের জন্য অধিক ক্ষতিকারক।’
(এস্‌তেফ্‌তায়ে জরুরী, পৃঃ ৩৭, প্রকাশক মুহাম্মদ ওহীদউল্লাহ্ খান, ছাপাখানা মুর্তযা প্রেস, রামপুর, ১৩৭৫ হিজরী)

 

বেরেলভী আলেমদের ফতওয়া

বেরেলভী আলেমরা সকল দেওবন্দী আলেমদের নাম উল্লেখ করে ফতওয়া দিয়েছে যেঃ
‘এরা নিশ্চিত কাফের, ধর্মত্যাগী, তাদের ধর্মত্যাগ ও কুফরী জঘন্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। তা-ও এই ধরনের যে, যদি কোন ব্যক্তি এই ধর্মত্যাগী ও কাফেরদের ধর্মত্যাগ ও কুফরী সম্পর্কে সামান্য সন্দেহও পোষণ করে, তাহলে সে ও তাদের মতই ধর্মত্যাগী এবং কাফের।’
(পোষ্টার ওলামায়ে রেরেলভী উদ্ধৃতি দৈনিক আফাক, ১৮ই নভেম্বর, ১৯৫২)

 

দেওবন্দী ও তদ্রুপ অন্য মতাবলম্বীদের সম্পর্কে মক্কা ও মদীনার আলেমদের ফতওয়া

‘তারা সবাই মুরতাদ। উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে ইসলাম বহির্ভূত। বিধর্মী ও কুধর্মীদের নোংরা সরদার। সকল নোংরা বিশৃংখলাকারী এবং হঠকারীর চেয়েও জঘন্য। এমন দুশ্চরিত্র যে, পথ-ভ্রষ্টতার কারণে সবচেয়ে জঘন্য কাফের প্রতীয়মান হয়। আলেম, ফকীর এবং পুণ্যবানদের বেশ ধারণ করে কিন্তু তাদের অন্তর নোংরামীতে ভরা।’
(হেসামুল হারামাইন আনমনহারিল কুফর ওয়াল মাইন, পৃঃ ৭৩ থেকে ৭৬ লেখক মৌলানা আহমদ রেযা খান, প্রেস আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত, বেরেলী)

 

আহলে সুন্নত আলেমদের ফতওয়া

‘এই যুগে ইসলামকে ওহাবী ও দেওবন্দীদের কোন কোন দল যত ক্ষতি করেছে সমস্ত বাতেল সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবেও এত ক্ষতি করে নি। …ইসলাম হতে পৃথক হয়ে যাবার পরেও এই সম্প্রদায় নিজেদের সুন্নী, হানাফী নামে পরিচয় দেয়, যার ফলে অজ্ঞ সুন্নী-হানাফী ভাইয়েরা ধোঁকা খায় এবং স্বগোত্রীয় মনে করে তাদের সাথে মেলা-মেশা বহাল রাখার কারণে তাদের ধোকার জালে ফেঁসে যায়।’
(ইশতেহার মোঃ ইব্রাহীম ভাগলপুরী ছাপা, বকরী প্রেস)

এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ও প্রখ্যাত আইনবিদ হিসেবে পর্যবেক্ষণ করার পর ১৯৫৩ সালে পাঞ্জাবের বিশৃঙ্খলা সম্পর্কে তদন্ত কমিশনের রিপোর্টে প্রতিভাবান জজ মরহুম জাসটিস মুনীর নিম্নলিখিত রায় দেন, যাহা এ বিষয় সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী। তিনি লিখেনঃ

“যদি কোন ব্যক্তি দাবী করে যে, এই ব্যক্তি বা এই জামাত ইসলামের গণ্ডি বহির্ভুত, তাহলে “মুসলমান কাকে বলে” এই বিষয় সম্পর্কে দাবীকারকের মনে একটি পরিষ্কার ধারণা থাকা আবশ্যক। মোকদ্দমার এই অংশের ফলাফল মোটেও সন্তোষজনক নয়। যদি এরূপ সাধারণ বিষয় নিয়েও আলেমদের মধ্যে এত বিভ্রান্তি থাকে, তাহলে জটিল বিষয়াবলী সম্পর্কে তাদের মতপার্থক্য যে কোন পর্যায়ে উপনীত হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
(রিপোর্ট তাহকিকাতী আদালত, পৃঃ ২৩১ প্রকাশক হক ব্রাদার্স, আনার কলি, ইনসাফ প্রেস, লাহোর)

পরবর্তীতে অভিজ্ঞ বিচারকমন্ডলী ১০টি ভিন্ন সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের দেয়া সংজ্ঞা উল্লেখ করে লিখেনঃ

“ধর্মের কোন দুইজন আলেম এই মৌলিক বিষয় সম্পর্কে একমত নয়। যদি আমরা নিজেদের পক্ষ থেকে মুসলিমের কোন সংজ্ঞা পেশ করি, যেমন প্রত্যেক আলেম করেছে এবং সেই সংজ্ঞা তাদের সংজ্ঞা হতে ভিন্নতর হয়, তাহলে আমাদেরকে সর্বসম্মতভাবে ইসলামের গণ্ডিবহির্ভূত সাব্যস্ত করা হবে। আর আমরা যদি আলেমদের কোন একজনের সংজ্ঞা গ্রহণ করে নেই, আমরা সেই আলেমের দৃষ্টিতে তো মুসলমান থাকবো, কিন্তু অন্য আলেমদের সংজ্ঞানুসারে কাফের সাব্যস্ত হবে” (ঐ পৃঃ ২৩৫)।

 

ভয়ানক ধরনের কুফরী

লুধিয়ানভী সাহেব কুফরীর তিনটি ধরন বর্ণনা করেন। সেগুলো হলো কাফের, মুনাফেক এবং যিনদীক। তিনি আহমদীদেরকে ভয়াবহতম কুফরীর বাহক আখ্যা দিয়ে
যিনদীক (ভয়ানক অবিশ্বাসী) সাবস্ত্য করেন (ঐ পৃঃ ৫)।

এই কথাই অন্যান্য সম্প্রদায়ের আলেমগণ দেওবন্দীদের সম্পর্কে বলেছে, যা মৌলভী সাহেবের নিজ সম্প্রদায়। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ, মৌলভী সাহেব যিনদীক শব্দ ব্যবহার করেছেন; একে বাজে কথা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? মনে হয় মৌলভী সাহেবের
স্মরণপটে বাকী সম্প্রদায়ের ফতওয়াবলীর এই শব্দ জাগ্রত ছিল না। এজন্যই তো নতুনভাবে নিপুণতা দেখানোর প্রয়াস নিয়েছেন।

‘নতুবা যিনদীক’ শব্দটি অনেক আগেই তাদেরই জন্য হারাম শরীফের আলেমগণ প্রয়োগ করে রেখেছেন। এই উদ্দেশ্যে “হিসামুল হারামাইন আলা মনহরিল কুফর ওয়াল মাইন”
পুস্তকটি দেখুন (লেখক মৌলভী আহমদ রেযা বেরলভী খান, পুস্তকের-ছাপাখানা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত, বেরেলী ১৩২৬ হিজরী ১৯০৮ইং)। উহার ৭৩-৭৬ পৃষ্ঠাতে কত বিস্তারিত ও স্পষ্টভাবে এ ফতওয়া লিপিবদ্ধ আছে। এরপর অন্ততঃপক্ষে এই ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন আপনার জন্য সমীচীন নয়।

 

আহমদীদের হত্যা করার ফতওয়া

আহমদীদের ‘অবিশ্বাসী’ আখ্যা দেয়ার পর লুধিয়ানভী সাহেব আমদীদিগকে হত্যা করার ফতওয়া দেন (পৃঃ ৮, ৯)।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা উচিত যে, ইহা নতুন কোন ফতওয়া নয়। উম্মতের শত শত বৎসরের ইতিহাস ইহার সাক্ষী দিচ্ছে যে, বাহ্যিকতার পূজারী ইউসুফ লুধিয়ানভীর স্বগোত্রীয় মৌলভীরা বারংবার অন্যান্য ফেরকার লোকদের শুধু ধর্মত্যাগীই বলে নি, বরং
হত্যাযোগ্য বলে আখ্যাও দিয়েছে। এই ফতওয়া শুধু ফেরকাগুলো পর্যন্তই সীমিত নয় বরং ইসলামের গণ্যমান্য আলেমদের বিরুদ্ধেও অনুরূপ হত্যার ফতওয়া জারী করা হয়, আর তাদেরকে খুন করা বৈধ আখ্যা দেয়া হয়।

সবচেয়ে মর্মন্তুদ- বেদনাদায়ক হল কারবালার ঘটনা যার বেদনা কিয়ামত পর্যন্তও প্রশমিত হবে না, অথচ সেই ঘটনার শিকার হযরত হোসাইন (রাঃ)-কে হত্যা করা বৈধ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে লুধিয়ানভী সাহেবের স্বগোত্রীয় কাযী শোরাইহে। ইহা প্রমাণ
করে যে, তার স্বগোত্রীয় মুফতীদের আবিষ্কৃত ফতওয়া শুধু মাত্র বর্তমান যুগের সাথেই সম্পর্কিত নহে, বরং দীর্ঘ অতীত যমানার সাথেও ইহা সমভাবে সম্পর্কিত। নিম্নে আমরা দৃষ্টান্তরূপে উম্মতের কিছু পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা পেশ করছি যাদের বিরুদ্ধে শুধু কুফরীর ফতওয়াই ছিল না বরং তাদেরকে ভয়ানক ধরনের অবিশ্বাসী বলে ‘হত্যযোগ্য’ আখ্যাও দেয়া হয়েছে।

নম্বর নাম মৃত্যু উদ্ধৃতি
১। হযরত ইমাম আবু হানীফা ১৫০ হিজরী আবাতীল ওহাবীয়া, পৃঃ ১৭
২। হযরত মুহাম্মদ আল্ ফকীহ্ ১৯৩ হিজরী মজমুল মুয়াল্লেফীন, খণ্ড ১১, পৃঃ ১৬৭
৩। হযরত যুননূন মিসরী ২৪৫ হিজরী আলইওয়াকীত ওয়াল জওয়াহের, খণ্ড ১, পৃঃ ১৪
৪। হযরত আহমদ রাওয়ান্দী ২৮৯ হিজরী মজমুল মুয়াল্লেফীন, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ২০০
৫। হযরত ইবনে হান্নান ২৯৭ হিজরী সাপ্তাহিক খুরশীদ সনদীলা ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৮
৬। হযরত মনসুর-হাল্লাজ ৩০৯ হিজরী কামূসুল মশাহীদ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৩৪
৭। হযরত ইমাম গাযযালী ৫০৫ হিজরী আল্‌ গায্‌যালী, পৃঃ ৫৬
৮। হযরত শেখ আবুল হাসান শাযলী ৬৫৪ হিজরী আল্ ইওয়াকীত ওয়াল জওয়াহের, প্রথম খণ্ড, পৃঃ১৩০

 

শত শত নির্যাতিত নিষ্পেষিত আলেমদের মধ্য হতে মাত্র কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা হলো, যাদেরকে বিশ্বাসহীনতার নামে নির্যাতনের লক্ষ্য-বস্তুতে পরিণত করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কুফরীর অপবাদের বেদনা হতে কোন বুযর্গ নিস্তার পান নি।
আহ্‌মদীরা কি সত্যিকারের মুসলমান নয় – পৃষ্ঠা: ১২-১৫