আপত্তি: হযরত মির্যা সাহেব খোদা তা’লার পিতা হবার দাবী করেছেন


আপত্তিঃ হযরত মির্যা সাহেব খোদা তালার পিতা হবার দাবী করেছেন যেমনটি তিনি বলেছেন, “তুমি আমা হতে আর আমি তোমা হতে।” এবং সত্য ও অতীব উচ্চ প্রভুর প্রকাশস্থল যেন আল্লাহ আকাশ হতে অবতরণ করেছেন।

জবাব : প্রথম কথা হল- তুমি আমা হতে আর আমি তোমা হতে এ সম্পর্কে এতটুকু বলা যথেষ্ট আপত্তিকারী কুরআন মজীদ পড়েইনি এবং এর ব্যাপারে চিন্তাও করেনি। আরবী ভাষায় মিনকার অর্থ কখনই এরুপ হয় না যে, যেখানেই এ শব্দ আসে পিতা পুত্রের সম্পর্কেই আসে। যেরুপভাবে আল্লাহ তা’লা বলেন, হযরত তালুত বলেছেন, অর্থ: “যে এই নদী থেকে পরিতৃপ্তভাবে পান করবে সে আমার মধ্য হতে নয় আর যে পান করবে না সে আমার মধ্য হতে।

তাহলে এর মাধ্যমে কি এটি বুঝা যায় যে, যে পানি পান করবে সে আমার পুত্র থাকবে না আর যে পানি পান করবে না সে আমার পুত্র হয়ে যাবে? (মা আযাল্লাহ) কখনই নয়, বরং তার উদ্দেশ্য এতটুকুই ছিল যে, যে ব্যক্তি এই নদীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে সে আমার বন্ধু এবং প্রিয়জনের অন্তর্ভুক্ত হবে, অন্য কিছুই নয়। মৌলভী সানাউল্লাহ অমৃতসরী এই আয়াতের অনুবাদে লিখেন, যে ব্যক্তি এই নদী থেকে পান করবে সে আমার জামাতের অন্তর্ভুক্ত হবে না, আর যে পান করবে না সে আমার সাথী হবে। (তফসীরে সানায়ি, খন্ড-১, পৃষ্ঠা ১৯৫)

এছাড়াও আল্লামা জালালউদ্দিন সুউতি (রহ.)-ও মিন্নির অনুবাদ আমার অনুসরণকারী করেছেন। (জালালাইন, পৃ:৩৬)

এ বিষয়কে স্পষ্ট করতে গিয়ে হযরত ইবরাহিম (আ.) এর কথাও উল্লেখ করেছেন যে, যে আমার অনুসরন করে সে আমার মধ্য হতে। আঁ-হযরত (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন, انت منی و انا منک (মিশকাত, বাব মানাকেব পৃষ্ঠা ৫৬৪) এবং আশ’আরি গোত্র সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ھم منی و انا منھم (বুখারী, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা ৫০)

একইভাবে হযরত (সা.) ধৈর্য, উত্তমচরিত্র, পারহেযগারী সম্পর্কে বলেছেন, ثلاث من لم تکن فیہ فلیس منی و لا من اللہ (মুজাম সাগীর, তিবরানী)

এ রকম অসংখ্য শব্দ আরবী ভাষায় পাওয়া যায় যাতে ھومنہ یا انا منک শব্দসমষ্টি সম্পর্কের দিকে নির্দেশ করে। যদি মিনহুর অর্থ পিতা পুত্রের সম্পকের অর্থ হয় তাহলে আয়াত روح منہ (সূরা নিসা) থেকে খ্রিষ্টানদের মসীহকে খোদার পুত্র হিসেবে দলিল পেশ করা সঠিক বলে গণ্য হবে।

সুতরাং এই অর্থ করা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। অতএব হযরত মসীহ মওউদ (আ.) এর ইলহাম আনা মিনকা‘র অর্থ হবে, আমার তোমার সাথে সম্পর্ক রয়েছে। হযরত মসীহ মওউদ (আ.) এই বিষয়টি স্পষ্ট করতে গিয়ে লিখেছেন, এই ইলহাম (انت منی و انا منک)এর প্রথম অংশ পুরোপুরি স্পষ্ট যেতোমার বহিঃপ্রকাশ আমার কৃপা এবং অনুগ্রহের ফল আর যে ব্যক্তিকে খোদাতালা প্রত্যাদিষ্ট করে প্রেরণ করেন তাকে নিজ ইচ্ছা এবং আদেশে প্রত্যাদিষ্ট হিসেবে প্রেরণ করেন। যেরুপভাবে শাসকদেরও এরকমই নিয়মনীতি বিদ্যমান। এখন এই ইলহামে আল্লাহতালা যে انا منک বলেছেন এর অর্থ ও উদ্দেশ্য হলআমার তওহিদআমার প্রতাপ এবং আমার ইজ্জতের বহিঃপ্রকাশ তোমার মাধ্যমে হবে…..এমন এক সময় আসে যখন খোদাতালাকে হারিয়ে গেছে বলে মনে হয়। এটি তখন হয় যখন তার অস্তিত্বতার তওহিদ এবং তার গুনাবলির উপর ঈমান থাকে না এবং পৃথিবী নাস্তিক হয়ে যায়। সে সময় যে ব্যক্তিকে খোদা নিজ জ্যোতির বিকাশস্থল করেন সে তার অস্তিত্বতওহিদ এবং প্রতাপের প্রকাশের কারণ হয় এবং সে انا منکর সত্যায়নকারী হয়ে যায়।” (আল হাকাম, খন্ড-৬ পৃ:৪০)

তিনি (আ.) আরো বলেছেন, এমন মানুষ যে আনা মিনকার আওয়াজ পায়সেই সময় পৃথিবীতে আসে যখন খোদার ইবাদতের নাম ও নিশানা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই সময়েও যেহেতু পৃথিবীতে পাপ ও অবাধ্যতা অনেক বেড়ে গেছে এবং খোদাকে চেনার এবং খোদাকে পাওয়ার পথ দৃষ্টিপটে আসে নাতাই আল্লাহতালা এই জামাত প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং শুধুমাত্র নিজ কৃপা ও অনুগ্রহ দ্বারা তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন যেন আমি সেই সমস্ত লোককে যারা খোদাতালা সম্পর্কে উদাসীন এবং অজ্ঞ খোদা তালা সম্পর্কে অবগত করি আর শুধু অবগতই করি নাবরং যে সততাধৈর্য এবং বিশ্বস্থতার সাথে এদিকে ধাবিত হয় তাদেরকে খোদার দর্শন করাই। এই জন্যই আল্লাহতালা আমাকে সম্বোধন করে বলেছেনانت منی و انا منک(আল হাকাম পত্রিকা, খন্ড-৭, পৃষ্ঠা ৩৬)

আপত্তির দ্বিতীয় অংশ হল, کان اللہ نزل من السماء এটি হুযুর (আ.) এর ১৮৮৬ সালের ইশতেহার থেকে নেয়া হয়েছে এবং এটি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, যেন ইলহামে পুত্রকে খোদা আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ সামান্য চিন্তার মাধ্যমেও বুঝা যায়, এই স্থানে ব্যক্তিগত সত্তার সাদৃশ্য নয়, বরং অবতরণ ও আগমনের সাদৃশ্য দেখানো হয়েছে। কেননা তিনি বলেছেন, و مظہر الحق والعلاء و کان اللہ نزل من السماء যার অবতরণ অনেক বরকতমন্ডিত এবং ঐশী প্রতাপের প্রকাশের কারণ হবে। নূর আসে নূর! যাকে খোদা নিজ সন্তুষ্টির সুবাসে সুরভিত করে। আমরা তার মাঝে নিজেদের রুহ দান করব এবং খোদার ছায়া তার মাথার উপর হবে। সে দ্রুত বর্ধিত হবে এবং বন্দিদের মুক্তির কারণ হবে। সে পৃথিবীর কোণে কোণে খ্যাতি পাবে এবং জাতি তার কাছ থেকে কল্যাণ পাবে। তখন তার অভ্যন্তরীণ দৃষ্টি আকাশের দিকে উত্থিত করা হবে। و کان امرا مقضیا (ইশতেহার, ২০ফেব্রুয়ারী ১৮৮৬, তবলীগে রিসালাত, খন্ড ১ পৃষ্ঠা ৬০)

এখানে নুযুল বা অবতরণকে মানবীয় গুণাবলির মাধ্যমে একীভূত করে প্রমাণ করে দেয়া হয়েছে যে, বান্দার অবতরণ ছিল খোদার নয়। নতুবা যদি খোদাই অবতরণ করতেন তাহলে ঐশী প্রতাপের আগমনের কারণ ছায়া তার মাথার উপর থাকা, পৃথিবীর কোণে কোণে খ্যাতি পাওয়া, তার কাছ থেকে জাতির কল্যান পাওয়া, ব্যক্তিগত দৃষ্টিশক্তি আকাশের দিকে উত্থিত করার কি অর্থ?

সুতরাং এখানে নুযুল বা অবতরনের অর্থ হল তার কৃপার প্রকাশ, কেননা তিনি প্রকৃত অর্থে অবতরণ, উড্ডয়ন এবং নড়াচড়া থেকে পবিত্র এবং তিনি সর্বত্র বিদ্যমান। তার নুযুল বা অবতরণের কোন প্রয়োজন নেই।

যেরুপভাবে হাদীস থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। রসুলে করীম (সা.) বলেছেন,

ینزل ربنا تبارک و تعالی کل لیلۃ الی السماء الدنیا حتی یبقی ثلث اللیل الاخیر (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত কিতাবুস সালাত পৃষ্ঠা ১০৯) অর্থাৎ, “আমাদের কল্যাণমন্ডিত ও অতীব উচ্চ প্রভু প্রতি রাতে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত অবস্থান করেন।”

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় সমস্ত বুযুর্গান একমত যে নুযুলুর রাব্বি বা প্রভুর অবতরণের অর্থ হল তার কৃপার নুযুল বা অবতরন। সুতরাং লামাআত-এ আছে,

“النزول والھبوط والصعود والحرکات من صفات الاجسام واللہ تعالی متعال عنہ- والمراد نزول الرحمۃ و قربہ تعالی بانزال الرحمۃ و افاضۃ الانوار اجابۃ الدعوات و اعطاء المسائل و مغفرۃ الذنوب” (টিকা মিশকাত, মুজতাবাঈ, পৃ.১০৯)

একইভাবে মুয়াত্তা ইমাম মালেকের কিতাবেও লেখা আছে,

“قولہ ینزل ربنا ای نزول رحمۃ و مزید لطف و اجابۃ دعوۃ و قبول معذرۃ کما ھو دیدن الملوک الکرماء و السادۃ الرحماء اذا نزلوا بقرب قوم محتاجین ملھوفین لا نزول حرکات و انتقال لااستحالۃ ذلک علیہ سبحانہ”

(বাব মা জাআ ফি যিকরিল্লাহ, পৃ.৭৪)

মোটকথা আল্লাহতা’লার নুযুল বা অবতরনের অর্থ হল তার আশিষ ও কল্যানের অবতরন। এই দৃষ্টিতে ইলহামের অর্থ দাঁড়াবে সেই ছেলে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে। তার আগমনের সাথে সাথে খোদার কৃপা ও কল্যানের আগমন ঘটবে।

অন্যান্য উত্তর