কুফরী মতবাদ (কলেমা এবং খোদার সন্তান তুল্য) বিষয়ক আপত্তির উত্তর


আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধে প্রকাশিত বই পুস্তকগুলোতে হযরত মির্যা সাহেব কুফরী মতবাদ পোষণ করতেন বলে যে সকল অপবাদ দেয়া হয়, তার মধ্যে নিম্নের দু’টি অন্যতমঃ (১) আহমদীদের কলেমা ভিন্ন। যখন তারা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ বলে, তখন তারা মনে মনে মির্যা গোলাম আহমদ’, বলে (২) হযরত মির্যা সাহেব ‘আরবাঈন‘ পুস্তকে লিখেছেন, “আমি খোদার নিকট তাঁর সন্তান তুল্য।”

উত্তর: (১) কলেমা সম্বন্ধে আরোপিত অপবাদটি এমনই বেদনাদায়ক যে, অপবাদটি শুনা মাত্র প্রতিটি আহ্মদীর বুক ফেটে যেতে চায়। আল্লাহকে যারা মোটেই ভয় করে না, আখেরাতের জন্যে যারা পরওয়া করে না, কেবল এ ধরনের পাষাণ-হৃদয়সম্পন্ন। ব্যক্তিরাই এমন একটা,জঘন্য ভিত্তিহীন, মিথ্যা অপবাদের জন্ম দিতে পারে। আখেরী যামানায় এসে মিথ্যাবাদিতাও যেন কারো কারো ধর্মের অঙ্গ হয়ে গেছে! আফসোস!
ধর্মের ইতিহাসে এ ধরনের জাজ্জ্বল্যমান মিথ্যার সৃষ্টি খুব কমই দেখা যায়। একমাত্র খোদাতাআলাই মানুষের অন্তর্যামী, অন্য কেউ নয়। সুতরাং অবাক লাগে, দলীল-প্রমাণ ছাড়াই, তথাকথিত এক শ্রেণীর আলখেল্লাধারী ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন যে, আহ্মদীরা মনে মনে কি বলে, তা-ও তারা জানেন। অথচ রসূলুল্লাহ্ (সঃ) মানুষের মনের কথা জানতেন বলে দাবী করেন,নি। এ ধরনের আলেমদের সম্বন্ধে হযরত রসূলে করীম (সঃ) বলেছেন:

 

অর্থাৎ পোষাক-পরিচ্ছদে তোমরা খৃষ্টান, সংস্কৃতিতে তোমরা হিন্দু, এরাই হলো
মুসলমান যাদিগকে দেখে ইহুদীরা লজ্জা পায়।

আল্লাহ্‌র ফযলে, আহমদীয়া মুসলিম জামাতের প্রতিটি সদস্য হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর কলেমায় বিশ্বাসী এবং তারা অন্তর থেকে উচ্চারণ করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ । আজ দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় আহমদীরাই কলেমা তাইয়্যেবাহর নামে নির্যাতিত হচ্ছে। তারা তাদের জান, মাল ও ইজ্জত কুরবান করে বিরুদ্ধবাদীদের দেয়া অপবাদটি মিথ্যা প্রতিপন্ন করে চলেছে। দুনিয়াতে এমন কেউ নেই, যে কিনা আহমদীদের বুক থেকে কলেমা তাইয়েবাহ মিটিয়ে ফেলতে পারে। এমন কেউ নেই, যে মুখের জোরে তাদের কলেমাকে বদলিয়ে দিতে পারে। হযরত মির্যা সাহেবের (আঃ) লেখা হতে আমি অপবাদটির খণ্ডন করছি।

“যত নবী গত হয়েছেন তাদের খেদমত শুধু ইহাই ছিল যেন ‘লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহু’-এর বিষয়-বস্তুটি পৃথিবীতে ঐ রূপে উদ্দীপ্ত হয়, যেভাবে তা আকাশে উদ্দীপ্ত। এদের মধ্যে সবচে’ শ্রেষ্ঠ তিনিই যিনি কল্পিত মাবুদদের দুর্বলতাকে সপ্রমাণ করেছেন। তিনি জ্ঞান ও শক্তি দ্বারা তাদের মিথ্যা হওয়া প্রমাণ করেছেন। এবং সব কিছু প্রমাণান্তে বিজয় ফলকত্বরূপ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ গেড়ে দিয়েছেন।

………

সুতরাং সেই প্রতিষ্ঠিত সত্যকে স্মরণ রাখার জন্য তিনি সর্বকালের জন্য এই পবিত্র কলেমা শিখিয়েছেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” (মসীহ হিন্দুস্থান মে, ৬৫) ।

সুধীবৃন্দ! দুনিয়ার আহমদীদের বুকে এই পবিত্র কলেমা চিরখচিত। এই কলেমাই
তাদের আত্মা ও প্রাণ। জামাতে আহমদীয়া এই কলেমার উপর কেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত তার একটি ঝলক দেখুন। আহমদীয়া মুসলিম জামাতকে উপদেশ দিতে গিয়ে জামাতের দ্বিতীয় খলীফা (রাঃ) বলেন ঃ “তোমাদের ঈমান তো এইরূপ হওয়া প্রয়োজন যে, দশ কোটি বাদশাহ্ও এসে যদি তোমাদিগকে বলে “তোমরা এই ইসলামের বিরুদ্ধে একটি মাত্র কথা মেনে নাও, তাহলে আমরা আমাদের বাদশাহাত ছেড়ে দিব” তাহলেও সেই দশ কোটি বাদশাহর জন্য তোমাদের উত্তর হবে, “তোমাদের এই কথার জন্য আফসোস, হযরত রসূল করীম (সঃ)-এর বিপক্ষে একটি কথা মানার ফলে যদি তোমাদের ও তোমাদের বাপ-দাদার সমস্ত রাজত্ব আমাদের হাতে আসে, তাহলেও ঐ রাজত্বের উপর আমরা থু থু নিক্ষেপ করি।”

অপ্রিয় সত্য

কলেমা তাইয়্যেবার প্রথম অংশ সম্বন্ধে ওলামায়ে দীন আশ্চর্য রকমের তথ্য দিয়ে
থাকেন। আসুন দেখি, তাদের নিকট কলেমার মর্যাদার তত্ত্ব কী তা বুঝতে চেষ্টা করি? শিয়াদের পুস্তক তাযকেরাতুল আইম্মার ৯৯ পৃষ্ঠায় লিখা আছে, “হযরত আলী খোদা।” শিয়া মাযহাবের আরেক পুস্তক “মোনাকেবে মুরতাযাভী হায়াতুল কুলুব” এর দ্বিতীয় খণ্ডের ৪৯ অধ্যায়ে লেখা আছে, “হযরত আলী খোদা এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দা।”
এইভাবে তাদের পুস্তক “হাক্কুল ইয়াকীন মজলিস” এর পঞ্চম অধ্যায়ে লেখা আছে যে, “হযরত আলী সকল নবীগণ থেকে শ্রেষ্ঠ।” মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সম্বন্ধে এ মন্তব্য করা হয় যে, “হুযূর সল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম মাওলানা থানভীর রূপে আমাদের মধ্যে বর্তমান আছেন,” (আসদাকুর রুইয়া)। অনুরূপভাবে লেখা আছে যে, “তাঁর (সঃ) চেহারা এমন ছিল, যেরকম মাওলানা থানূভীর” (আসদাকুর রুইয়া ৩৭ পৃঃ)।

প্রসিদ্ধ দেওবন্দী পত্রিকা ‘আল্‌ ইমদাদ’ সফর মাস তেরশ্ত ছত্রিশ হিজরী তৃতীয়

খণ্ডের পয়ত্রিশ পৃষ্ঠায় মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর এক মুরীদের স্বপ্ন লিপিবদ্ধ আছে যে, সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আশরাফ আলী রসূলুল্লাহ্র কলেমা পাঠ করছে এবং ‘আল্লাহুম্মা সল্লে ‘আলা সাইয়্যেদনা ওয়া নাবীয়েনা ওয়া মাওলানা আশরাফ আলী’র
দুরূদ পাঠ করছে। জনাব থানভী সাহেব এই স্বপ্নকে বিশ্বাসযোগ্য ও রহমানী বলে
সত্যায়িত করেছেন এর ফলে তার বিরুদ্ধবাদী ওলামারা তার বিরুদ্ধে ফতওয়া দেন যে, “সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলে সুন্নাত এর নিকট ইহা এক খবীস কলেমা। ইহা সুস্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দেওবন্দীরা মৌলভী আশরাফ আলী থানভী সাহেবকে সত্যিই রসূলুল্লাহ্ মনে করে এবং খাতামান্নাবীঈন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর পরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আশরাফ। আলী রসূলুল্লাহ্ পড়াকে আপত্তিজনক মনে করে না। এই গোপনীয়তাও প্রকাশ হয়ে গেল যে, দেওবন্দীরা হযরত রসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে নিজেদের নবী মনে করে না বরং তাদের রসূল আশরাফ আলী থানভী যাকে তারা রসূলুল্লাহ্ মনে করে এবং থানভীর মিথ্যা রেসালতের উপর সম্পূর্ণ ঈমান আনয়ন করে” (দেওবন্দী মাযহাবঃ  ৩৮৬ পৃঃ, মৌলানা গোলাম আহমদ মেহের কর্তৃক প্রণীত)।

হাসনাতুল আরেফীন পুস্তকের ২৪ পৃষ্ঠায় চিশতিয়া ফিরকার সম্বন্ধে লেখা আছে ।
যে, তাদের কলেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু চিশতি রসূলুল্লাহ, হযরত সুলতান বাহু (রহঃ) কর্তৃক অনূদিত হকনুমায়ে উর্দু যা “নুরূল হুদা” হতে অনুবাদকৃত, তার টীকার ১২৩ পৃষ্ঠায় এক কলেমা লেখা আছে “লা ইলাহা মান কানা ইল্লাল্লাহ্ তান কানা।”

ইসলামের এক ফিরকা যাকে “যিকরি মাযহাব” বলা হয় তাদের কলেমা হলো,
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু নূরপাক মেহেদী রসূলুল্লাহ্।” অনুরূপভাবে শিয়া ফিরকার কলেমাও পৃথক। সুধী পাঠকবৃন্দ! উপরোক্ত কলেমা পাঠকারীরা যদি মুসলমান হয়ে থাকে, তাহলে আহমদীয়া মুসলিম জামাতে, যারা দাবী করে যে, তাদের করেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্” তারা কীভাবে কুফরী মতবাদের অপবাদে.পড়তে পারে ? ফয়সালা আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।

দ্বিতীয় অপবাদের খণ্ডন

হযরত মির্যা সাহেব লিখেছেন, “আমি খোদার নিকট তাঁর সন্তান তুল্য” (আরবাঈন)। আপত্তিকারীর উদ্ধৃতিটি আরবাঈন পুস্তক থেকে নয়।

(ক) হযরত মির্যা সাহেবের আসল লেখাটি হলো তাঁর কিতাব হাকীকাতুল ওহী হতে। মূল এবারতটি হলোঃ

ইহা একটি ইলহাম, যার অর্থ হলো, “তুমি আমার নিকটে আমার সন্তানতুল্য”
(হাকীকাতুল ওহী, ৮৬ পৃঃ)।

খোদাতাআলা এই এলহাম দ্বারা ইহা বলতে চেয়েছেন যে, তুমি আমার নৈকট্যপ্রাপ্ত, প্রিয়।

(খ)

‘আমার পুত্র’ এখানে আলংকারিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর মর্ম হলো আমার নৈকট্যপ্রাপ্ত, অতি প্রিয়।

(গ) মাওলানা রুম বলেনঃ

অর্থাৎ সমস্ত মানবজাতি আল্লাহর পরিবার। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সেই যে আল্লাহর
পরিবারের সাথে ভালো ব্যবহার করে (মিশকাত বাব আশৃশাফাকাত)। হযরত মির্যা সাহেবের যে ইলহামের উপর দোষারোপ করা হয়েছে, সেখানেও উপরোক্ত হাদীসের মর্মই প্রযোজ্য। কাজেই এতে দোষের কিছুই নেই।

(ঙ) হযরত মির্যা সাহেব নিজেই তাঁর উপরোক্ত ইলহামের ব্যাখ্যা ইলহামের
সাথেই দিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন,

“মনে রেখো খোদার কোন পুত্র নেই, তিনি ইহা হতে পবিত্র। তাঁর কোন
অংশীদার নেই। কারও কোন অধিকার নেই যে, সে নিজেকে খোদা বা খোদার পুত্র বলে
‘ অভিহিত করে। কিন্তু আমাকে যে সম্বোধন করা হয়েছে, সেখানে রূপক এবং
আলংকারিকভাবে করা হয়েছে। যেইভাবে খোদাতাআলা কুরআনে বলেছেন ঃ

(আল ফাতহ: ১১ আয়াত)

অর্থাৎ “তাদের হাতের উপর আল্লাহ্র হাত” (হাকীকাতুল ওহী ৮৬ পৃঃ টিকা)।
(চ) কুরআন মাজীদে আল্লাহ্তাআলা বলেন,

অর্থাৎ তোমরা আল্লাহতাআলাকে তোমাদের পিতৃপুরুষগণের মত স্মরণ কর
(বাকারা : ২০১ আয়াত) এখানে আল্লাহতাআলা নিজেকে আমাদের পিতার সমতুল্য বলেছেন । এখানে আল্লাহতালা নিজেকে রূপকভাবে তোমাদের পিতা বলেছেন। তেমনি তিনি রূপকভাবে কোন ব্যক্তিকে তাঁর পুত্রও বলতে পারেন।
প্রমাণ হলো, অপবাদটি উদ্দেশ্যমূলক, ইহা কুফরী মতবাদ নয়।

অন্যান্য উত্তর