নবী-রসূল হবার দাবী বিষয়ক আপত্তির উত্তর


আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকায় এই অপবাদ দেয়া হয়েছে যে, তিনি স্বাধীন ও কিতাবওয়ালা স্বতন্ত্র নবী ও রসূল হবার দাবী করেছেন। কিন্তু এ কথা মিথ্যা। তিনি ইসলামী শরীয়তের অধীনে হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাহের গোলামীতে ‘উম্মতী নবী’ হবার দাবী করেছেন,
প্রতিশ্রুত ঈসা নবী ও ইমাম মাহ্দী হবার দাবী করেছেন। হযরত মির্যা সাহেবের দাবীর বিরুদ্ধে তাদের পুস্তকে কুরআনের কিছু আয়াত ও হাদীস পেশ করা হয়েছে। খোদাতাআলার ফযলে অধিকাংশ কুরআনী আয়াত ও হাদীসের প্রকৃত ব্যাখ্যা আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকায় দেয়া হয়েছে এবং প্রমাণ করা হয়েছে যে, তাঁর দাবী কুরআন হাদীসের বিরোধী নয়। যে সকল আয়াত ও হাদীসের যে ব্যাখ্যা আহমদীয়া মুসলিম জামাতের পক্ষ হতে দেয়া হয়েছে, তা এ পর্যন্ত কেউ খণ্ডন করতে পারে নি। হযরত মির্যা সাহেবের বিরুদ্ধে যে সকল হাদীস পেশ করা হয়েছে, তার মধ্যে যে দু’টি প্রধান সে দু’টি হাদীসকে বেছে নিয়ে আপত্তির খন্ডন করবো, ইনশাআল্লাহ্।

প্রথম হাদীস

অর্থাৎ (হে আলী!) তুমি কি পসন্দ কর না আমার সাথে তোমার সেই সম্পর্ক স্থাপিত হোক যেরূপ সম্পর্ক হারূনের সাথে মূসার ছিল। কিন্তু আমার পরে নবী নাই (মসনদ আহমদ বিন হাম্বল, প্রথম খণ্ড, ১৮২ পৃষ্ঠা)।

দ্বিতীয় হাদীস

অর্থাৎ আকেব সেই ব্যক্তি যার পরে কোন নবী নেই (বুখারী কিতাবুল ফাযায়েল বাবু আসমাইন্নাবী)

নবুওয়তের বিষয়টি এমনিতেই একটি সংবেদনশীল ব্যাপার। কাজেই এ ব্যাপারে কুরআন হাদীস ও পূর্ববর্তী বুযর্গানে দীনের কালাম উদ্ধৃত করে আমি এ বিষয় সম্বন্ধে আপত্তি খন্ডাবার চেষ্টা করব।

উত্তর

হযরত রসূলে করীম (সঃ) শেষ শরীয়তবাহী নবী। তাঁর (সঃ) পরে আর কোন শরীয়তবাহী নবীর আবির্ভাব হবে না । স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র নবীর অথবা শরীয়তবাহী নবীর আগমনও চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে। তবে মহানবী (সঃ)-এর অনুসরণের ফলে এই উম্মতে নবীর পর্যায়ের লোকেরও আবির্ভাব হবে। বড় নবীর উম্মত বড়! পূর্ববর্তী নবীদেরকে মেনে তাদের উম্মত সিদ্দীক পর্যন্ত হতে পারত (সূরা হাদীদ: ২০)। কিন্তু মহানবী (সঃ)-কে অনুসরণ করে তাঁর উম্মতের মধ্যে নবীও সৃষ্টি হতে পারে:- ওমাইঁ ইউতি ইল্লাহা ওয়ার রসূলা ফাউলায়েকা মাআল্লাযীনা আনা’আমাল্লাহু আলায়হিম মিনান্নাবীঈনা ওয়াস্ সিদ্দীকিনা ওয়াশশুহাদায়ে ওয়াস্ সলেহীন (সূরা নিসা, ৯ রুকূ)।
এই আয়াতে নবী করীম (সঃ)-কে অনুসরণ করে, সিদ্দীক, শহীদ এবং সালেহ হওয়া যায় বলে কুরআনই ঘোষণা করেছে। হযরত আলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রসূলে করীম (সাঃ) বলেছেন, এই উম্মতের নবীদের পরেই সবচেয়ে উত্তম হলেন আবুবকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ) (কানযুল উম্মাল, ইবনে আসাকির)।

হযরত ঈসা (আঃ), যিনি কেবল বনী ইসরাঈলের জন্য নবী ছিলেন (সূরা আলে
ইমরান, ৯০), তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। অতএব, এই মৃত্যুপ্রাপ্ত নবী আর কখনও পুনর্জীবিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন না। তবে শেষ যুগে অপর এক ঈসা নবীর আগমনের সংবাদ মহানবী (সঃ) দিয়ে গেছেন। আগমনকারী ঐ ঈসা এবং ইমাম মাহ্দী একই ব্যক্তি (ইবনে মাজাহ্)। রসূলে করীম (সঃ) রুইয়াতে, মুসায়ী ঈসাকে লাল বর্ণ এবং শেষ যুগের মসীহকে গোধূম বর্ণ দেখেছেন। তাঁদের চুলের মধ্যেও বিস্তর পার্থক্য (বুখারী)। তিনি বনী ইস্রাঈলী ঈসা (আঃ)-কে দেখেছেন কোঁকড়ানো চুলবিশিষ্ট এবং তাঁর (সঃ) উম্মতে আগমনকারী ঈসা (আঃ)-কে দেখেছেন সরল-সোজা চুল বিশিষ্ট। নবী করীম (সঃ) শেষ যুগের প্রতিশ্রুত ঈসা (আঃ)-কে একই হাদীসে চার বার ‘নবী’ বলেছেন (মুসলিম)। তিনি অন্যত্র বলেছেন, “আলা ইন্নাহু খালিফাতি ফি উম্মতি ওয়া ইন্নাহু লাইসা বায়নি ও বায়নাহু নবীউন ওয়া লা রসূলুন (তিবরানী) অর্থাৎ আমার ও তাঁর মধ্যবর্তী সময়ে কোন নবী বা রসূল নেই। মাওলানা জামী (রাঃ) বলেছেন, ইনি (ঈসা) মহানবী (সঃ)-এর দীন ও শরীয়তের অনুসারী হবেন, মূলের অধীন ও শাখা হবেন মাত্র।
শরীয়ত ও দীন হবে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর (খতমে নবুওয়ত, মুফতি মোহাম্মদ শফি কৃত)। নবী করীম (সঃ) তো এই উম্মতের প্রকৃত আলেমদেরকেও ইস্রাঈলী নবীদের তুল্য বলেছেন। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (রহঃ) বলেছেন, সাধারণ মানুষ মনে করে প্রতিশ্রুত ঈসা যখন আর্বিভূত হবেন তখন তিনি শুধু একজন উম্মতি হবেন, নবী হবেন না। জেনে রাখ, এ কথা ভুল। এমন হবে না। তিনি হবেন দ্বিতীয় মুহাম্মদ (খায়রুল কাসীর) । আর এই প্রতিশ্রুত মসীহ্ ইমাম মাহদী (আঃ)-ই হলেন উম্মতি নবী।

সুহৃদ পাঠকদের কাছে চিন্তা ও বিবেচনার জন্য নিম্নে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরছিঃ

(১) আল্হাজ্জ মাওলানা মুহাম্মদ আমীনুল ইসলামের অনুবাদকৃত বই “যে ফুলের খুশবুতে সারা জাহান মাতওয়ারা” ২৪০-২৪১ পৃষ্ঠায় একটি দীর্ঘ হাদীস লিপিবদ্ধ আছে। হাদীসটি এইরূপঃ

“হযরত আনাস (রাঃ) হতে এক সুদীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, আল্লাহ্ পাক একবার মূসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্যে করে ইরশাদ করলেনঃ “তুমি বনী ঈসরাঈলকে জানিয়ে দাও, যে ব্যক্তি আহমদ (সঃ)-এর প্রতি অবিশ্বাসী অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, সে যে-ই হোক আমি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো।”

……… অতঃপর মূসা (আঃ) আরয করলেন ঃ “হে আল্লাহ্ আমাকে সেই উম্মতের নবী বানিয়ে দাও । আল্লাহ পাক ইরশাদ করলেন “সেই উম্মতের নবী তাদের মধ্য থেকেই হবে।” মূসা (আঃ) পুনারায় আরয করলেন, “তবে আমাকে সেই নবীর একজন উম্মত বানিয়ে দাও।” আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করলেন, “তুমি তাঁর পূর্বেই নবীরূপে আবির্ভূত হয়েছে আর সেই নবী তোমার পরে প্রেরিত হবেন। তবে জান্নাতে তাঁর সঙ্গে তোমাকে একত্রিত করে দিব” (মওলানা আশরাফ আলী থানভী প্রণীত নসরুত্তিব পুস্তকখানার বঙ্গানুবাদ এই নামে প্রকাশ করেছে ইসলামী ফাউন্ডেশন, ঢাকা। মুফতী মুহাম্মদ শফি প্রণীত ‘খতমে নবুওয়ত’ পুস্তকেও অনুরূপ হাদীসখানা উদ্ধৃত করা হয়েছে-প্রকাশক)।

(২) হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী বর্ণনা করেনঃ

অর্থাৎ নেকীর রাস্তায় খেদমতের এমন পদ্ধতি অবলম্বন কর যাতে তুমি উম্মতের মধ্যে নবুওয়ত লাভ কর (মসনভী রূম, দফতরে আওয়াল, ৫৩ পৃঃ)।

(৩) হুযাযুল কেরামা, ৪২৬ পৃষ্ঠায় লেখা আছেঃ

অর্থাৎ যদিও তিনি (ইমাম মাহ্দী) উম্মতে মুহাম্মদীয়ার খলীফা হবেন তদুপরি তিনি নবী ও রসূল হবেন।

(৪) বিশিষ্ট মুফাসসেরে কুরআন ও ইমামে তরীকত হযরত মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী (রহঃ) লিখেছেন,

অর্থাৎ “আমরা সন্দেহাতীতভাবে জানিতে পারিলাম যে, এই উম্মতে এরূপ ব্যক্তিরাও হবেন যাঁদের দরজা নবুওয়তের ক্ষেত্রে আল্লাহতাআলার নিকট নবীদের দরজায় উপনীত হবে কিন্তু তাঁরা শরীয়ত আনয়নকারী হবেন না (ফতুহাতে মক্কীয়া, প্রথম খণ্ড, ৫৪৫ পৃঃ)

(৫) মাদ্রাসা-এ দেওবন্দ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং দেওবন্দী ফির্কার ইমাম ও নেতা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী (রহঃ)

এ বিষয়ে নিজের গবেষণাকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে “যদি রসূল করীম (সঃ)-এর যামানার পরেও কোন নবীর আবির্ভাব হয় তবুও খাতেমিয়াতে মুহাম্মদীতে কোন পার্থক্য সূচিত হবে না (তাহযিরুন্নাস, ২৪ পৃঃ)।

(৬) মাওলানা কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব (ফাযেল দেওবন্দ এবং পরিচালক দারুল উলুম দেওবন্দ) বলেন, “হুযুরের শান ও মর্যাদা শুধু নবুওয়তই নয় বরং

‘নবুওয়ত দানকারী অর্থাৎ যে ব্যক্তি নবুওয়তের গুণে গুণান্বিত সে তার (সঃ) অধীনে আসলেই নবী হয়ে যাবেন” (আফতাবে নবুওয়তে কামেল, ১০৯ পৃঃ)।

 

সুধীবৃন্দ! আরও বহু উদ্ধৃতিও দেয়া যেতে পারে। মূল বক্তব্য হলো উম্মতে
মুহাম্মদীয়ার বুযর্গগণ আগমনকারী মাহ্দীর মর্যাদা “নবী” বলে নির্দিষ্ট করেছেন। এখন প্রশ্ন উঠে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর হাদীসে নবীর আগমনের পথ খোলাও রয়েছে এবং পথ বন্ধও রয়েছে। তাহলে কি হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কালামে স্ববিরোধী বক্তব্য রয়েছে? তা কখনও হতে পারে না এর সমাধান করতে হবে। যাকে হাদীসের পরিভাষার “তাতবীক” বলা হয়। সমাধানটি এই যে, যেখানে হযরত মুহাম্মদ (সঃ) নবীর আগমনের পথ খোলা রেখেছেন সেখানে মর্যাদার দিক থেকে নবী অর্থাৎ উম্মতী নবীর দরজা খোলা রেখেছেন, যিনি শরীয়তে মুহাম্মদীয়ার “তাবে” অনুগামী নবী হবেন। এবং যেখানে তিনি (সঃ) নবীর পথ বন্ধ করেছেন সেখানে এই অর্থে যে, আগামীতে কিয়ামত কাল অবধি শরীয়তধারী নবী আগমনের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কোন এমন ব্যক্তির আবির্ভাব হবে না যিনি শরীয়তে মুহাম্মদীয়ার মধ্যে বিন্দু মাত্র পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করার অধিকারী হবেন। আহমদীয়া মুসলিম জামাতেরও এই বিশ্বাস। সুতরাং উম্মতে  মুহাম্মদীয়ার সর্বমান্য বহু বুযর্গান উপরোক্ত বিষয়ে কলম ধরেছেন। ইদানিং কালের উলামার মধ্যে দেওবন্দী ফিরকার ইমাম মাওলানা কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব সাহেব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিম্নে কতিপয় উদ্ধৃতি তুলে ধরে সুধী পাঠকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইঃ

(১) সুফীকুল শিরোমনি হযরত শেখ মুহিউদ্দীন ইবনুল আরবী (রহঃ) লিখেছেন-

অর্থাৎ হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর আগমনে যে নবুওয়ত বন্ধ হয়েছে তা শুধু
শরীয়ত আনয়নকারী নবুওয়ত, নবুওয়তের মুকাম (পদ বা মর্যাদা) নয়। সুতরা এমন কোন শরীয়ত আসবে না যা আঁ হযরত (সঃ)-এর শরীয়তকে রহিত করবে কিংবা তাঁর (সঃ) শরীয়তে কোন আদেশ বৃদ্ধি করবে (ফতুহাতে মক্কীয়া, ২য় খণ্ড, ৩ পৃঃ)।

(৩) ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেসানী সরহিন্দী (রহঃ) বলেনঃ

অর্থাৎ খাতামুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর আবির্ভাবের পর তার অনুসরণ ও অনুবর্তীতায় এবং রূহানী উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর (সঃ) অনুসারীদের মধ্যে যদি কেউ নবুওয়তের মাহাত্ম্যসমূহ লাভ করেন, তাহলে উহা তাঁর (সঃ) খাতামান নবীয়ীন হওয়ার পরিপন্থী হবে না। সুতরাং এ বিষয়ে তুমি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। (মকতুব নং ৩০১, পৃঃ ৪৩২১ম খণ্ড)।

(৩) হযরত সৈয়্যদ অলিউল্লাহ্ মুহাদ্দেস দেহলবী (রহঃ) বলেনঃ

অর্থাৎ আঁ হযরত (সঃ)-এর দ্বারা নবুওয়ত খতম হয়েছে- ইহার অর্থ এই যে, তাঁর (সঃ) পরে এমন কোন নবী আগমন করবে না, যাকে খোদাতাআলা শরীয়ত দিয়ে মানবজাতির প্রতি আদিষ্ট করবেন (তফহীমাতে ইলাহীয়া, ৫৩ পৃঃ)

(৪) হযরত মৌলানা আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌবী বলেনঃ

অর্থাৎ আঁ হযরত সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লামের পরে কিংবা তাঁর (সঃ) সময়ে, কারো শুধু নবী হওয়া অসম্ভব নয়। বরং নতুন শরীয়তাধারী নবীর আগমন অসম্ভব”। (দফেউল ওসওয়াস, ১২ পৃঃ)।

উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোর সাথে হযরত মির্যা সাহেবের নবুওয়তের দাবী মিলিয়ে দেখুন। দেখবেন উদ্ধৃতিগুলো তাঁর দাবীকে সমর্থন করে। মির্যা সাহেব বলেন, “যে স্থানে আমি নবী বা রসূল হবার কথা অস্বীকার করেছি, সেখানে এই অর্থেই অস্বীকার করেছি, যে, ‘আমি শরীয়তবাহী নবী নই এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নবীও নই।” কিন্তু আমি আমার নেতা রসূলের (সঃ) আত্মিক কল্যাণ লাভ করে তাঁরই (সঃ) মাধ্যমে খোদা হতে গায়েবের সংবাদ পেয়েছি। এই অর্থে আমি নবী ও রসূল। কিন্তু আমার কোন নূতন শরীয়ত নেই। আর এই অর্থেই আল্লাহ্‌ আমাকে নবী ও রসূল বলে সম্বোধন করেছেন। এইরূপ নবী হওয়া আমি কখনও অস্বীকার করি নিই এবং এখনও আমি এই অর্থে নবী ও রসূল হওয়া অস্বীকার করি না।

-আমার একটি উক্তি। এর অর্থ মাত্র এটুকু যে, “আমি শরীয়তবাহী নবী নই” (পুস্তক : ‘এক গলতিকা ইযালা’-একটি ভুল সংশোধন ১০-১১ পৃষ্ঠা)। সুতরাং
হযরত মির্যা সাহেব যেখানেই নবুওয়তের দাবীর উল্লেখ করেছেন, শুধু এই অর্থেই
করেছেন যে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর দাসত্ব ও অনুবর্তীতার ফলস্বরূপ আল্লাহ্তাআলা এই রসূলের (সঃ) উম্মতের জন্য যে সকল পুরস্কার রেখেছেন অর্থাৎ ঃ নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহ হওয়া, আমি তার মধ্য থেকে নবীর পুরস্কার পেয়েছি। স্মরণ রাখা দরকার নবী আরবী শব্দ ‘নাবাউন’ থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ হলো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। তাহলে নবীর অর্থ হবে খোদার তরফ থেকে খবর পেয়ে বেশী বেশী গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দানকারী’।

ইমাম মাহদীকে শুধু এই কারণেই নবী বলা হয়েছে, যেহেতু খোদাতাআলা তাকে
মনোনীত করবেন এবং আল্লাহর সাথে তার বেশী বেশী মোকালামা মোখাতাবা
(কথপোকথন) হবে। অতএব, হযরত মির্যা সাহেবের দাবীতে আপত্তির কিছুই নেই।

প্রথম আপত্তির খন্ডন

হযরত রসূলে করীম (সঃ)-এর সম্পূর্ণ হাদীসটি হ’লঃ

অর্থাৎ তুমি কি পসন্দ কর না যে, আমার সাথে তোমার সে সম্পর্ক স্থাপিত হোক,
যা হারূনের সাথে মূসার ছিল? কিন্তু ব্যতিক্রম ইহাই যে, আমার পরে নবী নেই। (মুসনাদে আহমদ বিন হাম্বল, প্রথম খন্ড, ১৮২ পৃঃ)

“লা নবীয়া বা’দী” হাদীসটির আরও রেওয়ায়াত আছে। হাদীসের মর্মকে বুঝার
জন্য কয়েকটি বিষয় বুঝা অতীব গুরুত্বপুর্ণ। (ক)-হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর “কওল” বা “ফেল” (কথা বা কাজ) কোন উপলক্ষ্যে ও কোন সময়ে এবং কোন
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণিত (খ) সম্বোধিত ব্যক্তি কে? ইত্যাদি। হাদীসের যে কোন জটিলতার ক্ষেত্রে, বর্ণিত বিষয়াবলীর ভিত্তিতে পর্যালোচনা করলে এর সঠিক সমাধান পাওয়া যাবে। “লা নবীয়া বাদী” হাদীসটি একটি বড় হাদীসের অংশ। বিশেষ। বর্ণিত

হাদীসটি তাবূকের যুদ্ধের সময়ের। তাবূকের যুদ্ধে হযরত রসূলে করীম (সঃ) যখন হযরত আলী (রাঃ)-কে মদীনার মহিলা ও বাচ্চাদের উপর আমীর (প্রতিনিধি) নিযুক্ত করলেন, তখন হযরত আলী (রাঃ) বললেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ্! আমাকে মেয়েলোকদের মধ্যে ছেড়ে যাচ্ছেন?” এর উত্তরে হযরত রসূল করীম (সঃ) যা বলেছিলেন তা-ই হলো উপরোক্ত হাদীস। এই হাদীসের আরও দু’টি রেওয়ায়াত আছে। আয়শা বিনতে সআদ হতে বর্ণিত হাদীসে আছেঃ

অর্থাৎঃ নবুওয়ত ব্যতিরেকে (মুসনদ আহমদ বিন হাম্বল, প্রথম খন্ড, ১৭০ পৃঃ)।
আর একটি রেওয়ায়াত আছে হযরত আবদুল্লহ বিন আব্বাস (রাঃ)-এর। যেখানে আছেঃ

অর্থাৎঃ ‘তুমি নবী নও।’ তাহলে এই হাদীসের অর্থ
ইহাই দাঁড়াল যে, “হে আলী (রাঃ) তুমি আমার পর সেই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, যে মর্যাদায় হারূন (আঃ) হযরত মূসা (আঃ)-এর অনুপস্থিতিতে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু তোমার ও হারূনের মধ্যে পার্থক্য এই যে, হারূন (আঃ) নবী ছিলেন কিন্তু তুমি নবী নও।”

সুতরাং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ)-কে বলেছেন যে, তার (সঃ) অনুপস্থিতিতে আলী (রাঃ) নবী নন।

হাদীসটি রসূলে করীম (সঃ)-এর সূক্ষ্ম দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। তার (সঃ) পরে .
কখনও কোন নবী হবেন কিনা এ কথা বুঝাতে তিনি

বলেন নি।

বরং হযরত আলী (রাঃ) স্বয়ং নিজকে হারূনের অনুরূপ ‘নবী’ মনে করতে পারেন এবং ভবিষ্যতের জনগণও তাকে হারূনের অনুরূপ ‘নবী’ আখ্যায় ভূষিত করতে পারে। এই আশঙ্কাকে নির্মুল করার জন্যই তিনি এ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাই বলা হয়েছে যে, আলী (রাঃ) হারূন (আঃ)-এর সাথে সমতুল্য হলেও তিনি কোন অবস্থাতেই তার অনুরূপ ‘নবী’ নহেন! কিন্তু কি আশ্চর্য রসূল (সঃ)-এর এত সতর্কতা সত্ত্বেও কোন কোন ভ্রান্ত দল তাকে আজ কেবল নবী নহে বরং রসূল (সঃ)-এর চেয়েও অধিক মর্যাদাবান নবী হিসেবে গণ্য করেছে।

 

দ্বিতীয় আপত্তির খন্ডন

প্রায় পুস্তকে বুখারী শরীফের হাদীস উদ্ধৃত করা হয়েছে যে,

আকেব হিযরত রসূল করীম (সঃ)-এর নাম সেই ব্যক্তি যার
পরে কোন নবী নেই। আপত্তি করা হয়েছে যে, এই হাদীসের বর্তমানে হযরত মির্যা সাহেব কীভাবে নবী হবার দাবী করতে পারেন।

উত্তর

এই আপত্তি শুনে এক আশেকে রসূলের হৃদয় কেপে উঠে কারণ, উপরোক্ত
বর্ণনাটি হযরত রসূলে করীম (সঃ)-এর হাদীস নয়, বরং হযরত ইমাম যুহরির উক্তি। যেমন মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল এর ৪র্থ খন্ডের ৮৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে:

অর্থাৎ মামার বলল, ‘আমি যুহরীকে জিজ্ঞেসা করলাম আকেব’ এর অর্থ কি?
তিনি বললেন, যার পরে কোন নবী নেই।’মুসলিম শরীফে হাদীসটি আছে এইরূপ:

অর্থাৎ আমি আকেব’ যার পরে কেউ নেই। (মুসলিম বাব ফি আসমায়ে -(সঃ)
সুতরাং উপরোক্ত হাদীসকে না বুঝে এবং সঠিকভাবে বর্ণনা না করে শুধু শুধু
আপত্তি করা গুনাহের কাজ নয় কি?

হযরত মুল্লা আলী কারী (রহঃ) লিখেছেনঃ

অর্থাৎ ইহা পরিষ্কার যে, কোন সাহাবী অথবা পরবর্তিতে কোন ব্যক্তি ব্যাখ্যারূপে ইহা

বাড়িয়ে দিয়েছে। ইবনে
আরাবী শরাহ্ মুসলিমে’ বলেছেন “আকেব” সেই ব্যক্তি যে কোন ভালো কাজে পূর্ববর্তী ব্যক্তির স্থলাভিষিক্ত (মিরকাত শরাহ্ মিশকাত, পঞ্চম খণ্ড, ৩৭৬ পৃঃ টীকা, মিশকাতে মুজতাবাঈ, বাব আস্মাউন্নবী)

সহৃদয় পাঠকবৃন্দের কাছে আবেদন, যাচাই না করে কারও উপর কোন অপবাদ দেয়া বিবেকবান ব্যক্তির কাজ নয়। বিশেষ করে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর হাদীসকে না বুঝে বা না জেনে ব্যবহার করা গুরুতর অন্যায় ও পাপ। আর যদি জেনে শুনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রতারণার মানসে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তো ইহা জঘন্যতম অপরাধ। হযরত রসূল করীম (সঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জেনে শুনে আমার উপর কোন মিথ্যা আরোপ করে তার ঠিকানা জাহান্নামে।” অতএব অনেক কিছু বুঝার আছে, জানার আছে, পড়ার আছে। শুধু অনুমানের উপর, শুনা কথার উপর বিশ্বাস করে কাউকে অপবাদ দেয়া যেতে পারে না। দলীল-প্রমাণ, যুক্তি ও সৎ-বিবেকই হলো সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের প্রধান উপায় । মিথ্যা অপবাদ সত্য যাচাইয়ের পথ তো নয়ই বরং ইহা অত্যাচার-অবিচার ও নির্যাতনের পথকে প্রশস্ত করতঃ মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।