আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট আপত্তির জবাব


অতি সম্প্রতি আহমদীয়া মুসলিম জামাত তথা কাদিয়ানীরা কাফের কেন’ শীর্ষক দুই পৃষ্ঠার বেনামী একটি প্রচারপত্র সারা বাংলাদেশে প্রচার করা হয়েছে। প্রচারকের নামের স্থলে এতে একটি মোবাইল ফোন নম্বর দেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে পঞ্চগড় জেলায় এবং নোয়াখালী-ফেনীর বিভিন্ন স্থানেও এটি বণ্টন করা হয়েছে। আমরাও দুই পৃষ্ঠায় এর উত্তর জনসমুক্ষে উপস্থাপন করছি। এই প্রচারপত্রে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে তাদের উপস্থাপিত কোন তথ্য ভুল প্রমাণ করতে পারলে পুরস্কার রয়েছে। আমরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পাল্টা উত্তর প্রদান করছি এবং ঘোষিত পুরস্কার দাবি করছি।

মিথ্যা আপত্তি: আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে খাতামান্নাবিঈন মানে না।

আমাদের উত্তর: এটি একটি ডাহা মিথ্যা। আমরা হযরত মুহাম্মদ(সা.)-কে খাতামান নবীঈন বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের পবিত্র প্রতিষ্ঠাতা হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) নিজেও একমাত্র মহানবী(সা.)-কেই খাতামান নবীঈন বলে বিশ্বাস করতেন। তার সুস্পষ্ট বক্তব্য হল, আমরা ঈমান রাখি, আল্লাহ্ তা’লা ব্যতীত কোন মা’বুদ নেই এবং সৈয়্যদনা হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) আল্লাহর রসূল ও খাতামুল আম্বিয়া (আইয়ামুস সুলেহ্ পুস্তক, পৃষ্ঠা: ৮৬-৮৭) । এটিই আমাদের বিশ্বাস।

মিথ্যা আপত্তি: মির্যা গোলাম আহমদ (আ.) নবী হওয়ার দাবি করেছেন যা স্পষ্ট কুফুরী। 

আমাদের উত্তর: ডাহা মিথ্যা অপবাদ। তিনি কখনও শরীয়তবাহক, স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ নবুওতের দাবি করেন নি এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত ও হাক্কানী আলেমগণ কুফরী বলে মনে করেন- এমন কোন ধরনের নবুয়্যতের দাবি করেন নি। বরং তিনি সেই দাসত্বের নবুওত লাভ করার দাবি করেছেন যা পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৭০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। পাঠকদের অবগতির জন্য একথাও জানা আবশ্যক, মহানবী(সা.) তাঁর উম্মতের সংশোধনের জন্য ঈসা নবীউল্লাহর আগমন-বার্তা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে গেছেন (মুসলিম শরীফ, ইবনে মাজা দ্রষ্টব্য)। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ(আ.) বনি ইসরাঈলী নবী ঈসা(আ.)-এর মৃত্যু পবিত্র কুরআন থেকে প্রমাণ করতঃ আল্লাহর আদেশে নিজেকে রূপক অর্থে সেই ঈসা নবীউল্লাহ হিসেবে দাবি করেছেন। এ ধরনের নবুওতের কথা স্বয়ং রসূলুল্লাহ(সা.) বলে গেছেন। তাই মহানবী(সা.)-এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মোল্লা-মৌলভীদের যাবতীয় ফতোয়া পরিত্যাজ্য। উল্লেখ্য, খাতামান নবীঈন-এর যত অর্থ আছে আমরা সকল অর্থেই হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে খাতামান নবীঈন বলে মান্য করি। দেওবন্দী মাদ্রাসা ও মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী সাহেব ‘খাতামান নবীঈন’-এর যে বিশ্লেষণ তাহযীরুন্নাস পুস্তকে তুলে ধরেছেন তার সাথে আমরা সম্পূর্ণ একমত।

মিথ্যা আপত্তি: মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) নবীগণ সম্বন্ধে বেয়াদবিপূর্ণ অশালীন বক্তব্য ও কথাবার্তা বলেছেন। 

আমাদের উত্তর: উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা অপপ্রচার। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ) কোন নবীর বিরুদ্ধে কটুক্তিও করেন নি বা বে-আদবীও করেন নি। তিনি নিজে বলেছেন, ‘আমি সমস্ত নবীর প্রতি ভক্তি ও সম্মান প্রদর্শন করা আমার ঈমানের অঙ্গ বলে মনে করি (মলফুযাত, ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা-৪২০)। তবে হ্যা, খ্রিস্টানদের কল্পিত যিশুর ইশ্বরত্ব খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি তাদের ধর্মবিশ্বাসের আলোকে, তাদেরই ধর্মগ্রন্থ থেকে কয়েকটি কথা উদ্ধৃত করে কড়া জবাব দিয়েছেন। এগুলো কটুক্তি বা বে-আদবী নয় বরং অসুস্থ রোগীদের তেতো ঔষধ খাইয়ে সুস্থ করার একটি প্রয়াস মাত্র। খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে দাতভাঙ্গা জবাব মোল্লা-মৌলভীসাহেবদের বোধয় সহ্য হয় না!

মিথ্যা আপত্তি: মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার মিথ্যা নবুওয়তকে অস্বীকারকারী সকল মুসলমানকে কাফের বলেছেন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন এমনকি বেশ্যার সন্তান বলে গালি দিয়েছেন।

আমাদের উত্তর:  আমাদের চ্যালেঞ্জ, এটিও এক জঘন্য অপবাদ! লা’নাতুল্লাহে আলাল কাযেবীন- মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লানত। হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী(আ.) কখনও মুসলমানদের কাফের বলেন নি এবং তাঁর অমান্যকারীকে তিনি বেশ্যার সন্তান বলে গালি দিয়েছেন— এটিও একটি জঘন্য মিথ্যা অপবাদ। ইসলাম বিদ্বেষীদের বিপরীতে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ইসলামের সেনাপতি হয়ে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন তার আইনায়ে কামালাতে ইসলাম গ্রন্থে। তিনি বলেছেন ইসলামের স্বপক্ষে তার এই কাজ সকল মুসলমান গ্রহণ করে কেবল ‘যুররিয়াতুল বাগায়া’ ছাড়া। আরবীতে প্রতি জুমুআর খুতবার শেষে একটি বাক্য পড়া হয়: …ওয়া ইয়ানহা আনিল ফাহশায়ি ওয়াল মুনকারি ওয়াল বাগয়ি… লক্ষ্য করুন, একই শব্দ ‘বাগ্ই‌উন’ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ বিদ্রোহ। মজার বিষয় হল, একই বইতে মির্যা সাহেব মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব উল্লেখ করে রানী ভিক্টোরিয়ার প্রতি তাদের মনস্তুষ্টি করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু একটি কুচক্রী মহল এই শব্দটির কুরুচিপূর্ণ অর্থ করে সাধারণ মানুষকে নৈরাজ্যের দিকে উস্কে দিচ্ছে। মির্যা সাহেব কখনও কোন মুসলমানকে এমন গালি দেন নি। তিনি মুসলমানদের স্বপক্ষে ইসলাম-বিদ্বেষীদের সাথে সারা জীবন কলমের জিহাদ করেছেন। তবে হ্যা, রসূলুল্লাহ(সা.)-এর সতর্কবাণী অমান্য করে যেসব আলেম-উলামা মুসলমানদেরই একাংশকে কাফের বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তাদেরকে তিনি রসূলুল্লাহ(সা.) প্রদত্ত কুফরী ফতোয়া শুনিয়ে দিয়েছেন মাত্র। (হকীকাতুল ওহী এবং তার অন্যান্য গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)
মহানবী(সা.) সতর্ক করে বলেছেন,

‘যে মুহূর্তে একজন মুসলমান তার অপর মুসলমান ভাইকে কাফের বলে আখ্যা দেয় তখন নির্ঘাত এটি এই দুজনের একজনের ওপর অবশ্যই বর্তায়।’ (মুসলিম শরীফ, কিতাবুল ঈমান দ্রষ্টব্য)।

মিথ্যা আপত্তি: ১৭ জুলাই ১৯২২ তারিখের আল-ফজলে আহমদীয়া জামাতের দ্বিতীয় খলীফা বলেছেন, ‘আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে প্রত্যেকে উন্নতি করতে পারে এমনকি মুহাম্মদ (সা.)-এর চেয়েও বেশী উন্নতি করতে পারে।’


আমাদের উত্তর: কোন উদ্ধৃতির খন্ডিত অসম্পূর্ণ অংশ তুলে ধরে আপত্তিকারীরা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করেছে। কেননা, ঠিক পরের লাইনেই লেখা আছে, ‘কিন্তু দেখার বিষয় হল, আধ্যাত্মিকতার এই ময়দানে সবচেয়ে বেশী উন্নতি করেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। শুধু তাই নয় আল্লাহ তা’লা এ সাক্ষীও দিয়েছেন তিনি(সা.) পরবর্তীতে আগমনকারীদের থেকেও উন্নত পর্যায়ে রয়েছেন।’ আপত্তিকারী নিজের পক্ষ থেকে নিছক আপত্তি করার জন্য এই অংশটুকু বাদ দিয়ে দিয়েছে; এটি কী কোন সৎ মুসলমানের কাজ হতে পারে? পাঠকের বিবেকের কাছে প্রশ্ন। বরং আধ্যাত্মিক ময়দানে প্রত্যেকেই উন্নতি করতে পারে বলে স্পষ্ট করেছেন, আধ্যাত্মিকতার ময়দান সবার জন্য উন্মুক্ত না থাকলে অপরাপর মানুষের তুলনায় মুহাম্মদ(সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব বা কৃতিত্ব প্রমাণ হয় না। এর উদাহরণ এভাবেও দেয়া যায়, ধরুন কোন দৌড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে আর তাতে একজন এমন রেকর্ড করল যাকে বিশ্বরেকর্ড আখ্যায়িত করা হল। এই ঘোষণায় প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেয়া হয় নি। প্রতিযোগিতা সবার জন্য উন্মুক্ত সবাই নিজেকে এই ময়দানে যাচাই করে দেখতে পারে। এ বিষয়টিই আধ্যাত্মিকতার ময়দান সম্পর্কে মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.) বলেছেন অর্থাৎ মহানবী(সা.) আধ্যাত্মিকতার ময়দানে বিশ্বরেকর্ড করেছেন, কিন্তু অন্যদের জন্য এই ময়দান বন্ধ বা রুদ্ধ করে দেয়া হয় নি। ১৭ই জুলাই ১৯২২ সালের আল-ফজল পত্রিকার যেখানে আপত্তি তোলা হয়েছে ঠিক সেখানেই আহমদীয়া জামা’তের দ্বিতীয় খলীফা লিখেছেন, আল্লাহ তা’লা যেহেতু সব বিষয় ও যুগ সম্পর্কে অবহিত তাই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন ভবিষ্যতেও এমন কোন মানুষের জন্ম হবে না যে মুহাম্মদ(সা.)-কে পেছনে ফেলতে পারে (বক্স দ্রষ্টব্য)। অতএব, উন্নতির ময়দান ও মার্গ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মদ(সা.) সবচেয়ে বেশী উন্নতি করেছেন এবং উৎকর্ষে সব যুগের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। এটিই মহানবী (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব।একটি আধ্যাত্মিক দর্শনভিত্তিক বিশ্লেষণকে আক্ষরিক এবং কর্তিতরূপে উপস্থাপন করে বিষয়টিকে ঘোলাটে করার অপপ্রয়াস করা হয়েছে। অতএব, আপত্তিকারীর আপত্তি কোনভাবেই ধোপে টেকে না।

মিথ্যা আপত্তি: আকমল নামের এক ব্যক্তির একটি কবিতার একটি লাইনে রয়েছে, ‘মুহাম্মদ আবার আমাদের মাঝে এসেছে, মর্যাদায় আগের চেয়ে সামনে বেড়ে পূর্ণাঙ্গীন মুহাম্মদকে যদি কেউ দেখতে চাও কাদিয়ানে এসে গোলাম আহমদকে দেখে যাও।’


আমাদের উত্তর: এ বক্তব্য মির্যা সাহেবের নয়, আহমদীয়া জামাতের কোন খলীফারও নয়। অতএব এই অভিযোগটি আহমদীয়া জামা’তের বিরুদ্ধে আরোপিত হতে পারে না। এরপরও এই কবিতাংশটি যখন আহমদীয়া জামা’তের দ্বিতীয় খলীফা হযরত মির্যা বশীরুদ্দীন মাহমুদ (রা.)-এর সামনে উপস্থাপন করা হয় তিনি উত্তরে বলেন, ‘যদি এতে উন্নত মর্যাদা বুঝানো হয়ে থাকে তাহলে এমন বিশ্বাস নিঃসন্দেহে কুফরী।’ এরপর স্পষ্ট করে বলেছেন, যে অর্থেই এমন শব্দ ব্যবহার করা হোক না কেন ‘এটি চরম অপছন্দনীয় ও বে-আদবী’ (আলফজল, ১৯ আগস্ট ১৯৩৪)। যারা এত ঘাটাঘাটি করে আপত্তি করার সুযোগ খুঁজে বের করছে তারা কি এর প্রতিক্রিয়া দেখে নি?  নিশ্চয়ই দেখেছে! কিন্তু সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য এবং সামাজিক অশান্তি ও নৈরাজ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্যে আপত্তিকারীরা এমন ভিত্তিহীন আপত্তি করে যাচ্ছে। অতএব সাধু সাবধান।