হযরত মির্যা সাহেব জেহাদ রহিত করেছেন – সম্পর্কিত আপত্তির উত্তর


আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে যে সকল পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে, সব ক’টিতেই হযরত মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে এই অপবাদ দেয়া হয়েছে, যে, তিনি জেহাদকে রহিত করেছেন।

উত্তর

জেহাদের ব্যাপারেও বর্তমান যুগের আলেমগণ বিভিন্ন ধরনের ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে হযরত মির্যা সাহেবের উপর অপবাদ দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। পক্ষান্তরে তাদের নেতারাই জেহাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা দিয়েছেন। নিম্নের উদাহরণ ক’টি দেখুন। এরপর, আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিশ্বাস তুলে ধরবঃ

(১) মাওলানা মুহাম্মদ হুসেইন বাটালবী সাহেবের অভিমত যে, “হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম। ইহা দারুল হরব (যুদ্ধের দেশ) নয়। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে বিদ্রোহ যাতে হাঙ্গামাকারীগণ ইংরেজ গভর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করেছিল, উহা দাঙ্গা ছিল, জেহাদ নয়” (ইশায়াতুস সুন্নাহ্, নবম খণ্ড, ১৬ পৃঃ)।

(২)-আল্লামা শিবলী নুমানী বলেন,

“হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর স্বর্ণযুগ হতে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে এই নিয়ম চলে আসছে যে, তারা যে শাসনের আশ্রয়াধীন হয়ে বাস করেছে, তার প্রতি বিশ্বস্ত ও বাধ্য রয়েছে। ইহা শুধু তাদের কর্ম-পদ্ধতি ছিল না, বরং ইহা তাদের ধর্মের শিক্ষা ছিল, যা কুরআন মাজীদ, হাদীস ও ফেকাহ্ প্রভৃতি সকল শাস্ত্রেই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখিত আছে (শিবলীর প্রবন্ধাবলী প্রথম খণ্ড, ১৭১ পৃঃ)।

(৩) সুরেশ কাশ্মিরী সাহেব, যিনি আহ্মদীদের কঠোর শক্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, তিনি “সৈয়্যদ আতাউল্লাহ্ শাহ্ বোখারী” নামক পুস্তকের ১৩১ পৃষ্ঠায় লিখেন,

“মক্কা মোয়ায্‌যমার হানাফী মুফতী জামনদীন ইবনে আব্দুল্লাহ্‌ শেখ উমর, শাফী মুফতী আহমদ বিন জেহেনী এবং মালেকী মুফতী হোসেন বিন ইব্রাহীমের নিকট হতেও ফত্ওয়া আনা হয়েছিল। এই সকল ফতওয়াতে ভারতবর্ষকে দারুল ইসলাম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

(৪) মৌলভী মওদূদী সাহেব লিখেন,

“ভারতবর্ষ ঐ সময় নিঃসন্দেহে দারুল হরব’ (যুদ্ধের দেশ) ছিল, যখন ইংরেজ সরকার এখানে ইসলামী সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যখন তারা পরাজিত হলো, ইংরেজী শাসন কায়েম হয়ে গেল এবং মুসলমান ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সাথে এদেশে বাস করা কবুল করে নিল, তখন আর এদেশ ‘দারুল হরব” রইল না (সুদ প্রথম খণ্ড, ৭৭-৭৮ পৃঃ)।

(৫) মুহাম্মদ আবদুর রহীম রচিত “ইসলামে জিহাদ” নামক পুস্তকে “আমাদের কথা” অধ্যায়ে লেখা আছে – “জেহাদ মানেই যুদ্ধ নয়।”

(৬) শাহ ফয়সল ২৪শে এপ্রিল, ১৯৬৫ইং হজ্জ উপলক্ষ্যে মক্কা মুকর্রমায় রাবেতা আলমে ইসলামীর ইজতেমাতে বলেনঃ “হে সম্মানিত ভাইগণ! তোমাদের সকলকে জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্‌র পতাকাকে সমুন্নত করার জন্য আহ্‌বান করা হয়েছে। জেহাদ কেবল মাত্র বন্দুক উঁচানো, বা তলোয়ার চালানোর নাম নয়। বরং আল্লাহর কেতাব এবং রসূল মকবুল (সঃ)-এর সুন্নতের প্রতি আহ্বান করা। এইগুলোর উপর আমল করা এবং সকল প্রকার মুস্কিল ও অসুবিধা এবং কষ্ট সত্ত্বেও সুদৃঢ়রূপে ইহার উপর কায়েম থাকার নাম জেহাদ। কুরআনের দৃষ্টিতে বড় জেহাদঃ

কুরআন বলেঃ

অর্থাৎ (হে নবী) কুরআন মাজীদ দ্বারা তাদের (কাফেরদের সাথে জেহাদ কর) (ফুরকান, ৫ম রুকূ)।

সুতরাং কুরআনের শিক্ষাকে প্রসারতা দেয়া অর্থাৎ কাফেরগণের মধ্যে দাওয়াত ও তবলীগকে জারী রাখার নাম হলো বড় জেহাদ। আহমদীয়া মুসলিম জামাতও ইহাই বিশ্বাস করে এবং তদনুযায়ী কাজও করে।

হযরত রসূলে করীম (সঃ)-এর দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আঃ)-এর যুগের জেহাদ

হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর যুগে তরবারীর যুদ্ধ হবে না বলে হযরত রসূলে করীম (সঃ) পূর্বে বলে গেছেন,

অর্থাৎ ঃ তিনি (ইমাম মাহ্দী) যুদ্ধকে রহিত করবেন (বুখারী)। এত্থেকেই বুঝা
যায় ইমাম মাহ্দী জেহাদ করবেন বটে, কিন্তু সে জেহাদ অস্ত্র-শস্ত্রের প্রচলিত যুদ্ধ নহে যা অকল্যাণকে ডেকে আনে, বরং উপরোক্ত কুরআনী নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের যুক্তি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাহায্যে সত্যের শত্রুদের সাথে গুরুত্বপূর্ণ জেহাদ করবেন। এ যুগে কলম দ্বারাই এ জেহাদ সাধিত হবে। যেমন ইমাম মাহ্দী (আঃ) বলেছেনঃ “অসির কাজ আমি সেধেছি মসীতে।” দাজ্জাল ইয়া’জুজ মা’জুজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আল্লাহর রসূল (সঃ) বলেছেনঃ

অর্থাৎঃ  এদের সাথে অস্ত্রের বা শক্তির যুদ্ধ করার ক্ষমতা কাউকে দেয়া হয় নি (মুসলিম)।

উপরে কুরআন ও হাদীসের আলোকে জেহাদের আসল রূপ তুলে ধরলাম। জেহাদ তিন প্রকারের-১ । নফসের জেহাদ ২। প্রাণের জেহাদ। ৩। ধন-সম্পদের জেহাদ। হযরত রসূল করীম (সঃ) ইমাম মাহদীর যুগে তরবারীর জেহাদ রহিত হবার ঘোষণা নিজেই দিয়েছেন। কিন্তু বাকি দু’ প্রকারের জেহাদ তো রহিত করেন নি। হযরত মির্যা সাহেবের উপর যে অপবাদ দেয়া হয় যে, তিনি জেহাদ হারাম করেছেন, তা বিভ্রান্তিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমার আবেদন হযরত মির্যা সাহেবের এমন দাবী পেশ করুন যাতে হযরত মির্যা সাহেব সর্বপ্রকার জেহাদকে চিরতরে হারাম বলেছেন।

হযরত মির্যা সাহেব বলেনঃ
“কোন কোন অজ্ঞ লোক আমার উপর অপবাদ দিয়ে থাকে যে, আমি ইংরেজদের রাজত্বে বসবাস করি বলে জেহাদ নিষেধ করি । এই অজ্ঞ ব্যক্তিগণ এ কথা বুঝে না যে, আমি যদি মিথ্যা কথা দ্বারা এই গভর্নমেন্টকে খুশী করতে চাইতাম, তবে কেন আমি পুনঃ পুনঃ একথা বলতাম যে, ঈসা ইবনে মরিয়ম (আঃ) ক্রুশ হতে মুক্ত হয়ে কাশ্মীরের অন্তর্গত শ্রীনগরে স্বাভাবিকভাবে প্রাণ ত্যাগ করেছেন। তিনি খোদাও ছিলেন না খোদার পুত্রও না। আমার এই উক্তিতে ধর্মপ্রাণ ইংরেজ কি সন্তুষ্ট হবেন? অতএব, শুনে রাখো! হে অজ্ঞ ব্যক্তিগণ! আমি এই গভর্নমেন্টের তোষামোদকারী নই। বরং প্রকৃত কথা এই যে, ইংরেজ গভর্নমেন্ট ইসলাম ধর্মে এবং ধর্মের রীতিনীতিতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করে না এবং স্বধর্মের উন্নতিকল্পে আমাদের প্রতি তরবারীও চালায় না। এরপর গভর্নমেন্টের সাথে ধর্মযুদ্ধ করা কুরআন শরীফের শিক্ষানুসারে নিষিদ্ধ, কারণ তারাও কোন ধর্মযুদ্ধ করে না (কিশতিয়ে নূহ)

 

সুধীবৃন্দ! এই ছোট পুস্তিকায় আহমদীয়া মুসলিম জামাতের উপর আরোপিত অপবাদসমূহের উত্তরে সংক্ষিপ্ত যে দলীল প্রমাণ দেয়া হয়েছে তা সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট। সত্য কথা এই আহমদীয়া মুসলিম জামাতের সত্যতা সম্পূর্ণভাবে কুরআন হাদীসের দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এ জামাত সকল ত্রুটি-বিচু্যতি ও ভেজালমুক্ত সেই আদি অকৃত্রিম ও জিন্দা ইসলামকে অনুসরণ করে, যা আঁ হযরত রসূলে মকবুল (সঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত হয়েছিল। এই ইসলাম ও ইহার প্রচারক মাহ্দী মসীহে মাওউদ (আঃ) এর স্বপক্ষে হাজার হাজার ঐশী নিদর্শনাবলী প্রকাশিত হয়ে চলেছে। আকাশ হতে প্রমাণের ঢল নেমেছে। পাতাল ভেদ করে তাঁর সত্যতার প্রমাণ দৃশ্যমান হচ্ছে, পৃথিবীর নিত্য বিরাজিত প্রকৃতি নিত্যই তার স্বপক্ষে নব নব প্রমাণ উপস্থিত করছে। জীব-জন্তু, নদী-সাগর, মানব-সমাজ সর্বত্রই দিবালোকের স্পষ্টতায় তার সত্যতার স্বপক্ষে প্রমাণ প্রকাশিত করে চলেছে।

আসুন! নিরপেক্ষ (Unbiased) মন নিয়ে চিন্তা করুন, উপলব্ধি করুন! আপনার হৃদয়েও রহমানুর রহীম খোদা তার মাহ্দীর সত্যতা প্রকাশ করে দিবেন। তখন ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম চেহারা নিশ্চয় আপনার নজরে ধরা পড়বে। আপনি ধন্য হবেন।

আহমদীয়া মুসলিম জামাতের পবিত্র দায়িত্ব সমগ্র বিশ্বে পবিত্র কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্’র পতাকাকে সদা সমুন্নত রাখা। কারণ সেই দিন দূরে নহে যখন সারা বিশ্বে একই নবী হবেন যিনি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ব্যতীত অন্য কেহ নহেন; একই ধর্ম হবে, যা ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছু নহে এবং একই কলেমা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ । আর এ পবিত্র দায়িত্ব পালনে আল্লাহতাআলা আমাদের সকলকে সর্বতোভাবে সাহায্য করুন, আমীন।

অন্যান্য উত্তর